উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যবর্তী সীমান্তরেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সামরিক উপস্থিতি থাকা সীমান্তগুলোর একটি। এখানে রাতদিন ২৪ ঘণ্টাই দুই দেশের সেনাবাহিনী যুদ্ধের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে মোতায়েন থাকে। অসংখ্য স্থলমাইন, সশস্ত্র সীমান্তরক্ষী এবং বৈদ্যুতিক তারের বেড়া দিয়ে কোরিয়ান ডিমিলিটারাইজড্ জোন বা ডিএমজেড (দুই দেশের সীমান্তরেখার মাঝখানের ফাঁকা জায়গা, যেখানে কোনো পক্ষেরই সামরিক উপস্থিতি থাকে না) ঘেরা।
কিছুদিন পরপরই উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী সেখান থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে, দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে ঢুকে পড়ে তল্লাশিও চালায়। উত্তরকে ভয়ভীতি দেখাতে দক্ষিণ সাধারণত এ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে না। তারা যে অস্ত্রটি ব্যবহার করে সেটি অনন্য। সেই অস্ত্রের নাম ‘কে-পপ’।
‘কে-পপ’ হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার নিজস্ব ঘরানার একধরনের পপ সংগীত। ২৪০ কিলোমিটার লম্বা বাফার জোনে উঁচু উঁচু টাওয়ারে উভয় কোরিয়াই পরস্পরের দিকে ফিট করে অসংখ্য মাইক লাগিয়ে রেখেছে। পরিস্থিতি উত্তেজনাকর হলে একে অন্যের বিরুদ্ধে সেই মাইকে প্রচার চালায়। দক্ষিণ কোরিয়া সাধারণত সেই মাইকে ‘কে-পপ’ গান চালিয়ে দেয়। উত্তরের চেয়ে দক্ষিণের লাউড স্পিকারগুলো অনেক বেশি উন্নত। এই মাইকের শব্দ দিনের বেলা ১০ কিলোমিটার এবং রাতে ২৪ কিলোমিটার দূর থেকে শোনা যায়।
২০১৬ সালে উত্তর কোরিয়া হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বলে দাবি করার পর দক্ষিণ কোরিয়ার লাউড স্পিকারগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। ওই সময় দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ঘোষণা করেন, তাঁরা সাম্প্রতিক সবচেয়ে হিট পপ গান চালাবেন। সে ঘোষণা অনুযায়ী বিগ ব্যাং ব্যান্ডের ‘বাং বাং বাং’ এবং নারীদের ব্যান্ড আপিঙ্ক-এর ‘লেট আস জাস্ট লাভ’ গানসহ অনেক পপ গান বাজানো হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, উত্তর কোরিয়ার সাধারণ মানুষকে ত্যক্ত করার উদ্দেশ্যে নয়, আদতে সীমান্তে তৎপর থাকা উত্তর কোরিয়ার বদ শক্তিগুলোকে সমুচিত জবাব দিতে তারা এই গান চালাচ্ছে। উত্তর কোরিয়া অবশ্য এটিকে ‘যুদ্ধের তৎপরতা’ আখ্যা দিয়ে স্পিকারগুলো কামানের গোলায় উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল।
আমার নতুন বই নিউ কিংস অব দ্য ওয়ার্ল্ড লেখার সময় এ–সংক্রান্ত গবেষণার কাজে গত গ্রীষ্মে দক্ষিণ কোরিয়া গিয়েছিলাম। ওই সময় ডিএমজেড পরিদর্শন করতে যাই। আমি গিয়েছিলাম ১২ জুন সিঙ্গাপুরে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং কিম জং–উনের ঐতিহাসিক বৈঠকের মাত্র কয়েক দিন আগে। ওই সময়টাতে দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তবর্তী ডোরা অবজারভেটরি বেশ শান্তই ছিল। সেখানে দেখলাম শান্তশিষ্ট পরিবেশে সীমান্তের এপার থেকে স্কুলপড়ুয়া বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে। কেউ কেউ বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে উত্তর কোরিয়ার দিকে চেয়ে আছে। তবে সবার মধ্যে একধরনের উৎকণ্ঠা আছে।
আমার দেশ পাকিস্তান ও পাশের দেশ ভারতের মধ্যবর্তী ওয়াগা সীমান্তে প্রতিদিন দুই দেশের সেনারা বুট দাপিয়ে কুচকাওয়াজ করে। সেখানে বিকেলে দুই দেশের নাগরিকেরা নিজ নিজ সীমান্তে বসতে পারে। এক দেশের নাগরিকদের অন্য দেশের নাগরিকেরা দেখতে পারে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে যাওয়া খাইবার গিরিপথ আরেকটি রহস্যময় করিডর, যেখানে আপনি হাতে তৈরি পিস্তল কিনতে পারবেন। গোটা খাইবার গিরিপথে গানের মতো সূক্ষ্ম শিল্প আপনি পাবেন না।
দক্ষিণ কোরিয়ায় গেলে ডিএমজেড দেখার প্রতি পর্যটকদের বিশেষ আগ্রহ থাকে। উত্তর কোরিয়া এই জোনে কাউকে ঢুকতে না দিলেও দক্ষিণ কোরিয়া যেতে দেয়। ৫০ ডলার খরচ করলেই গাইড আপনাকে শূন্যরেখার কাছে নিয়ে যাবে। আমাদের গাইড ছিলেন সু নামের একজন নারী। তিনি আমাদের দেখাচ্ছিলেন, নদীর ওপারেই উত্তর কোরিয়া। নদীর এ পারে বহু গাছগাছালি কিন্তু উত্তর কোরিয়ার পারে গাছ বলতে কিছুই নেই।
ভারত ও পাকিস্তানের মতো এই দুই দেশের জনগণের অনেক মিল আছে। তারা একই ভাষায় কথা বলে। একই ধরনের পোশাক পরে। একই সংস্কৃতি তাদের। কিন্তু রাজনীতির কোপানলে পড়ে এক সংস্কৃতির মানুষগুলো বিভক্ত হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই দুই দেশের মধ্যে মৈত্রীর যে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, তা এগিয়ে নিতে সব পক্ষের এগিয়ে আসা দরকার।
উভয় দেশের সীমান্তে টাওয়ারের মতো উঁচুতে বসানো লাউড স্পিকারগুলো যদি বিদ্বেষ ছড়ানোর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত না হয়ে মৈত্রীর সংগীত বাজাতে থাকে, তাহলে বিভক্ত কোরিয়ার মানুষ আবার এক হতে পারে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। আল–জাজিরা থেকে নেওয়া
ফাতিমা ভুট্টো: পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর পৌত্রী ও লেখক