সিরিয়াতে ইসরায়েলের হামলার সময় কেন অন্ধ থাকে রাশিয়া?

সিরিয়ার ইদলিবে ইসরায়েলের বিমান হামলা। ঘটনাটি ২০১৯ সালের মার্চ মাসের। এ ধরনের হামলা প্রায়শই চালায় ইসরায়েল
ছবি: এএফপি

সিরিয়াতে নিজেদের সবচেয়ে অগ্রসর বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এস-৪০০ মোতায়েন করেছে রাশিয়া। কিন্তু এটি ইসরায়েলের বিমানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র পুতিন; তা সত্ত্বেও ইসরায়েল যখন সিরিয়ান আর্মি ও ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র যোদ্ধাদের ওপর বিমান হামলা চালায়, তখন সেটা প্রতিহত করে না রাশিয়া। সিরিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষায় রাশিয়ার আধিপত্য রয়েছে। এটা আসাদ সরকারকে বিদ্রোহী দমনে সহযোগিতা করে। এরপরও ইসরায়েল কীভাবে নির্বিঘ্নে সেখানে হামলা চালাতে পারে?

গত ২৮ ডিসেম্বর ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান লাতাকিয়া বন্দরের কনটেইনার টার্মিনালে বিমান হামলা চালায়। সিরিয়ার এ অংশেই রাশানদের বড় নৌ ঘাঁটি রয়েছে। ইরানের অস্ত্র রাখা আছে, এমন একটি জায়গায় হামলাটি চালানো হয়। অবশ্য সেটিই প্রথম হামলা ছিল না। এর আগে ৭ ডিসেম্বর প্রথম হামলাটি চালিয়েছিল ইসরায়েল। তখন অপেক্ষাকৃত কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু সর্বশেষ হামলায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক।

হামলার রাতে রাশিয়ার এস-৪০০ কিংবা সিরিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কোনোটার পক্ষ থেকেই বাধা আসেনি। প্রকৃত সত্যটা হচ্ছে, রাশিয়া কখনোই তার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চালু করে না। এই নিষ্ক্রিয়তার গূঢ় কারণ হচ্ছে, রাশিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে এ ব্যাপারে চুক্তি রয়েছে। ২০১৫ সালে সিরিয়াতে সামরিক অভিযান শুরুর আগে ক্রেমলিন ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছিল। চুক্তিতে সিরিয়াতে ইরানি সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সিরিয়ান আর্মির ওপর যখন ইসরায়েল হামলা করবে, সে সময় রাশিয়ার নাগরিক ও সামরিক স্থাপনা সুরক্ষিত রাখা হবে বলে অঙ্গীকার করেছিল ইসরায়েল। এর বিনিময়ে রাশিয়া নিশ্চয়তা দিয়েছিল তারা ইসরায়েলি হামলার ক্ষেত্রে চোখ বন্ধ রাখবে।

রাশিয়া নাহয় চুক্তির কারণে ইসরায়েলকে কিছু বলেনি, কিন্তু সিরিয়া কেন ২৮ ডিসেম্বরের হামলা প্রতিহত করল না? ক্রেমলিনের কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন, লাতাকিয়ায় যখন হামলা হচ্ছিল তখন ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে হামিমিম বিমান ঘাঁটিতে রাশিয়ার একটি সামরিক পরিবহন বিমান অবতরণ করছিল। কিন্তু সিরিয়ার বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সেটি প্রতিহতের উদ্যোগ নেয়নি। ২০১৮ সালের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক, সেটা চায়নি ক্রেমলিন। সে সময়ে রাশিয়ার একটা পরিদর্শন বিমান ১৬ জন লোক নিয়ে হামিমিম থেকে ফিরছিল। সিরিয়ার ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য এস-২০০ ক্ষেপণাস্ত্রের ভুল হামলায় সেটি বিধ্বস্ত হয়েছিল। রাশিয়া ওই ঘটনার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে বলেছিল, ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান রাশিয়ার টু-২০ বিমানটির একই সীমারেখায় চলে আসে। সিরিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে যে হামলা করতে যাচ্ছে আগে থেকে তাদের সতর্ক করা হয়নি।

লাতাকিয়ায় ইসরায়েল যে হামলা চালাল তার কয়েক দিন আগেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জগের সঙ্গে টেলিফোনে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ব্যাপারে আলাপ করেছেন। ইসরায়েল ও রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই সম্পর্কে জড়িত। বর্তমানে ইসরায়েলে ১৫ লাখের বেশি রুশভাষী ইহুদি রয়েছেন। রুশ ধনকুবেরদের অনেকেও ইসরায়েলের নাগরিকত্ব নিয়েছেন।

অবশ্য জল্পনা আছে যে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমানেই রাশিয়ার বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছিল। কিন্তু এ ঘটনায় ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি। এই বিয়োগান্ত ঘটনার পরও রাশিয়া ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়েনি। যদিও সিরিয়াতে রাশিয়ার যে সামরিক কার্যক্রম, তাতে করে ইসরায়েলের যেকোনো হামলা প্রতিহতের অধিকার তাদের রয়েছে। কিন্তু এরপরও সিরিয়াতে ইসরায়েলের হামলায় চোখ বন্ধ রাখে রাশিয়া। লাতাকিয়ার সাম্প্রতিক হামলাটি এর ব্যতিক্রম নয়।

সিরিয়া কিংবা ইরানের ক্ষেত্রে ক্রেমলিনের আচরণ অবিশ্বস্ত মিত্রের মতো। ২০১০ সালে মস্কো তেহরানের কাছে এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বিক্রি করতে রাজি হয়নি। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া ও ইসরায়েলের বাধার কাছে নতি স্বীকার করেছিল ক্রেমলিন। ২০১৯ সালে রাশিয়া তাদের এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ইরানের কাছে বিক্রি করেনি। এবারে ওজর ছিল, এতে করে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়বে।

এখন যদিও ইরানের কাছে প্রচলিত অস্ত্র বিক্রিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিধিনিষেধ আর নেই। তা সত্ত্বেও ইরানের কাছে রাশিয়া তাদের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বিক্রি করবে না। রাশিয়ার একটি ভয় হচ্ছে, যদি ইসরায়েল এর প্রতিক্রিয়ায় ইউক্রেনের কাছে অত্যাধুনিক ড্রোন বিক্রি করে বসে। ইসরায়েলের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক সংকটে পড়ুক, সেটা চাইবে না রাশিয়া। এ জন্য ইরানের সঙ্গে গভীর সামরিক সহযোগিতায় বিরত থাকবে তারা। ইসরায়েলের সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেইর বেন শাব্বাত সম্প্রতি বলেছেন, ‘রাশিয়া ইসরায়েলের মতো মনে করে ইরান মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করছে।’ তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, ইরান নিয়ে মস্কোর প্রকাশ্য অবস্থানের চেয়ে প্রকৃত অবস্থান ভিন্ন।

লাতাকিয়ায় ইসরায়েল যে হামলা চালাল তার কয়েক দিন আগেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হার্জগের সঙ্গে টেলিফোনে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার ব্যাপারে আলাপ করেছেন। ইসরায়েল ও রাশিয়া ঐতিহাসিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই সম্পর্কে জড়িত। বর্তমানে ইসরায়েলে ১৫ লাখের বেশি রুশভাষী ইহুদি রয়েছেন। রুশ ধনকুবেরদের অনেকেও ইসরায়েলের নাগরিকত্ব নিয়েছেন।

রাশিয়ার রাজনীতিতে এই অভিজাতদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মস্কো মধ্যপ্রাচ্যের সব কটি শক্তিকেন্দ্রের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। রুশ-ইসরায়েল সম্পর্কের ক্ষেত্রে সিরিয়া খুব দুর্বল সংযোগ। রাশিয়া তার তথাকথিত প্রতিরক্ষা অক্ষ (সিরিয়া, ইরান ও ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী) এবং তাদের প্রধান শত্রু ইসরায়েলের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। ইতিহাস ও বর্তমান সম্পর্ক বিবেচনায় এটা বলা যায় যে ইসরায়েলকেই ক্রেমলিন এগিয়ে রাখবে।

নিকোলা মিকোভিচ সার্বিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত