শীত আসছে, কলোনির বাসায় ঠিক এই সময় লাল কাপড়ের লেপগুলো ট্রাংক থেকে বের হতো। রোদ পোহাত তারা বারান্দার রেলিং ঝুঁকে কিংবা মাঠে পাটি বিছিয়ে, একবার এপিঠ তো আরেকবার ওপিঠ। মার্কিন কাপড়ের সাদা লেপের ওয়ারগুলো ধোয়া হতো আলাদা করে। আর হঠাৎ করেই সকাল সকাল শোনা যেত লেপ-তোশক ধোনার লোকের হাঁকডাক। কেউ কেউ নতুন লেপ বানাতেন বটে, তবে পুরোনো লেপ-তোশকের সঙ্গে নতুন তুলা যোগ করে ধুনে নিয়ে শীতের প্রস্তুতিই নিতেন বেশির ভাগ মানুষ। তারপর হাড়কাঁপানো শীতে তা গায়ে দিয়ে কী যে সুখ।
এখন ঢাকায় খুব ভালো মানের কটন কুয়িল্ট পাওয়া যায়। হালকা অথচ গরম। এক শীতে ব্যবহারের পর ড্রাই ওয়াশ করে পরের শীতের জন্য উঠিয়ে রাখা।
মায়ের কর্মসূত্রে পাওয়া কলোনির ভাড়া বাসা। আমরা থাকতাম ঢাকার আসাদগেট নিউ কলোনিতে। সাতটা বিল্ডিং, প্রতিটা বিল্ডিংয়ের সামনে একটা করে মাঠ। এখন ছয়টি মাঠেই বিল্ডিং উঠে যাচ্ছে। হারাধনের শেষ মাঠ বড় মাঠটা বেঁচে আছে। বাসাগুলো ছিল ছোট, তবে বাসার ছোটরা বড় হয়েছে মাঠে মাঠে খেলে। ছেলেমেয়ে সবাই। বিকেল হলেই দুই দিকে দুইটা টাইট বেণি করে এক দৌড়ে চলে যেতাম ‘খেলাঘরে’। দেশব্যাপী শিশুদের সংগঠন। যেটা এখন বড়রা ভেঙে দুই ভাগ করেছে! অন্নদা শংকর রায়ের সেই বিখ্যাত ছড়ার মতো প্রশ্ন জাগে, ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো? তোমরা যেসব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো, তার বেলা?’ তা যাক, আমাদের এলাকার খেলাঘরের নাম ছিল কলকণ্ঠ। খেলাঘরে কী হতো না? হাডুডু থেকে বিতর্ক, লাঠিনৃত্য থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর নাটক, একুশের প্রভাতফেরি থেকে বন্যার্তদের জন্য গান গেয়ে ত্রাণ তোলা...। শীত মানেই কলোনির ছেলেদের ছুটির দিনে (তখন ছিল রোববার) বড় মাঠে ক্রিকেট খেলা। পরে জেনেছি, সেই মাঠেই বসে ‘কার হাট’। গাড়ির বেচাকেনা! শীত মানেই সন্ধ্যায় মাঠে বাতি জ্বালিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলা। বছরের অন্য দিনগুলোতে ওরা খেলত ফুটবল। এমনকি ঝুমবৃষ্টিতে কাদা পানির মাখামাখিতে খেলেও ওদের কী সুখ।
এখন নতুন করে আমাদের বলতে হচ্ছে তরুণেরা যাতে ভুল পথে না যায়, তার জন্য খেলাধুলা আর সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়াতে হবে পাড়ায় পাড়ায়।
ছোট সেই কলোনির বাসায় আমরা সদস্য কিন্তু কম ছিলাম না। নানার অকাল অসুস্থতা আর মৃত্যুর কারণে বড় সন্তান হিসেবে আমার মা হয়ে গেলেন এগারো ভাইবোনের অভিভাবক। তাই আমরা দুই ভাইবোন বড় হয়েছি অনেক মানুষের মধ্যে। ছোট ভাই বলত, ‘আমরা চার ভাই, অমুক মামা, তমুক মামা...আর আমি।’ খাবার টেবিলে জায়গা হবে না, তাই মাদুর বিছিয়ে একসঙ্গে হইচই করে খাওয়া। শীত এলে সিনিয়র সিটিজেনদের আসনে বাড়তি যোগ হতো ভাঁজ করা কম্বল। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত খেয়ে গল্প করতে করতে ভাত শুকিয়ে যেত হাতেই। ঠান্ডা পানিতে হাত ধুতে যেতে আলসেমি, কোনো দিন কেউ একজন ছোট বাটিতে কুসুম গরম পানি এনে বাবার সামনে দিত, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রসিয়ে কোনো গল্প বলছিলেন, হাতটা গরম পানিতে ডুবিয়ে বড় সুখে বলতেন, আহ্!
এখন তো শহুরে জীবনে ৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটেও গিজার লাগানো। জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। কিন্তু শীতের রাতে খাবারের পর হঠাৎ গরম পানিতে হাত ধুতে পেরে বাবার সেই সুখানুভূতি, আহ্!
শীত মানেই হাঁস খাওয়া। সদস্যসংখ্যা বেশি। তাই একসঙ্গে কেনা হলো চারটি হাঁস। একদিন সকাল থেকেই হাঁস বাছা, রান্না চলছে, আজকে জমিয়ে খাওয়া হবে। দৈনন্দিন রান্নায় সবার পাতে সব ভালো টুকরা পড়ে না, আজ থাকবে বেশি বেশি। কেউ খাবে তো, কেউ খাবে না, তা হবে না, তা হবে না। কী যে হলো সেদিন, আমরাও খেতে বসলাম, দরজার কলবেলও বাজতে থাকল দফায় দফায়। একের পর এক মেহমান। বাবা-মায়ের কাজের সূত্রে ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে নানা অঙ্গনের মানুষের আগমন। কলোনির ছোট্ট বাসায় খাওয়ার সময় কেউ এলে কখনোই বলা হতো না ‘খাবেন?’ বরং সব সময় বলা হতো, ‘হাত ধুয়ে বসে পড়েন।’ সেদিনও তা-ই হলো। অবশেষে যা থাকল তা-ই ভাগাভাগি করে খেয়ে আমাদের কী সুখ!
এখন শহুরে জীবনে ড্রেসিং করা হাঁসের মাংস কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা কি কেউ ভাবতে পারি টেলিফোন না করে কারও বাড়ি যাওয়া? ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করে কে কার সুখ নষ্ট করে!
রুনা লায়লার গাওয়া বিখ্যাত সেই গান। সুখ তুমি কী বড় জানতে ইচ্ছে করে...। আসলেই জানতে ইচ্ছে করে। প্রথম আলোর ১৮ বছর পূর্তির আয়োজনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল নানান দেশের প্রখ্যাত সম্পাদক, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের। অনেকেই এসেছিলেন। প্রথম আলোর সাংবাদিক এবং দেশের অন্যান্য গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেছেন, মতবিনিময় করেছেন। সাংবাদিকতার মান, পেশাদারি, এ পেশার ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা হয়েছে বিস্তর। ঋত্বিক ঘটকের ছবি মেঘে ঢাকা তারার সেই দৃশ্যের মতো তাঁদের অনেক কথাই চেতনায় চাবুক মারছে। কিন্তু ভুটান থেকে আসা একটি পত্রিকার সম্পাদক এবং একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। আমন্ত্রণ পেয়ে তাঁরা দুজন জবাবে জানিয়েছিলেন, হ্যাঁ তাঁরা আসছেন, তবে তাঁদের দুজনের জন্য হোটেলে একটি কক্ষই যথেষ্ট, দুটির দরকার নেই। বিমানের সাধারণ টিকিট পাঠালেই চলবে, বিশেষ ক্লাসের টিকিট প্রয়োজন নেই!
আমরা অনেকেই জানি, ভুটান বিশ্বাস করে জিএনএইচ। অর্থাৎ গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস। দেশের মানুষ দিন শেষে সুখী কি না, সেটাই তাঁদের কাছে বড়। সেই দেশের দুজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক হয়তো তাই তাঁদের প্রকৃতি আর পরিবেশ থেকে এমন শিক্ষা পেয়েই সুখী।
আর কে যেন কৌতুক করে বলেছিল, একজন ভুটান থেকে ফিরে বড্ড অসুখী গলায় বলছিলেন, ‘ধুর, পাহাড়ের জ্বালায় কিছুই দেখতে পারলাম না!’
সুমনা শারমীন: সাংবাদিক।