সিটি করপোরেশন যখন নিজেই ফুটপাত বাণিজ্যে লিপ্ত

চট্টগ্রাম নগরের ২৮১ কিলোমিটার ফুটপাতের ৮০ ভাগ দখল হয়ে গেছে
ছবি : সৌরভ দাশ

পথচারীদের চলাচলের জন্য ফুটপাত। সেই ফুটপাত দেখভালের দায়িত্ব চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক)। কেউ ফুটপাত দখল করলে উচ্ছেদের দায়িত্বও তাদের। কিন্তু এই দায়িত্বের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে নগরের ফুটপাতে দোকান বরাদ্দ দেওয়ার ব্যবস্থা করছে তারা। এই খবরে ক্ষুব্ধ ও হতাশ চট্টগ্রাম নগরবাসী।

পত্রিকার খবরে প্রকাশ, নগরের ব্যস্ত শিল্প এলাকায় শেরশাহ টেক্সটাইল ও তারা গেট এলাকায় উন্নয়ন চার্জের বিনিময়ে দেড় কিলোমিটার ফুটপাত জুড়ে ২৫৫টি দোকানের বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করেছে করপোরেশন। বর্তমানে শেরশাহ এলাকা সড়কের দুই পাশে ফুটপাতে পাকা স্থায়ী দোকান নির্মাণের কাজ চলছে। কিছু দোকানের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আর কিছুর কাজ শেষ পর্যায়ে। এ এলাকায় নির্মিত হবে ১০০টি দোকান। আর তারাগেট এলাকায় ইতিমধ্যে নির্মাণসামগ্রী জমা হয়ে আছে। সেখানে নির্মিত হবে ৯০টি দোকান। এভাবে টেক্সটাইল মোড় থেকে চন্দ্রনগর পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে ফুটপাতেও দোকান তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে করপোরেশন। ফলে এসব এলাকায় আর ফুটপাত বলে কিছু থাকবে না।

নগরের ফুটপাতগুলোর অবস্থা যখন এ রকম, ঠিক তখনই ফুটপাত বরাদ্দ দেওয়ার খবরটি উঠে এল—ফুটপাতে দোকান বানানো হচ্ছে। এতদিন হকার আর সিন্ডিকেটের লোকজন ফুটপাত দখল করেছিল। এখন সিটি করপোরেশন ফুটপাত দখলের কাজ হাতে নিয়েছে।

সিটি করপোরেশনের এস্টেট অফিসার জসিম উদ্দিন চৌধুরীর স্বাক্ষর করা বরাদ্দপত্রে দেখা যায়, শেরশাহ রোডের দোকানগুলোর জন্য প্রতি বর্গফুটে চার হাজার টাকা উন্নয়ন চার্জ নেওয়া হচ্ছে। তারাগেট এলাকার দোকানগুলোর জন্য নেওয়া হচ্ছে প্রতি বর্গফুটে সাড়ে তিন হাজার টাকা। এগুলোর মাসিক ভাড়া প্রতি বর্গফুটে ১০ টাকা করে নেবে সিটি করপোরেশন। চট্টগ্রাম শহরের মতো এমন ব্যস্ত নগরে বিশেষ করে শেরশাহ, তারাগেট ও টেক্সটাইল মোড়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, যেখানে বড় বড় শিল্পকারখানা থাকার কারণে ভারী যানবাহন চলাচল করে, সেখান থেকে ফুটপাত তুলে দিয়ে দোকান বসানোর এ সিদ্ধান্ত কেন নিল সিটি করপোরেশন, তার কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, ফুটপাতে দোকান নির্মাণের সিদ্ধান্ত নাকি আগের মেয়রদের আমলেই হয়েছে। তাঁরাই নাকি অনেক ফুটপাত ইজারা দিয়ে গেছেন।

ফুটপাত পথচারীদের চলাচলের জন্য নির্মিত হয়। এটা নাগরিক অধিকার। নগরের ব্যস্ত সড়কগুলোতে যানবাহন চলাচল নির্বিঘ্ন এবং নাগরিকদের দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করতেই ফুটপাথে চলাচল জরুরি। কিন্তু চট্টগ্রাম নগরে অন্য অনেক কিছুর মতো নাগরিকদের অধিকারকে তোয়াক্কা না করে সিটি করপোরেশনের এই সিদ্ধান্ত কোনো সচেতন নাগরিক মেনে নিতে পারেন না। সিদ্ধান্ত যখনই হোক, বর্তমান মেয়র এর দায় এড়াতে পারেন না। কারণ তাঁর আমলেই ওই সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম নগরের ২৮১ কিলোমিটার ফুটপাতের ৮০ ভাগ এখন দখল হয়ে গেছে। ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের দু-একটি ছাড়া আর কোথাও দখলমুক্ত ফুটপাত দেখা যায় না। নগরের অফিসপাড়া বলে খ্যাত আগ্রাবাদের কথাই ধরি। সেখানে কোনো ফুটপাত খালি পাবেন না। সেখানকার শেখ মুজিব সড়কে দেওয়ানহাট মোড় থেকে আগ্রাবাদ মোড় পর্যন্ত দেড় কিলোমিটার সড়কের দুই পাশ গাড়ির গ্যারেজ ও মোটরপার্টস বিক্রেতাদের দখলে। আগ্রাবাদের প্রায় সব ফুটপাতে এখন দেশি-বিদেশি জুতা ও কাপড়চোপড়ের বিশাল বাজার। বন্ধের দিন ছাড়া এখন আগ্রাবাদ যাওয়া মানে নরকযন্ত্রণা ভোগ করা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলার কারণে এমনিতে সড়ক হয়েছে সংকীর্ণ। দুই পাশের ফুটপাত দখল, তার ওপর সড়কের মধ্যে উড়ালসড়কের জন্য রাখা হয়েছে নির্মাণসামগ্রী। সড়কটি দেখলে মনে হবে যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি অঞ্চলে আপনি ভুল করে এসে পড়েছেন। আগ্রাবাদের এই সড়কের এক ইঞ্চি জায়গাও এখন খালি নেই। নগরের সবচেয়ে ব্যস্ত এই সড়কের বেহাল কারণে দিনভর যানজট লেগে থাকে।

এতদিন হকার আর সিন্ডিকেটের লোকজন ফুটপাত দখল করেছিল। এখন সিটি করপোরেশন ফুটপাত দখলের কাজ হাতে নিয়েছে।

শুধু কি আগ্রাবাদ? চকবাজার, বহদ্দারহাট, জুবিলী রোড, রেয়াজউদ্দিন বাজার, নিউমার্কেট, আমতলা, স্টেশন রোড, আন্দরকিল্লা, খাতুনগঞ্জ, চাক্তাই, আসদগঞ্জ, ফিরিঙ্গিবাজার, লালদীঘি, জিইসি মোড়, মুরাদপুর, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের সড়ক, ষোলশহর, অক্সিজেন, পাহাড়তলী অলংকার মোড়, এ কে খান গেট, বড়পুল মোড়, ইপিজেডসহ নগরজুড়ে ফুটপাত দখল করে চলছে রমরমা ব্যবসা। শুধু ফুটপাত দখল নয়, অনেক এলাকায় ফুটপাত ছাড়িয়ে মূল রাস্তা পর্যন্ত রয়েছে দখলদারদের রাজত্ব। এই অনিয়ম দিন দিন বাড়ছে। অথচ পুলিশ প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন সব সময় বড় বড় বুলি আউড়ে যাচ্ছে—তারা ফুটপাত মুক্ত করতে সদা সচেষ্ট ও তৎপর। তাদের তৎপরতা সারা বছর চলে। তবু যুগ যুগ ধরে ফুটপাত অবৈধ দখলে থেকে যায়।

ফুটপাত দখলের কারণে নগর অপরিচ্ছন্ন থাকে, পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, যানজট হচ্ছে, পথচারীরা নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারেন না। ফুটপাত দখল করে রাখায় মানুষ রাস্তায় হাঁটেন, এ কারণে গাড়ি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। যে শহরে ফুটপাত দেখা যায় না, সে শহরের সৌন্দর্যও থাকে না। এসব অসুবিধার কারণে নগরের মানুষ ফুটপাত দখলের বিরুদ্ধে। শুধু দখলদার এবং যাঁরা তাঁদের কাছ থেকে নানান সুযোগ-সুবিধা পান, তাঁরাই ফুটপাত দখলের পক্ষে। অনেকে বলেন, ফুটপাত দখলের পেছনে রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মী। তাঁদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার পেছনে পুলিশেরও ভূমিকা আছে। এ অভিযোগের কোনো প্রমাণ কেউ দিতে পারেন না বলেই অনিয়মের সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে নগরের ফুটপাত। এতে একটি বিষয় প্রমাণিত হয়—এই অবৈধ, অনৈতিক ও অনিয়ম যাঁরা করছেন, তাঁদের পেছনে নিশ্চয়ই ক্ষমতাধর কোনো শক্তির সমর্থন রয়েছে। নইলে বছরের পর বছর এভাবে চলতে পারে কী করে?

নগরের ফুটপাতগুলোর অবস্থা যখন এ রকম, ঠিক তখনই ফুটপাত বরাদ্দ দেওয়ার খবরটি উঠে এল—ফুটপাতে দোকান বানানো হচ্ছে। এতদিন হকার আর সিন্ডিকেটের লোকজন ফুটপাত দখল করেছিল। এখন সিটি করপোরেশন ফুটপাত দখলের কাজ হাতে নিয়েছে। যে করপোরেশনের দায়িত্ব ফুটপাত দখলমুক্ত, পরিষ্কার রাখা ও রাস্তাঘাট সংস্কার করা, সেই সিটি করপোরেশনই এখন ফুটপাত বিক্রির কাজে নেমেছে। সিটি করপোরেশন সব সময় তাদের মৌলিক কাজগুলোতে ব্যর্থ হয়েছে, এখন সেই ব্যর্থতার সঙ্গে যুক্ত হলো তাদের আগ্রাসী উদ্যোগ। এই উদ্যোগ সিটি করপোরেশনের ইতিহাসকে কালিমাযুক্ত করবে। সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিটি করপোরেশনের যে নাম আছে, সেই নাম মুছে যাবে। কথায় বলে—ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই, কিল দেওয়া গোঁসাই।

সিটি করপোরেশনের বেলায় এ কথা ফলে গেল। তারা ফুটপাত দখলমুক্ত করতে পারে না, অথচ বেচে দেওয়ার কারবার করছে তারা। এই নেতিবাচক উদ্যোগ থেকে সিটি করপোরেশন যত তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে, ততই চট্টগ্রামবাসীর জন্য মঙ্গল। সিটি করপোরেশনের কর্তাদের জন্যও মঙ্গল। এ কাজের জন্য চসিক প্রশাসনের নামের সঙ্গে ‘ফুটপাতখেকো প্রশাসন’ বিশেষণ যুক্ত হয়ে পড়বে। উন্নত বিশ্বে পরিবেশসহ নানাদিক বিবেচনা করে ফুটপাতের পরিসর বাড়ানো হয়। আর আমরা ঠিক তার বিপরীত দিকে চলছি। এই বিপরীতমুখী প্রবণতা থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন খুব শিগগির ফিরে আসুক। তাদের সুমতি হোক।

ওমর কায়সার প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বার্তা সম্পাদক