সিজোফ্রেনিয়া মানেই জীবনের শেষ নয়

.

প্রতিবছরের মতো এবারও ১০ অক্টোবর সারা বিশ্বে পালিত হলো বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল: সিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে বসবাস। মানসিক রোগের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ও সবচেয়ে অক্ষম করে তোলা রোগের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া অন্যতম। মানসিক রোগীদের ‘পাগল’ বলে অমানবিক ও অপমানকর অপবাদ দেওয়ার কারণ এই রোগজনিত কিছু অস্বাভাবিক আচরণ, চিন্তা ও প্রত্যক্ষণ। অথচ এই রোগসহ অন্যান্য মানসিক রোগের উৎপত্তি হয় ব্রেনের জৈব-রাসায়নিকের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা বা অসামঞ্জস্যতার জন্য। স্ট্রোকও ব্রেনের একটি রোগ, সিজোফ্রেনিয়াও ব্রেনের একটি রোগ। অথচ সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের পাগল বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা, অপমান করাসহ চিকিৎসাবঞ্চিত রাখা হয়। কোনো পরিবারে একজন মাদকাসক্ত বা সিজোফ্রেনিয়া রোগী থাকলে সেই পরিবার যেন হয়ে ওঠে ‘কলঙ্কিত’ পরিবার। সামাজিক বৈষম্য ও লোকলজ্জার ভয়ে ওই পরিবার ও ব্যক্তিকে হেয়কর ও লাঞ্ছিত জীবন যাপন করতে হয়। তবে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অবদানে বর্তমানে এই রোগীরা শুধু আরোগ্য লাভই করছেন না, তাঁদের জন্য তাঁরা অর্থপূর্ণ ও সম্মানিত জীবনও নির্মাণ করছেন।
বর্তমানে সারা বিশ্বে কমপক্ষে দুই কোটি ৬০ লাখ লোক সিজোফ্রেনিয়া রোগে ভুগছেন। বাংলাদেশে এই রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৬ লাখ। সাধারণ মানুষের চেয়ে এই রোগীরা ১৫-২০ বছর আগে মারা যান। অন্যদের তুলনায় তাঁরা ছয়–সাত গুণ বেশি বেকার জীবন যাপন করেন, তাঁরা প্রায়ই গৃহহীন থাকেন (রাস্তায় ভবঘুরে জীবন যাপন করেন), সর্বোপরি তাঁদের ৫-১০ শতাংশ আত্মহত্যা করে মারা যান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রোগজনিত অক্ষমতার প্রথম ১০টি কারণের একটি হচ্ছে সিজোফ্রেনিয়া। তাঁরা সম্মানহীন এবং বন্ধুহীন ও আত্মীয়হীন জীবন যাপন করেন। শিক্ষার সুযোগ হারান, চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকেন, শারীরিক সুস্থতা নষ্ট হয়, চেহারা বিনষ্ট হয়। সামাজিক বন্ধন ছিঁড়ে যায়, সর্বোপরি ভবিষ্যৎ জীবন বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের মধ্যে ধূমপানের হার দুই থেকে ছয় গুণ বেশি। তাঁদের মধ্যে ৪৫-৫৫ শতাংশ মোটা বা স্থূলতায় ভোগেন, তাঁদের মধ্যে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের হারও অধিক থাকে। অথচ অন্যদের তুলনায় তাঁদের শারীরিক রোগের চিকিৎসায়ও অবহেলা করা হয়।
এবারের প্রতিপাদ্য ‘সিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে বসবাস’। কারা সিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে বসবাস করেন? তাঁদের সমস্যা ও যন্ত্রণা কী? সেই সমস্যা ও যন্ত্রণা লাঘবে আমরা কী করতে পারি—এসবই হচ্ছে এই প্রতিপাদ্যের মূল ভাবনা। সিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে বসবাস যাঁরা করেন তাঁরা হচ্ছেন: রোগী নিজে, পরিবারের লোকসহ অন্য যাঁরা তাঁদের যত্ন নেন, মনোরোগ চিকিৎসক যাঁরা তাঁদের চিকিৎসা দেন, যাঁরা তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করেন এবং অবশ্যই বৃহত্তর সমাজ। এই বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে কোলাবরেশন তৈরি করতে পারলে সিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে বসবাস ও স্বস্তিদায়ক হতে পারে। সিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে বসবাসের অভিজ্ঞতা যেন ইতিবাচক ও অর্থপূর্ণ হয়, সে রকম চিকিৎসাব্যবস্থা আমাদের তৈরি করতে হবে।
মি. জেনেট পেলিও, যিনি বর্তমানে রিকভারি বেসড সার্ভিস টেক্সাস কাউন্সিলের পরিচালক এবং ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন ফর মেন্টাল হেলথের বোর্ড মেম্বার, একসময় সিজোফ্রেনিয়ার রোগী ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার নয়টি বিভিন্ন রোগ ছিল; এর মধ্যে সিজোফ্রেনিয়ার জন্য আমি সবচেয়ে বেশি ভীত ছিলাম, ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আমার কোনো আশা ছিল না, ভবিষ্যৎ ছিল না, আমি অবাক হতাম যে স্রষ্টা আমাকে কেন এত ঘৃণা করত। আমি জীবনকে ঘৃণা করতাম, সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতাম নিজেকে। আমার মন-যন্ত্রণা আমাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল এবং এ থেকে মুক্তির কোনো উপায় ছিল না। এখান থেকে পালিয়ে বেড়ানোর কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু অবশেষে আমি আরোগ্য লাভের সুযোগ পাই। বর্তমানে আমার জীবন পূর্ণতা পেয়েছে, নতুন আশাবাদ ও স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। এখন সময় এসেছে প্রত্যেকের জন্য আরোগ্য লাভের সুযোগ তৈরি করা এবং প্রত্যেকে তেমন সুযোগ পাওয়ার উপযুক্ত।’
আমরা মনোরোগ চিকিৎসকেরা জানি ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা রয়েছে যে মি. জেনেট পেলিওর মতো অনেক সিজোফ্রেনিয়ার রোগী আরোগ্য লাভ করেছেন এবং উঁচু পদে কর্মরত রয়েছেন। একসময়ের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে যে এই রোগের ক্রমাবনতি হয়। বর্তমান আধুনিক চিকিৎসা আরোগ্য লাভকে সহজতর করেছে, এমনকি অনেকে উৎপাদনশীল ও সৃজনশীল কর্মে নিয়োজিত রয়েছেন। ২৫ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন, আরও ৩৫ শতাংশ স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে পারেন, আরও ২০ শতাংশ সহায়তা সাপেক্ষে উন্নতি লাভ করেন। মাত্র ১৫ শতাংশ তেমন উন্নতি লাভ না-ও করতে পারেন। অথচ এই ১৫ শতাংশকে দেখেই আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে এ রোগ আরোগ্য লাভ হয় না। এ বিউটিফুল মাইন্ড চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে, এ ধরনের রোগীরা অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অবশেষে কীভাবে আশাবাদী। জীবন অর্জন করতে পারেন।
বলা হয়, ‘মানসিক স্বাস্থ্য ব্যতিরেকে কোনো স্বাস্থ্য নেই’। আপনার শারীরিক স্বাস্থ্য যত ভালোই হোক, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে সে স্বাস্থ্য-সুখ উপভোগ করতে পারবেন না। তাই আমাদের সবারই মানসিক স্বাস্থ্যর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। সিজোফ্রেনিয়া রোগ দীর্ঘস্থায়ী হয় (ক্রনিসিটি) ওই রোগের জন্য নয় বরং সমাজ ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা ওই রোগকে যে প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা দিয়ে থাকে তার জন্য। ওই রোগীরা সঠিক চিকিৎসায় শুধু আরোগ্য লাভ করেন না, তাঁরা গড়ে উঠতে, বেড়ে উঠতেও পারেন (থ্রাইভ)। এর জন্য ওষুধ ও চিকিৎসার পাশাপাশি কমিউনিটি বেসড রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করতে হবে। যত আগে থেকে চিকিৎসা শুরু হবে, ফল তত ভালো হবে। চাকরির সংস্থান, বাসস্থানের ব্যবস্থা, যথাযথ শিক্ষার সুযোগ, উপযুক্ত বিনোদন এবং উষ্ণ ও ভালোবাসাপূর্ণ পারিবারিক জীবন এঁদের আরোগ্য লাভকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এককথায়, আমরা একটি ভালো জীবনের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকি, তাঁদের প্রত্যেকের জন্য সেসব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারে তাঁদের প্রতি প্রকাশিত আবেগের ধরন ও মাত্রা বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকে। যদি তাঁদের প্রকাশ্য সমালোচনা করা হয়, শত্রু-মনোভাব পোষণ করা হয় এবং অতিরিক্ত আগলে রাখার চেষ্টা করা হয়, তাহলে এই রোগের তীব্রতা বাড়ে এবং রোগটির পুনরায় আক্রমণের হার বাড়ে (রিলাপস)। তাই পরিবারের সদস্যদের সাইকো-এডুকেশন দিলে ও ফ্যামিলি থেরাপি দিলে পুনরায় আক্রমণ কমিয়ে রাখা যায়।
সবশেষে সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের জন্য পরিবার ও আমরা যা করতে পারি, সে ব্যাপারে কয়েকটি পরামর্শ:
১. মনে রাখবেন, এটি একটি রোগ (মেডিকেল ইলনেস)। আপনার পরিবারে তেমন কেউ থাকলে এর জন্য লজ্জিত বোধ করার কারণ নেই।
২. এ রোগের জন্য নিজেকে অপরাধী ভাববেন না। এটি কারও ভুলের ফল নয়। এটিকে মেনে নিন।
৩. আপনার রোগীর লক্ষণসমূহ কী তা জেনে নিন। রোগ পুনরায় আক্রমণের প্রাথমিক লক্ষণ হলো আগে ধরতে পারলে পুনরায় আক্রমণ ঠেকাতে পারবেন। যেমন, ঘুমের ধরনে পরিবর্তন বা সামাজিকভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া।
৪. রোগীর জন্য একটি দৈনন্দিন রুটিন তৈরি করে তা মেনে চলতে সহায়তা করুন।
৫. রোগী যাতে নিয়মিত ওষুধ সেবন করে, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখুন।
৬. রোগীকে বুঝতে দিন তিনি একাই এই রোগ মোকাবিলা করছেন না, আপনারাও তাঁর সঙ্গে রয়েছেন। যোগাযোগের রাস্তা উন্মুক্ত রাখুন।
৭. প্রকাশ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা প্রকাশ করবেন না। আবার সরাসরি ও নির্দয় সমালোচনাও করবেন না।
৮. নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারলে প্রশংসা করুন।
৯. মনে রাখবেন, এঁদের যত্ন নেওয়া আবেগগতভাবে ও শারীরিকভাবে ক্লান্তিকর। নিজের জন্য সময় নিন।
১০. যদি বাসায় চিকিৎসা সম্ভব না হয়, আপনার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
ডা. মো. তাজুল ইসলাম: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।