মানবসভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতে পারে যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ ছিল তারই অশুভ সূচনা।
রাশিয়া হামলা চালানোর আগে দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ৪ মার্চ একটি দীর্ঘ বৈঠক করেছিলেন।
বৈঠক শেষে এ দুজন ঘনিষ্ঠ অংশীদারি ঘোষণা করে অতি সতর্কভাবে তৈরি করা ৫০০ পৃষ্ঠার একটি খসড়া প্রকাশ করেছিলেন। এ খসড়া নথিটিকে যেকোনো চুক্তির চেয়ে শক্তিশালী মনে করা যেতে পারে। আন্দাজ করি, এ খসড়া তৈরির অনেক আগে থেকেই এ বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বিশদ আলোচনা হয়েছে।
আমি আশ্চর্য হয়েছি এটি দেখে যে সি চিন পিং ইউক্রেনে হামলা চালানোর বিষয়ে পুতিনকে যা ইচ্ছা তাই করার বিষয়ে সমর্থনসূচক বার্তা দিয়েছেন। কার্যত একনায়ক এই দুজনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে অদ্ভুত কিছু সাযুজ্য লক্ষ করা যাচ্ছে। সি যত দিন বাঁচবেন, তত দিন তিনি চীনের শাসক হিসেবে থাকবেন—এ বিষয়কে অনুমোদন দিয়ে এ বছরের শেষেই পাকাপাকিভাবে আইন পাস হবে। ধারণা করা হচ্ছে, সেটি নিশ্চিত করার বিষয়টি এখন নিছক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। এ আইন পাসে যে নড়চড় হবে না, সে বিষয়ে সি চিন পিং নিজেও শতভাগ আত্মপ্রত্যয়ী আছেন।
ধীর ধীরে সব ক্ষমতা নিজের হাতের মুঠোয় এনে সি সতর্কতার সঙ্গে এখন এমন একটি অবস্থা ও দৃশ্যকল্প রচনা করেছেন, যার মাধ্যমে তিনি মাও সে–তুং এবং দেং জিয়াওপিংয়ের স্তরে উন্নীত হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। সি চিন পিংয়ের সমর্থন পাওয়ার পর পুতিন অবিশ্বাস্য নৃশংসতার সঙ্গে তাঁর আজন্মলালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। ৭০ বছর বয়সের কাছাকাছি এসে পুতিন হয়তো মনে করছেন, যদি তিনি রাশিয়ার ইতিহাসে তাঁর অমোচনীয় চিহ্ন রেখে যেতে চান, তাহলে সেই সময় ‘হয় এখন, নয়তো কখনোই নয়’।
সমস্যা হলো, বিশ্বের বুকে রাশিয়ার ভূমিকা নিয়ে পুতিনের লালিত অভিলাষ অত্যন্ত বিকৃত। তাঁর কাজকারবার দেখে মনে হয়, তিনি বিশ্বাস করেন, রাশিয়ার জনগণের একজন ‘জার’ দরকার, যাঁকে তারা অন্ধবিশ্বাসে অনুসরণ করবে। পুতিনের এ ধারণা একটি গণতন্ত্রভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ধারণার সম্পূর্ণ উল্টো। এটি এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি, যা রাশিয়ার ‘আত্মা’কে নষ্ট করে দিচ্ছে।
আমার শৈশবে, ১৯৪৫ সালে যখন রাশিয়ার বাহিনী হাঙ্গেরি দখল করে, তখন রাশিয়ার সেনাদের সঙ্গে আমার অনেকবার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আমি শুনেছিলাম, আপনি যদি তাদের (রুশ সেনাদের) কাছে সাহায্য চান, তাহলে তারা তাদের শেষ রুটি পর্যন্ত আপনার সঙ্গে ভাগাভাগি করে খাবে। যাহোক, পরবর্তীতে, ১৯৮০–এর দশকের গোড়ায় আমি যাকে রাজনৈতিক জনহিতৈষী কাজ বলে মনে করি, সে কাজগুলো করতে শুরু করি।
আমি পুতিনকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তবে আমি তাঁর উত্থান খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাঁর নির্মমতা সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল। তিনি চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিলেন। আর এখন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভকে একইভাবে ধ্বংস করে যাচ্ছেন। পুতিন একজন ধূর্ত কেজিবি অপারেটর ছিলেন। সেই চরিত্রকেই তিনি এত দিন ধারণ করেছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি তিনি বদলে গেছেন বলে মনে হচ্ছে। ক্ষমতাকে সংহত করে একটা জায়গায় থিতু হওয়ার পর তিনি বাস্তবতা থেকে দূরে সরে গেছেন বলে মনে হচ্ছে।
প্রথমে আমি আমার জন্মস্থান হাঙ্গেরিতে একটি সংগঠন গড়ে তুলি এবং এরপর আমি সক্রিয়ভাবে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের বিচ্ছিন্নতার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। ১৯৮৫ সালে যখন মিখাইল গর্বাচেভ ক্ষমতায় আসেন, তখন থেকেই সোভিয়েতের ভাঙন শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমিই রাশিয়ায় প্রথম একটি ফাউন্ডেশন গড়েছি এবং তারপর সোভিয়েতের উত্তরাধিকারী রাষ্ট্রগুলোতে একই কাজ করেছি।
আমি পুতিনকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তবে আমি তাঁর উত্থান খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাঁর নির্মমতা সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল। তিনি চেচনিয়ার রাজধানী গ্রোজনিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছিলেন। আর এখন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভকে একইভাবে ধ্বংস করে যাচ্ছেন। পুতিন একজন ধূর্ত কেজিবি অপারেটর ছিলেন। সেই চরিত্রকেই তিনি এত দিন ধারণ করেছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি তিনি বদলে গেছেন বলে মনে হচ্ছে। ক্ষমতাকে সংহত করে একটা জায়গায় থিতু হওয়ার পর তিনি বাস্তবতা থেকে দূরে সরে গেছেন বলে মনে হচ্ছে।
২০২১ সালের জুলাই মাসে পুতিন একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে তিনি যুক্তি দিয়ে দাবি করেছিলেন, রাশিয়ান এবং ইউক্রেনীয়রা আসলে একই মানুষ। তাঁর মতে, ইউক্রেনীয়রা নব্য নাৎসি আন্দোলনকারীদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছে। তাঁর যুক্তির প্রথম অংশটি ঐতিহাসিক ন্যায্যতার বাইরে নয়, কারণ কিয়েভ ছিল রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চের মূল তীর্থভূমি। কিন্তু দ্বিতীয় অংশে পুতিন বিভ্রান্ত হয়েছেন। তাঁর আরও ভালো জানা উচিত ছিল যে ২০১৪ সালে ইউরোমাইডান বিক্ষোভের সময় অনেক ইউক্রেনীয় বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছিল। সে কথা তিনি ভুলে গিয়ে ইউক্রেনের বেসামরিক লোকের ওপর এখন ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
পুতিন ভেবেছিলেন সহজেই ইউক্রেন দখল হয়ে যাবে। কিন্তু সেখানকার মানুষ তীব্রভাবে প্রতিরোধ করছে। এটিই পুতিনকে আরও ক্ষুব্ধ ও নৃশংস করে তুলেছে। তিনি এখন সেখানকার মানুষ মারতে বাছবিচার করছেন না। তিনি আক্ষরিক অর্থেই অপ্রকৃতিস্থদের মতো আচরণ করছেন। অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে, তাতে রাশিয়া এ যুদ্ধে হেরে যেতে পারে বলে মনে করাটা খুব অযৌক্তিক হবে না। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়ই ইউক্রেনে প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র পাঠাচ্ছে। পুতিনের এ আগ্রাসন ইইউকে বিস্ময়করভাবে ঐক্যবদ্ধ করছে। ফলে দাবার চাল উল্টে যেতে পারে।
এদিকে সি চিন পিং মনে হয় বুঝতে পেরেছেন, পুতিন দুর্বৃত্ত হয়ে গেছেন। 8 মার্চ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই রাশিয়া ও চীনের বন্ধুত্ব ‘পাহাড়ের মতো দৃঢ়’ আছে বলে মন্তব্য করার পরের দিনই সি চিন পিং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ এবং জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজকে বলেছেন, তিনি তাঁদের শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছেন। মানবিক সংকট এড়াতে তিনি যুদ্ধে সর্বোচ্চ সংযমও আশা করেছেন। অর্থাৎ পুতিনকে তিনি নমনীয় হওয়ার একধরনের পরোক্ষ পরামর্শ দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে।
পুতিন যে সি চিন পিংয়ের ইচ্ছাকে মেনে নেবেন, তা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। এখনো মনে হচ্ছে পুতিন আরও ভয়ংকর হয়ে উঠবেন, যা সত্যি সত্যি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে পরিস্থিতিকে নিয়ে যেতে পারি। এ ক্ষেত্রে আমরা কেবল আশা করতে পারি, পুতিন এবং সি আমাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করার আগেই তাঁদের উৎখাত করা হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
জর্জ সরোস হাঙ্গেরিয়ান বংশোদ্ভূত মার্কিন ধনকুবের, যিনি নিজের প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি ডলার ব্যয়ে সেবা প্রতিষ্ঠান ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনস নামের একটি সংস্থা গড়েছেন। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান