প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ একটা গবেষণা করেছে, জরিপ করেছে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের ওপরে। বিষয়, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নারী প্রতিকৃতি। এতে উঠে এসেছে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নারীর খবর থাকে কম, সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ। কিন্তু সেই খবরেও অপরাধ, দুর্ঘটনা, বিনোদন ইত্যাদিই থাকে বেশি। তবে এই গবেষণায় একটা ফল এসেছে, যেটা আশার সঞ্চার করে। তা হলো, তরুণদের বেশির ভাগই তাদের খবরের নির্ভরযোগ্য সূত্র মনে করে সংবাদপত্রকে। ৫৪ দশমিক ৬ ভাগের নির্ভরতা সংবাদপত্র, ৪৪ দশমিক ৪ ভাগ ইন্টারনেটযুক্ত মোবাইল, ৩৭ দশমিক ৩ ভাগ কেব্লযুক্ত টেলিভিশনের ওপরে। ছাপা কাগজই এখনো তথ্যের নির্ভরযোগ্য উৎস, সেটা তরুণেরাও মান্য করে, ১৫ থেকে ২৪ বছরের ৮০৪ তরুণের ওপরে পরিচালিত জরিপ থেকে উঠে আসা এ তথ্য আমাদের আশ্বস্ত করে। আমরা শুনছি, ভারতের সংবাদপত্রগুলো একযোগে আওয়াজ তুলেছিল, প্রিন্ট ইজ প্রুফ। ছাপা জিনিস আপনার হাতে প্রমাণ হিসেবে থেকে যায়। সেই কারণে পেশাদার খবরের কাগজগুলো কোনো কিছু ছাপানোর আগে যাচাই-বাছাই করে। তাদের ভাইরাল হওয়ার প্রতিযোগিতা নেই, ব্রেকিং নিউজ দেওয়ারও দরকার পড়ে না; তারা সময় নিয়ে খবরটি বস্তুনিষ্ঠ বলে নিশ্চিত হলেই কেবল প্রকাশ করে থাকে।
২.
করোনাভাইরাসের খবর আপনি কোত্থেকে নেবেন? এটাও গুরুত্বপূর্ণ। এইখানে একটা সত্যিকারের মজার ঘটনা বলে নিই। আমাদের প্রথম আলো অফিসে একজন সরল–সোজা সাংবাদিক ছিলেন। বছর ১৯–২০ আগের ঘটনা। তখনো কম্পিউটার ব্যবহারে সবাই দক্ষ হয়ে ওঠেননি। তো সেই সাংবাদিক তাঁর কম্পিউটার অন করে দেখেন, কী যেন সমস্যা হচ্ছে। তিনি পাশেরজনকে বললেন, ‘আমার কম্পিউটারে এমন হচ্ছে কেন?’ উত্তর পান: ‘তোর কম্পিউটারে ভাইরাস ঢুকেছে। বাইরে থেকে এসেছিস তো। যা, হাত ধুয়ে আয়।’ সাংবাদিকটি হাত ধুয়ে আবার কম্পিউটারে বসেন। আবার একই সমস্যা। বলেন, ‘আমি তো হাত ধুয়ে এসেছি। তারপরও কম্পিউটার ঠিক হচ্ছে না কেন?’ ‘কীভাবে হাত ধুয়েছিস? সাবান–পানি দিয়ে ভালো করে হাত ধুতে হয়।’ সাংবাদিক কম্পিউটারের ভাইরাস সমস্যার জন্য নিজের হাত আবারও ধুতে গিয়েছিলেন। আজকে যখন আমরা করোনাভাইরাসের হুমকির মুখে পড়েছি, তখন আমাদের প্রথম কর্তব্য কিন্তু বারবার হাত ধোয়া, সাবান–পানি দিয়ে, এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেখানো পদ্ধতিতেই।
এরপর আপনাদের একটা সতর্কবার্তা দিচ্ছি। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল বলছে, আপনি করোনাভাইরাসের খবর কোথা থেকে নিচ্ছেন, এ ব্যাপারেও সতর্ক হোন। তারা বলছে, করোনাভাইরাস নিয়ে মিথ্যা খবর ছড়ানো হচ্ছে, ফেক নিউজে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে ফেসবুক। যেমন আইসক্রিম বা মিল্ক শেক খেলে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে, এটা ঠিক নয়। যেমন ভিটামিন সি খেলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমবে, এটাও ঠিক নয়। কোনো তেল মাখলে, কিংবা কোনো ওষুধেই এটা প্রতিরোধ করা যাবে—তা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। হার্ভার্ড বলছে, আমেরিকার স্বাস্থ্য দপ্তর, ব্রিটিশ স্বাস্থ্য দপ্তর, এদের কথা বিশ্বাস করুন, তা না হলে যে খবরের কাগজ সংবাদের উৎস হিসেবে দায়িত্ববান, বিশ্বাসযোগ্য, পেশাদার, তাদের কথাই শুনুন, যেমন নিউইয়র্ক টাইমস, কিংবা ওয়াশিংটন পোস্ট। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের তরুণেরা যেমন জানে, খবরের জন্য কোন মাধ্যমে যেতে হবে, তেমনি আপনি-আমি জানি, কোন কাগজটা বা কোন কাগজের অনলাইনটা পড়তে হবে। তা না হলে আপনি এই লেখাটা পড়ছেন কেন?
৩.
মাগুরার একটি আদালত ৯ তরুণকে তাদের অপরাধের শাস্তি হিসেবে এক বছর সমাজকল্যাণ কর্মকর্তার সঙ্গে প্রবেশনে থাকা এবং চারটি বই পড়া, দুটি ছবি দেখা এবং ৫টি করে গাছ লাগানোর আদেশ দিয়েছেন। (প্রথম আলো, ১২ মার্চ ২০২০)। আমাদের মনে পড়ে, আমেরিকার ভার্জিনিয়ার এক আদালত ৫ তরুণকে একই রকম শাস্তি দিয়েছিলেন ২০১৮ সালে। তারা একটা ঐতিহাসিক স্থানে শ্বেতাঙ্গ-আধিপত্যের চিহ্ন এঁকে অপরাধ করেছিল, শাস্তি হিসেবে তাদের বর্ণবাদের ভয়াবহতা জানতে পারা যায়, এ রকম চারটি বই পড়তে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের মাগুরার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তফা কামালও বইয়ের নাম, ছবির নাম বলে দিয়েছেন।
খবরটা অভিনব, তবে স্বস্তিদায়ক। শাস্তিতে স্বস্তি!
৪.
আমরা আমাদের তরুণ প্রজন্মকে কাগজের বই, কাগজের পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়ার পরামর্শ দিই। ভালো সিনেমা দেখতে বলি। আমরা যখন একটা উপন্যাস পড়ি, তখন নিজেকে ভুলে যাই, অনাত্মীয় চরিত্রের সঙ্গে তাদের জগতে কয়েক দিন বসবাস করি। এটা আমাদের শান্ত করে। শান্তি দেয়। কল্পনা বাড়ায়, সমবেদনা বাড়ায়। ভালো চলচ্চিত্রও একই কাজ করে। একই রকমভাবে আমাদের চিত্তকে উপশমিত করে প্রার্থনা, শান্ত ধীর সংগীত।
৫.
করোনাভাইরাস এখন বৈশ্বিক মহামারি—বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। দুঃসংবাদ। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তিনজনের দুজন সুস্থ হয়ে উঠছেন। সুখবর। অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। দুঃসংবাদ। এটা যে হবেই, তা সহজেই অনুমেয়। করোনাভাইরাসে পৃথিবীতে যত মানুষ মারা যাবে, তার চেয়ে ঢের বেশি ক্ষতি হবে এর আতঙ্কের কারণে। চীন থেকে আমদানি-রপ্তানি প্রায় বন্ধ, বহু দেশে অন্য দেশের মানুষ ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না, এয়ারলাইনসগুলো ফ্লাইট বন্ধ করে দিচ্ছে। খারাপ সময় আসছে। যেকোনো দুর্যোগ থেকেই কোনো না কোনো সুযোগও আসে। সেটাও হয়তো আসবে। দেখা যাক।
৬.
আইনের শাসনের সূচকে বাংলাদেশ পিছিয়েছে। বাংলাদেশ ১২৬টি দেশের মধ্যে ছিল ১১২-তে, এবার ১২৮টি দেশের মধ্যে এসেছে ১১৫–তে। অবশ্য খেয়াল করলে দেখবেন, এগোয়নি, পিছায়ওনি, আমরা শেষের দিক ১৫ নম্বরে ছিলাম, এবারেও শেষের দিক থেকে ১৫ নম্বরেই আছি। আমাদের বোধ হয় একটু লজ্জা হওয়া উচিত ১২৮টি দেশের মধ্যে ১১৫তম স্থান অধিকার করায়।
৭.
১৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের ১০০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এ উপলক্ষে জন্মশতবর্ষের ক্ষণগণনা চলছে। আর মাত্র কয়েক দিন। কথা ছিল, খুব বড় একটা অনুষ্ঠান হবে জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে, লক্ষাধিক মানুষ উপস্থিত থাকবেন। ৮ মার্চ জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটির বৈঠক ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে। সেখানে গিয়ে শোনা গেল, প্রধানমন্ত্রী সন্ধ্যায় গণভবনে কথা বলতে চান। গণভবনে যাওয়া গেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা বললেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনগণের নেতা। জনগণের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি নিয়ে কিছু করা হলে মনে হয় না বঙ্গবন্ধু নিজে খুশি হবেন। জনসমাগম না করে যা করা যায়, করুন। শেখ হাসিনা বললেন, মুজিব বর্ষে বরং একজন মানুষও যাতে গৃহহীন না থাকে, ভূমিহীন না থাকে, সেই ব্যাপারে কী করা যায়, তা করতে হবে। এর আগেও প্রধানমন্ত্রী মুজিব বর্ষে বাড়াবাড়ি না করার কথা বলেছেন। ম্যুরাল না করে জনগণের কল্যাণমূলক কাজ করার কথা বলেছেন।
আজ ১৩ মার্চ। আর তিন দিন পরেই ১৭ মার্চ। এমন দিনে বারবার মনে পড়ে নির্মলেন্দু গুণের এই লাইনগুলো:
সমবেত সকলের মতো আমিও গোলাপ ফুল খুব ভালোবাসি,
রেসকোর্স পার হয়ে যেতে সেই সব গোলাপের একটি গোলাপ
গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি।
আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।
...
...
আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি,
আমি আমার ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিলাম।
আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক