সিসা একটি নীরব ঘাতক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সিসাকে জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম ক্ষতিকারক রাসায়নিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশনের (আইএইচএমই) ধারণামতে, সিসাদূষণের কারণে বিশ্বের প্রায় ১০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যু ঘটেছে এবং শুধু ২০১৯ সালেই প্রায় ২ কোটি বছরের বেশি সুস্থ জীবনকাল ব্যাহত হয়েছে। নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে তুলনামূলকভাবে মৃত্যু ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি।
বিষাক্ত ধাতু সিসা বেশ সহজলভ্য এবং হাজার বছর ধরে বিভিন্নভাবে ব্যবহারের ফলে এটি পরিবেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন উপায়ে মানুষ সিসার সংস্পর্শে আসে। এর কয়েকটি নমুনার কথা আমরা বলতে পারি।
১. সিসামিশ্রিত রং বা লেড পেইন্ট: যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৮ সালে আবাসস্থলে সিসামিশ্রিত রঙের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। অনেক দেশ রঙে সিসার পরিমাণ কমানোর জন্য আইন প্রণয়ন করেছে। কিন্তু ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্যভুক্ত অন্তত ৭৬টি দেশে সিসামিশ্রিত রঙের উৎপাদন, আমদানি, বিক্রয় এবং ব্যবহারের বিষয়ে কোনো রকম নিয়ন্ত্রণ ও বাধ্যবাধকতা নেই।
২. সিসা পুনঃ চক্রায়ন: স্বল্পমূল্যের ব্যাটারিচালিত মোটরযানের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে এলআইসিতে লেড-অ্যাসিড ব্যাটারির ব্যবহার মাত্রাতিরিক্তভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় সব লেড-অ্যাসিড ব্যাটারিই পুরোনো ব্যাটারি পুনঃ চক্রায়ন এবং ফেলে দেওয়া ধাতু থেকে তৈরি করা হয়। ব্যাটারিতে ব্যবহৃত সিসার প্রায় পুরোটাই পুরোনো হওয়ার পরও তা পুনরুদ্ধার এবং পুনঃ চক্রায়ন করা সম্ভব। পুরোনো ব্যাটারিগুলোকে গলিয়ে অশোধিত সিসা পাওয়া যায়, যা নতুন ব্যাটারি তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। উন্নত দেশের গাড়িতে ব্যবহৃত ব্যাটারিসহ ই-বর্জ্যগুলো অনুন্নত দেশগুলোয় রপ্তানি করে দেওয়া হয়, যার বেশির ভাগই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকার অপ্রাতিষ্ঠানিক সিসা কারখানায় জায়গা করে নেয়, যা সেই অঞ্চলকে অতিরিক্ত সিসাদূষণের ঝুঁকিতে ফেলে দেয়।
৩. মাটি এবং ধাতুর তৈজসপত্র: একদিকে অ্যালুমিনিয়ামের তৈজসপত্রের উচ্চ চাহিদা আর অন্যদিকে পুনঃ চক্রায়ন বাজার থেকে বিপুল পরিমাণে এর সরবরাহের কারণে বর্তমান পৃথিবীতে বিশাল এক অ্যালুমিনিয়াম শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। মৃৎশিল্পেও তৈজসপত্র চকচকে করার কাজে সিসার প্রলেপ ব্যবহার করা হয়।
৪. মসলা: লেড ক্রোমেট হচ্ছে বাজারে সচরাচর পাওয়া যায় এমন একটি সস্তা রাসায়নিক হলুদ রং, যা নিয়মিত ঘরোয়া খাবার তৈরিতে ব্যবহারের ফলে তা সিসা দ্বারা দূষিত হচ্ছে। হলুদের ব্যবসায়ীরা যে নিম্নমানের শিকড় বিক্রি করে এবং সিসামিশ্রিত খারাপ মানের হলুদ গুঁড়া বাজারে এনে নিজেদের লাভের পাল্লা ভারী করে, এ নিয়ে কৃষকেরা সিসাদূষণের পরিণাম নিয়ে বৈশ্বিক আলোচনা শুরু হওয়ার অনেক আগেই এর বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। বিষাক্ত সিসা কেবল নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর কারখানায় ব্যবহার করার জন্য অনুমোদিত।
গর্ভাবস্থায় সিসার সংস্পর্শে এলে শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং তার দৃষ্টি, শ্রবণ, এবং শিখন বিকাশগত সমস্যা থেকে শুরু করে আচরণগত সমস্যা তৈরি করতে পারে। বিভিন্ন সময়ে করা পরিসংখ্যানমতে, যেসব শিশুর রক্তে ২.৪-১০ মাইক্রোগ্রাম বা ডেসিলিটার মাত্রায় সিসার উপস্থিতি থাকে, তাদের বুদ্ধিমত্তা কম, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তারা কম কৃতকার্য হয় এবং পুরো জীবনকালে কম অর্থ আয় করে। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) রক্তে সিসার ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রা ৬০ মাইক্রোগ্রাম বা ডেসিলিটার থেকে ৫ মাইক্রোগ্রাম বা ডেসিলিটার-এ নামিয়ে এনেছে। যদিও রক্তে সিসার উপস্থিতির ক্ষেত্রে এমন কোনো প্রমাণিত ‘নিরাপদ’ মাত্রা নেই; বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে এমন কোনো মাত্রা নেই। মূল কথা হলো সমস্যার বা ঝুঁকির মাত্রা বাড়তে থাকে যত বেশি উচ্চ মাত্রার সিসা ব্যবহার করা হবে এবং সংস্পর্শে আসা হবে।
বিশ্বব্যাপী প্রায় ৮০ কোটি শিশুর রক্তে উচ্চমাত্রায় সিসা আছে। এদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের দেশে বসবাসরত। কারণ, সেখানে সিসার অধিক ব্যবহার এবং দূষণ হয়ে থাকে এবং উচ্চ আয়ের দেশগুলোর মতো পর্যবেক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রিত হয় না। বেশির ভাগ শিশুই এশিয়া এবং আফ্রিকার, তবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান দেশগুলোতেও এই অনুপাত কম নয়। সিসাদূষণ শিশুদের ছোট বয়সে স্বাস্থ্য এবং বিকাশের ওপর বহুমুখী এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে, যার জন্য সারা জীবন ধরে তাদের ভুগতে হয়। এমনকি প্রমাণ পাওয়া গেছে যে সিসার বিষাক্ততা শিশুর মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করে, যা কিনা নিপীড়ন এবং অপরাধ করার মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়ার মূল কারণ।
উৎপাদনশিল্পে নিয়ম এবং সতর্কতা মেনে চলাই এই ক্ষতি ঠেকানোর প্রধান উপায়। তাই কঠোর নিরাপত্তা বিধির মাধ্যমে সব ধরনের উৎসে সিসাদূষণ সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা প্রয়োজন। সিসার সংস্পর্শে আসা কমাতে আমাদের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যেন সব শিশু নিরাপদ, সুরক্ষিত এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে, পড়াশোনার সুযোগ পায় এবং পরিপূর্ণ সম্ভাবনায় বেড়ে ওঠে। এসব উদ্যোগ খুব দ্রুত নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; যত বেশি সময় ধরে মানুষ সিসার সংস্পর্শে থাকবে, ততই স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে।
● মাহফুজার রহমান কান্ট্রি ডিরেক্টর, পিওর আর্থ বাংলাদেশ