সীমান্তে হত্যা ও দ্বিপক্ষীয় সমস্যা

.

সংবাদপত্রের পাতায় প্রায়ই খবর আসে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হওয়ার। খবর খুবই ছোট হয়। এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও বিরল ক্ষেত্র ব্যতীত তেমন একটা লক্ষণীয় হয় না। নিহত ব্যক্তির পরিবার-পরিজনেরও কেউ খোঁজ নেয় না। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি একটি প্রথাগত প্রতিবাদ পাঠায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও মোটামুটি নীরবই থাকে। ভারতের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজিবি কিংবা জেলা প্রশাসক সম্মেলনে মাঝেমধ্যে বিষয়টি আলোচিত হয়। রাজনৈতিক দলগুলো অনেক বিষয় নিয়ে মাঝেমধ্যে দেশ উত্তাল করলেও এ ধরনের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা থাকছে তাদের দৃষ্টিসীমার আড়ালে। এমনকি তাদের সংশ্লিষ্ট জেলা-উপজেলা শাখাগুলোও বিষয়টি এড়িয়ে যেতেই পছন্দ করছে। স্থানীয় সামাজিক সংগঠনগুলোও নীরব। হয়তো ধরে নিয়েছে এটাই নিয়ম। অথবা প্রতিবাদে লাভ কী?
জানা যায়, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার একজন রাখাল মারা গেছে গরু চোরাচালান করতে গিয়ে। সে মাসেই দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলায় বাংলাদেশের সীমান্তের ভেতরে একজন শ্রমিক গুলিতে নিহত হয়। ঝিনাইদহ জেলার সীমান্তেও গুলিতে নিহত হয় দুজন। সবগুলোই বিএসএফের গুলিতে। খবরের উৎস সংবাদপত্র। বিরামপুরের নিহত শ্রমিকের কী অপরাধ, জানা যায় না। সে সীমান্তও পাড়ি দেয়নি। অন্য তিনজন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চোরাচালান করতে গিয়ে প্রাণ হারায়। চোরাচালান ও পাসপোর্ট ভিসা ব্যতীত সীমান্ত পাড়ি দেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। তবে মৃত্যুদণ্ড নয়। আর দণ্ড আরোপের কোনো ক্ষমতা কোনো দেশই তার সীমান্তরক্ষীকে দেয় না। এর জন্য উপযুক্ত আদালত রয়েছেন। এ ক্ষেত্রে থাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ।
প্রশ্ন আসবে, এসব ঘটনার শিকার কারা? কেন হয় এমনটা? ঘটনার শিকার নিতান্তই হতদরিদ্র শ্রেণির লোক। তাদের কেউ কেউ চোরাচালানি চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। মূলত তারা ওপার থেকে নিয়ে আসা গরুর রাখাল কিংবা অন্য কোনো মালামাল বহনের শ্রমিক। এ চক্রের যারা মূল হোতা, তারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা যখন সীমান্ত পাড়ি দেয়, তখন ক্ষেত্রবিশেষে উভয় দিকেই রক্ষীরা কর্তৃক সমাদৃত হয় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। চোরাচালানি ছাড়া এপার-ওপারে রয়েছে অনেক সামাজিক যোগাযোগ। তারাও ক্ষেত্রবিশেষে এ ধরনের আসা-যাওয়া করে। তাদেরও কখনোবা ঘটে এরূপ করুণ পরিণতি। ২০১১ সালে ফেলানি নামের এক কিশোরী কন্যার নির্মম হত্যা বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। সংশ্লিষ্ট বিএসএফ সদস্যের বিচার হয়েছিল কোর্ট মার্শালে। বেকসুর খালাস পেয়েছে সে অভিযুক্ত। আবার তোলপাড় শুরু হলে পুনর্বিচারের আদেশ হয়। তবে একই আদালতে। শুনানির একটি তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল। এরপর থেমে আছে সে প্রক্রিয়াও।
কেন এমনটা হয়, এটা বিশ্লেষণ করলে যেতে হবে ১৯৪৭ সালে। দেশ বিভাগ হলো। সে বিভক্তি সীমারেখা যে বা যাঁরা করেছিলেন, তাঁরা আর যা হোক অনেক ক্ষেত্রে বিসর্জন দিয়েছিলেন বাস্তবতাকে। একই দেশ বা প্রদেশ শুধু ভাগ হয়নি। ভাগ হয়েছে জেলা, মহকুমা, থানা এমনকি বাড়ি। একই বাড়ির বাসগৃহ আর পুকুর সীমান্তের এপার-ওপারে পড়েছে—এমন ঘটনা বিরল নয়। তা ছাড়া এ সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো ঘনবসতিপূর্ণ এবং উর্বর। তাই নিজ দেশের সীমারেখার মধ্যেই কৃষক চাষ করেন সীমান্ত পিলারের কাছাকাছি পর্যন্ত। এ সীমান্ত রেখার দৈর্ঘ্যও বিশাল। ৪০৯৬ কিলোমিটার। পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম স্থলসীমান্ত বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তরেখা। ভারতের পাঁচটি রাজ্য এ সীমারেখায় রয়েছে। এগুলো হচ্ছে আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মেঘালয় আর পশ্চিমবঙ্গ। আমাদের দুর্ভাগ্য, এ জাতীয় ঘটনাগুলো প্রায় সবই পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে। অবশ্য উল্লেখ্য যে বিএসএফ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন, রাজ্য সরকারের নয়। এ সীমান্তরেখার এপার-ওপার কিছু লোকজন চলে পাসপোর্ট–ভিসা ব্যতিরেকে। চোরাচালান হয় স্বর্ণ, ইলিশ থেকে ফেনসিডিল আর গরুসহ অনেক কিছু। সীমান্তে মাঝেমধ্যে এ ধরনের হত্যার ঘটনা আমাদের বিচলিত করে। বিচলিত করার কথা যেকোনো বিবেকবান ভারতীয় নাগরিককেও। সেখানকার কোনো কোনো মানবাধিকার সংগঠন এসব বিষয়ে প্রতিবাদী ভূমিকায় আছে। তবে বারবার বিভিন্ন পর্যায়ের আশ্বাস সত্ত্বেও ঘটনাগুলো ঘটেই চলছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নামের একটি সংস্থার হিসাবে একুশ শতকের প্রথম দশকে এভাবে প্রাণ হারিয়েছে সহস্রাধিক বাংলাদেশি। এ বিষয়ে বিএসএফ বলে থাকে, বেআইনি অনুপ্রবেশ এবং আন্তসীমান্ত সন্ত্রাস দমনে তারা কঠোর পন্থা নিয়ে থাকে। আন্তসীমান্ত সন্ত্রাস প্রশ্নে ভারতের উদ্বেগ প্রশমনে বাংলাদেশ সরকার ২০০৯ সাল থেকে ব্যাপক কার্যক্রম নিয়েছে। ফলে তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলো অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। সুতরাং এ যুক্তিতে গুলি চালানোর বিষয়টি এখন আদৌ প্রাসঙ্গিক নয়। তা ছাড়া মূলত গুলি চলে পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের দিক থেকে। পাহাড়ি রাজ্যগুলোর দিক থেকে নয়। এখন আসে বেআইনি অনুপ্রবেশের প্রশ্ন। বাংলাদেশ থেকে ভারতে বেআইনি অনুপ্রবেশের অভিযোগ ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রায়ই করে থাকে। অভিযোগটির সঙ্গে বাংলাদেশ একমত নয়। তবুও যদি অনুপ্রবেশকারী বিএসএফের নজরে বা আওতায় আসে, তাদের বিতাড়িত করা কিংবা ধরে নিয়ে ভারতীয় আদালতে বিচারের মুখোমুখি করারই কথা। গুলির প্রশ্ন তো এখানে আসে না।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ প্রায়ই আমাদের আশ্বস্ত করে সীমান্তে মারণাস্ত্র ব্যবহারের পরিমাণ তারা কমিয়ে আনবে। তা হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে বিএসএফ এখন পরিহার করছে। তবে হত্যা কিন্তু বন্ধ হয়নি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, ২০১৪ সালে জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়কালে সীমান্তে বিএসএফের হাতে ২৫ ব্যক্তি নিহত হয়। এর মধ্যে গুলিতে ১১ আর দৈহিক নির্যাতনে ১৪ জন। অপহৃত হয়েছে ৭৮ জন। তাদের মধ্য থেকে ২২ জনকে ফেরত পাওয়া গেছে। বাকি ৫৬ জন নিখোঁজ। তাদের হয়তোবা কেউ ভারতীয় জেলে। কারও বা লাশ ভেসে গেছে নদীতে। সুতরাং আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার কমালেই যে সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে, এমন নয়। সশস্ত্র দুষ্কৃতকারী ছাড়া অন্য কারও প্রতি বিএসএফের গুলি না চালানো নিশ্চিত করতে হবে ভারত সরকারকে।
বাংলাদেশ ভারতের বৃহত্তম প্রতিবেশী। এ দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে তাদের সর্বাত্মক সহায়তা সবাই কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে। সে দেশটি একটি উদীয়মান পরাশক্তিও বটে। অর্থনৈতিক ও সামরিক উভয় বিবেচনাতেই এমনটা লক্ষণীয় হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বসমাজে নেতৃত্বের আসনে যাওয়ার জন্য তার প্রতিবেশীদের মধ্যে আস্থার ভাব সৃষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র। ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরের সহায়ক তাদের অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতায়। বাংলাদেশের সঙ্গে আস্থার ভাব সৃষ্টি করতে বিএসএফের আচরণ নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, এটা ভারতকে বুঝতে হবে। দুই দেশের মাঝে সহযোগিতার ক্ষেত্রকে ক্রমান্বয়ে প্রসারের জন্য উভয় পক্ষ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। নিজ গাড়ি নিয়ে এক দেশ থেকে অপর দেশে যাওয়ার ব্যবস্থাও প্রায় পাকা হওয়ার পথে। সে ক্ষেত্রে সীমান্তের এ হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী কেন অমানবিক আচরণের শিকার হতে থাকবে, তা বোধগম্য নয়। সবাই তো আশা করে, সহসাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো সার্কভুক্ত দেশগুলোর মাঝে চলাচলের জন্য পাসপোর্ট–ভিসা উঠে যাবে। তবে উল্টো পথে চলা যাত্রী গন্তব্যে পৌঁছাবে, এমনটা আশা করা অসংগত।
সেটা যা হোক, সীমান্তের এসব মানুষের প্রতি বিএসএফের নিষ্ঠুর আচরণ বন্ধ করতে ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা দরকার জোরদারভাবে। দুই দেশের বিরাজমান সমস্যাগুলোর মাঝে এটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কাজটি করতে হবে আমাদের সরকারকেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিষয়টির প্রতি জানানো দরকার সমর্থন। মানবাধিকার নিয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের আরও নিবিড় ও বস্তুনিষ্ঠভাবে এ ঘটনাগুলো তুলে ধরা দরকার। তদুপরি, ভারতের এ ধরনের সংগঠনগুলোর নজরেও তাঁরা অব্যাহতভাবে আনতে পারেন এসব বিষয়া। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি অনুকূল হতে পারে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com