সাতসকালে আমার এক ছাত্রীর মন খারাপ করা স্ট্যাটাস দেখে চমকে উঠেছিলাম। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বে রোলমডেল, বিশেষ করে বন্যা ব্যবস্থাপনায়’—এই একটি বাক্য পাঁচ বছরের বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে কতবার লিখেছি, তার ইয়ত্তা নেই! কিন্তু বই থেকে জানা আর বাস্তবে দেখার মধ্যে ব্যবধান আকাশ-পাতাল।
হঠাৎ বন্যায় আটকে পড়া মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য সাহায্য পাচ্ছে না। একটা এলাকার এত বাজে অবস্থা হওয়ার পরও প্রশাসন পর্যায়ে দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা নেই, বন্যার মিডিয়া কাভারেজ নেই। যেন সুনামগঞ্জ, সিলেট বাংলাদেশের অংশই নয়! বলা বাহুল্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার এই ছাত্রীকে আমরা যা পড়িয়েছিলাম, যা মুখস্থ করতে বাধ্য করেছিলাম, বাস্তব জীবনে তিনি তাঁর কোনো মিল পাচ্ছেন না।
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার আকুতি ভেসে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। তিনি মানুষকে উদ্ধারের জন্য, পানিবন্দী মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নৌকা চান; পাচ্ছেন না। তিনি লিখেছেন, ‘কোথাও ট্রলারমালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে উজান এলাকা থেকে একটা ট্রলার–নৌকা কেউ ম্যানেজ করতে পারলে অতিসত্বর যোগাযোগ করুন।’ কতটা নিরুপায় পরিস্থিতিতে পড়লে এ রকম খোলা বার্তা একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দিতে পারেন।
এই দুই নদী ব্যবস্থা দিয়ে আসা পানি অবশেষে পদ্মা-মেঘনা হয়ে সাগরে যাবে। তাই কিছুদিনের মধ্যে এই দুই নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোয়ও বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। আর যদি এই মেঘের একটি অংশ হিমালয়ে গঙ্গা নদীর উৎসে বৃষ্টি ঘটায়, তাহলে কয়েক দিনের মধ্যেই সেই পানি আসবে গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে। তেমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার শক্তি কি অবশিষ্ট থাকবে আমাদের?
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
সিলেটের জেলা প্রশাসক তাঁর চিঠিতে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘পানিবন্দী লোকদের উদ্ধারের লক্ষ্যে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন সার্বিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের কাছে প্রয়োজনীয় নৌকা এবং অন্যান্য সরঞ্জাম না থাকায় উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে পানিবন্দী লোকদের উদ্ধার করা সম্ভব না হলে মানবিক বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।’ এই চিঠি তিনি লিখেছেন, ১৭ পদাতিক ডিভিশন সিলেটের জেনারেল অফিসার কমান্ডিংয়ের কাছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২-এর ৩০ ধারার সূত্র ধরে সহযোগিতা চেয়ে জরুরি ভিত্তিতে পানিবন্দী মানুষদের উদ্ধারসহ প্রয়োজনীয় সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য এই অনুরোধপত্র পাঠিয়েছেন তিনি।
পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে বেসামরিক প্রশাসন আর সামাল দিতে পারছে না। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিলেটে সেনা মোতায়েন হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে নৌবাহিনীর বোট ও ডুবুরি দল। কোস্টগার্ডদেরও কাজে লাগানো হবে। বন্ধ আছে ওসমানী বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ওঠানামা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট কার্যালয় সূত্রে প্রথম আলো জেনেছে, বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) সকাল ৯টায় সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৯৯ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। এ ছাড়া কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৩ সেন্টিমিটার এবং সারি নদের সারিঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৩২ সেন্টিমিটার ওপর ছিল পানি। তার বাইরে জেলার ছোট ছোট অন্য নদ-নদীর পানিও ক্রমেই বাড়ছে। এ রকম পানি সিলেট অঞ্চলে নতুন কিছু নয়, কিন্তু এমন বন্যা আসেনি কখনো। ইতিমধ্যে সিলেটের ৮০ শতাংশ ডুবে গেছে, ৯০ শতাংশ ডুবেছে সুনামগঞ্জের। সিলেট-সুনামগঞ্জ এলাকায় পানির উচ্চতা ১৯৮৮, ১৯৯৮ কিংবা ২০০৪ সালের চেয়ে বন্যার পানির উচ্চতায় নতুন রেকর্ড করেছে। সুনামগঞ্জে কোনটি সড়কের অংশ, কোথায় নদী—বোঝার উপায় নেই। বন্যায় আক্রান্ত সব কটি এলাকায় বৃহস্পতিবার থেকেই বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির বিভিন্ন উপকেন্দ্র প্লাবিত হওয়ায় বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। শহরের অধিকাংশ বাসাবাড়ির ভেতর কোমরসমান পানি উঠেছে। সুনামগঞ্জের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এক জনপদ থেকে আরেক জনপদ। ফলে বিভিন্ন পকেটে আটকে থাকা জলবন্দী মানুষকে উদ্ধার করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ না থাকায় চার্জের অভাবে মুঠোফোনও বন্ধ হয়ে আছে অনেকের। ফলে পরিস্থিতি সম্পর্কে তাৎক্ষণিক খবরাখবর আদান–প্রদান করা যাচ্ছে না। স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
চেরাপুঞ্জির রেকর্ড বৃষ্টি কি বর্তমান পরিস্থিতির একমাত্র কারণ? গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৯৮৮, ১৯৯৮ বা ২০০৪—কোনোটাকেই এ বছরের বৃষ্টিপাত এখনো ছাড়ায়নি। তারপরও বন্যার উচ্চতা সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। খটকাটা সেখানেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদ–নদী ও হাওরে এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে যেগুলো পরিবেশসম্মত নয়। পানির স্বাভাবিক প্রবাহ এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সিলেট–সুনামগঞ্জ দুই শহরেই সুরমা নদীকে করে তোলা হয়েছে ময়লা–আবর্জনার ভাগাড়। সিলেটের নগরীর কালীঘাট থেকে টুকের বাজার, কালীঘাট থেকে দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কুচাই এলাকা পর্যন্ত সর্বত্রই আবর্জনার ভাগাড়। একইভাবে সুনামগঞ্জ শহর এলাকায় সুরমা নদীর তীর এখন ময়লার ভাগাড়, আবর্জনার স্তূপ। সুনামগঞ্জ পৌর শহরের সাহেববাড়ি সেলুঘাট, উত্তর আরপিননগর, পশ্চিমবাজার, মধ্যবাজার, চাঁদনীঘাট, সুরমা হকার্স মার্কেট, জগন্নাথবাড়ি, প্রধান মাছ বাজার এলাকা, জেলরোড ফেরিঘাট এলাকা, লঞ্চঘাট এলাকা, উকিলপাড়া এলাকা, ষোলঘর এলাকায় নদীতীরে স্থানীয় লোকজন নিয়মিত হোটেল-রেস্তোরাঁর পচা ও উচ্ছিষ্ট খাবারসহ নানা রকমের বর্জ্য ফেলছেন। ফলে নদী হারিয়ে ফেলছে তার বহনক্ষমতা, নাব্যতা।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
আকাশে যে পরিমাণ মেঘ আছে এবং তাদের যে গতিপথ, সেটা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আগামী অন্তত আরও তিন দিন আসামে কমপক্ষে ৩০০ থেকে ৫০০ মিলিমিটার করে বৃষ্টিপাত হবে। এর ফলে বৃহত্তর সিলেটে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
বৃষ্টির পানির বড় অংশটি সুরমা-কুশিয়ারা নদী ব্যবস্থা দিয়ে এসে সিলেটে বন্যার সৃষ্টি করেছে, কিন্তু বৃষ্টির পানির আরেকটি অংশ ব্রহ্মপুত্র নদী ব্যবস্থা দিয়ে শনি–রবিবারের মধ্যেই বাংলাদেশে ঢুকবে এবং ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী ব্যবস্থা দিয়ে এসে নতুন এলাকায় বড় ধরনের বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে। তাই ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদী ব্যবস্থায় থাকা জেলাগুলোয় এখন থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা এবং আশ্রয়কেন্দ্র চালুর আগাম প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন।
এই দুই নদী ব্যবস্থা দিয়ে আসা পানি অবশেষে পদ্মা-মেঘনা হয়ে সাগরে যাবে। তাই কিছুদিনের মধ্যে এই দুই নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোয়ও বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। আর যদি এই মেঘের একটি অংশ হিমালয়ে গঙ্গা নদীর উৎসে বৃষ্টি ঘটায়, তাহলে কয়েক দিনের মধ্যেই সেই পানি আসবে গঙ্গা-পদ্মা দিয়ে। তেমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার শক্তি কি অবশিষ্ট থাকবে আমাদের?
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক
nayeem5508@gmail.com