মতামত

সুদানে সেনা অভ্যুত্থান যেসব কারণে

সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে সুদানের রাস্তায় টানা বিক্ষোভ করছেন গণতন্ত্রপন্থীরা
ছবি : এএফপি

দুই বছর আগে যাত্রা শুরু করা সুদানের ভঙ্গুর গণতন্ত্র যাতে ধসে না পড়ে, সে জন্য মার্কিন দূত দেশটির সেনাপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সংলাপে মধ্যস্থতা করেন। সুদানের রাজধানী খার্তুমে টান টান উত্তেজনার মধ্যে কয়েক দফা বৈঠকের পর ‘আফ্রিকান হর্ন’-এর মার্কিন দূত জেফরি ফেল্টম্যান ঘোষণা দেন, সুদানের সেনাপ্রধান লে. জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লাহ হামদকের মধ্যে মতের অমিল সামান্য। ২০১৯ সালে গণবিক্ষোভে দেশটির দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসক ওমর হাসান আল বশির ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর হামদকের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। ক্ষমতা ভাগাভাগির গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিলেন আল-বুরহান।

গত ২৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় তাঁরা সর্বশেষ আলোচনায় বসেন। সে সময় আল-বুরহান মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের কথা বলেন। কিন্তু তিনি যে ক্ষমতা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন, সে রকম কোনো ইঙ্গিত দেননি। আশ্বস্ত হয়ে মার্কিন দূত বিমানে করে কাতারের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। বিমানবন্দরে নেমেই জানতে পারেন, সুদানে সেনা অভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে সুদানি দূত নুরেলদিন সাত্তি তাঁর দেশের সামরিক নেতৃত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘তারা মার্কিন দূতের কাছে মিথ্যা বলেছে। এটা খুব গুরুতর বিষয়। কারণ, যখন কেউ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিথ্যা বলে, তখন এর জন্য কঠোর মূল্য দিতে হয়।’

সুদানে এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে জেনারেল আল-বুরহান দেশটির গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথ রুদ্ধ করে দেবেন। আবার তাঁর অভ্যুত্থান সফল হয়নি। কেননা, গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীরা রাস্তায় নেমেছেন। তবে একাধিক বিশ্লেষক, সুদানে অবস্থানরত মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেনাবাহিনীর মধ্যে বেসামরিক সরকারের প্রতি অসন্তোষ বাড়ছিল। দেশ শাসন ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর বিশেষ সুবিধা বজায় থাকবে কি না, তা নিয়ে সেনা কর্মকর্তারা শঙ্কিত ছিলেন। স্বৈরশাসক আল-বশিরের তিন দশকে যে দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছিল, সেগুলো তদন্ত হোক, তা তাঁরা চাননি।

অনেকে আবার অভ্যুত্থানের জন্য সুদানের অন্তর্বর্তী সরকারেরও দোষ দিয়েছেন। শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি হওয়ার ভয় দূর করতে পারেননি হামদক সরকার। একজন মার্কিন কর্মকর্তা এই অভ্যুত্থানের পেছনে রাশিয়ার সম্পৃক্ততার কথা জানিয়েছেন। সুদানে ব্যবসা প্রসার ও লোহিত সাগরের বন্দরের সুবিধা পাওয়ার আশায় তাঁরা এতে ইন্ধন জুগিয়েছেন বলে ওই কর্মকর্তা মনে করছেন। সুদানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৮ মাস ধরে অভ্যুত্থানের ভয়ে ছিল। গত সপ্তাহেই সেনা–সমর্থিত প্রতিবাদকারীরা প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের বাইরে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেনা–সমর্থিত জাতিগোষ্ঠীগুলো দেশটির প্রধান সমুদ্রবন্দর বন্ধ করে দিয়েছিল। অভ্যুত্থান যে আসন্ন, তখনই অনেকে ধারণা করেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রে সুদানি দূত নুরেলদিন সাত্তি তাঁর দেশের সামরিক নেতৃত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘তারা মার্কিন দূতের কাছে মিথ্যা বলেছে। এটা খুব গুরুতর বিষয়। কারণ, যখন কেউ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিথ্যা বলে, তখন এর জন্য কঠোর মূল্য দিতে হয়।’

ক্ষমতা গ্রহণের পর জেনারেল আল-বুরহান প্রধানমন্ত্রীকে আটক করেন এবং মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন। ইন্টারনেট পরিষেবা বিচ্ছিন্ন করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। ট্রেড ইউনিয়ন বাতিল এবং বেসামরিক নেতাদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করেন। এর ফলে রক্তক্ষয়ী বিক্ষোভের সূচনা হয়। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নেতারা সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা জানিয়ে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু এসব কিছু জেনারেল আল-বুরহান ও তাঁর সঙ্গীদের নমনীয় করতে পারবে বলে মনে হয় না।

এদিকে গণতন্ত্রপন্থীরা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে টানা বিক্ষোভ করে যাচ্ছেন। তাঁরা সেনাপ্রধানের অপসারণ এবং বেসামরিক শাসনবিধি ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছেন। জেনারেল বুরহান সুদানের ওপর ফের সামরিক আধিপত্য চাপিয়ে দিয়েছেন, জনগণ সেটা মোকাবিলা করছে। ২০১৯ সালের সেনা-সমর্থিত অভ্যুত্থানের পর ৬১ বছর বয়সী জেনারেল আল-বুরহান পাদপ্রদীপে আসেন। এরপর সেনাপ্রধান হিসেবে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে সুদানের সেনা পাঠাতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেসব সুদানি সেনার মধ্যে শিশুরাও ছিল। একসময় তিনি দারফুরে আঞ্চলিক সেনা কমান্ডার ছিলেন। ২০০৩-২০০৯ পর্যন্ত সেখানকার সংঘাতে ৩ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিলেন, ঘরবাড়ি হারিয়েছিলেন লাখ লাখ মানুষ। সুদানে সেনাবাহিনী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। বলা চলে, সেখানে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের সমান ক্ষমতাধর।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে গণতন্ত্রপন্থীরা সরকার পরিচালনায় সেনাবাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করার দাবি তোলেন। আল-বশিরের আমলের দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর তদন্তের দাবি করেন। এতে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চরমে ওঠে। এ ধরনের তদন্তের প্রশ্নে সেনা কর্মকর্তাদের অনেকে ভীত হয়ে পড়েন।

২০১৯ সালে জনসমর্থিত অভ্যুত্থানের পর সুদানের জনগণ একজন বলিষ্ঠ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য নেতার প্রত্যাশা করেছিলেন। কয়েক দশকের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পরও মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাইরে কোনো সফর করতে পারেননি বুরহান। পক্ষান্তরে ৬৫ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী হামদক একজন প্রসিদ্ধ অর্থনীতিবিদ। তাঁর জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানে।

শুরুর দিকে দুই নেতার মধ্যে সম্পর্কটা ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। হামদক সরকার দ্রুত বেশ কিছু সংস্কার কর্মসূচি শুরু করে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তিনি শান্তি চুক্তিও করেন। কিন্তু দেশ ও অর্থনীতি পরিচালনার প্রশ্নে শিগগিরই এ সম্পর্ক তিক্ত হতে শুরু করে। গত সেপ্টেম্বরে ওমর আল-বশিরের সমর্থকদের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর সেটা আরও বাড়ে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে গণতন্ত্রপন্থীরা সরকার পরিচালনায় সেনাবাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করার দাবি তোলেন। আল-বশিরের আমলের দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর তদন্তের দাবি করেন। এতে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চরমে ওঠে। এ ধরনের তদন্তের প্রশ্নে সেনা কর্মকর্তাদের অনেকে ভীত হয়ে পড়েন।

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাবেক স্বৈরশাসক বশিরকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) পাঠানো হবে কি না, সেটাও বর্তমান অভ্যুত্থানের একটা বড় কারণ। আইসিসিতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হলে, জেনারেল বুরহান কিংবা আরেক প্রভাবশালী জেনারেল মোহাম্মদ হামদান তাতে জড়িয়ে যাবেন। দারফুরে গণহত্যার অভিযোগ আছে দুজনের বিরুদ্ধেই।

অভ্যুত্থানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সাফাই গাইতে গিয়ে বুরহান দাবি করেছেন, ‘গৃহযুদ্ধ’ ঠেকাতেই এ পদক্ষেপ। ২০২৩ সালে সাধারণ নির্বাচনে তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন, এ রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর প্রতিশ্রুতিতে ভুলছেন না অনেক তরুণ সুদানি। তাঁরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন।

আবদি লাতিফ দাহির ও ডেকলান ওয়ালস নিউইয়র্ক টাইমস–এর সাংবাদিক

ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ, নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া