কলকাতার চিঠি

সিঙ্গুর থেকে ভাঙড়

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়তো ভাবতে পারেননি সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের মতো এখনই আন্দোলনের আরেকটি পথ
খুলে যাবে পশ্চিমবঙ্গে। সেই পথটি ভাঙড়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সেই ভাঙড় এখন দ্বিতীয় সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম হিসেবে উঠে
আসতে চাইছে। ইতিমধ্যে ভাঙড় আন্দোলন নামে আরেকটি নাম উঠে এসেছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে।
সিঙ্গুরের আন্দোলন ছিল টাটা শিল্পগোষ্ঠীকে সস্তায় ন্যানো গাড়ির কারখানা তৈরির জন্য ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে তা লিজ দেওয়ার বিরুদ্ধে। নন্দীগ্রামেও এই একই ধাঁচের জমি অধিগ্রহণবিরোধী আন্দোলন। যদিও সিঙ্গুরে ৯৯৭ একর জমি দেওয়া হয়েছিল টাটাকে। আর নন্দীগ্রামে কিন্তু কোনো জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি। কেবল অধিগ্রহণ করার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। ওই ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গে তীব্র হয়ে উঠেছিল জমি অধিগ্রহণবিরোধী আন্দোলন।
২০০৬ সালে শুরু হওয়া সেই জমি অধিগ্রহণবিরোধী আন্দোলনের যবনিকা ঘটেছিল গত বছরের ৩১ আগস্ট। ওই দিন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক নির্দেশে জানিয়েছিলেন, সাবেক বামফ্রন্ট আমলে টাটার জন্য জমি অধিগ্রহণ ছিল অবৈধ। জয়ী হন মমতা। যবনিকাপাত ঘটে সিঙ্গুর আন্দোলনের ১০ বছরের ইতিহাসের। মমতাও সেই জমি ফিরিয়ে দেন জমিদাতাদের গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর মমতা নিজে সিঙ্গুরে উপস্থিত হয়ে। তাই এই বিজয়ের পর জমি অধিগ্রহণবিরোধী আন্দোলনের সেই সূতিকাগার সিঙ্গুর এখন ফের জেগে উঠছে। ফিরছে স্বাভাবিক ছন্দে।
এত কিছুর পরও কিন্তু তাতে একদণ্ড শান্তিতে নেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা। সিঙ্গুর আন্দোলন থেমে গেলেও সেই সিঙ্গুর আন্দোলনের পথ
ধরে এই পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে ফের বিভিন্ন এলাকায় জমি অধিগ্রহণবিরোধী আন্দোলন। আন্দোলনকারীদের একটিই কথা, ২০০৬ সালে যে জমি তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার অধিগ্রহণ করেছিল, মমতার তীব্র আন্দোলনের মুখে সেই জমি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। তাই আবার কেন জোর করে জমি অধিগ্রহণ?
পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের লক্ষ্যে বাম আমলে বামফ্রন্ট সরকার হুগলির সিঙ্গুরে ৯৯৭ একর কৃষিজমির একাংশ জমিদাতার আপত্তি
অগ্রাহ্য করে অধিগ্রহণ করে তা তুলে দিয়েছিল টাটার হাতে ন্যানো গাড়ির কারখানা গড়ার জন্য। সুপ্রিম কোর্ট গত ৩১ আগস্ট সেই অধিগ্রহণকে অবৈধ বলে রায় দিয়ে সেই অধিগৃহীত জমি জমিদাতাদের ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
এবার সিঙ্গুরের আন্দোলনের সেদিনের সেই পথ ধরে এবং সুপ্রিম কোর্টের রায়কে সম্বল করে কলকাতার উপকণ্ঠে রাজারহাটে নতুন টাউনশিপ বা উপনগরী গড়ার জন্য ২০০২ সাল থেকে ২০১২ পর্যন্ত অধিকৃত ৬ হাজার ৮৩৯ একর জমি জমিদাতাদের ফিরিয়ে দেওয়ার আন্দোলন শুরু করেছেন ওই এলাকার জমিদাতারা। এই জমি অবশ্য অধিগ্রহণ করে তা তুলে দেওয়া হয় হিডকোর হাতে। হিডকো বা পশ্চিমবঙ্গ হাউজিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন এই টাউনশিপ নির্মাণ করছে।
সিঙ্গুর মামলার রায় ঘোষণার পরদিন থেকে বর্ধমান শহরের উপকণ্ঠে উল্লাস উপনগরী, শিলিগুড়ির কাওয়াখালি উপনগরী, পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুরেও অধিগৃহীত জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন জমিদাতারা।
এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সংযোজন রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত বীরভূমের বোলপুরে। বোলপুরে মমতা ঘোষিত বিশ্ব
বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দিয়েছেন জমিদাতারা। ২০০১ সালে বামফ্রন্টের আমলে এই জমি অধিগ্রহণ করা হয়। তখন
বলা হয়েছিল, এখানে ভারী শিল্প গড়া হবে। চাকরি পাবেন জমিদাতাদের পোষ্যরা। কিন্তু গত ১০ জানুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বোলপুরে এসে ঘোষণা দেন, এই জমিতে বিশ্ব বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় গড়া হবে। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন জমিদাতারা। ৩০ জানুয়ারি সকালে বিশ্ব বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ শুরু হলে এলাকাবাসী এসে জমির সীমানাপ্রাচীর ভেঙে দিয়ে সেখানে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। একপর্যায়ে টায়ার জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। এরপরই বন্ধ হয়ে যায় নির্মাণকাজ।
আর অন্যদিকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ভাঙড়ে অধিগৃহীত জমিতে পাওয়ার গ্রিড নির্মাণের বিরুদ্ধে চলছে আন্দোলন। এই আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসহ দুজনের মৃত্যু হয়েছে। ভাঙড়ের ঘটনার প্রতিবাদে কলকাতায় মহামিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মহামিছিল হয় ‘ভাঙড় সংহতি মঞ্চের ব্যানারে। যোগ দেয় কংগ্রেসসহ বিভিন্ন বামপন্থী দলের বহু সমর্থক দলীয় পতাকা ছাড়া। মিছিল শেষে আন্দোলনকারীরা ধর্মতলায় মানববন্ধন রচনা করে ভাঙড় থেকে অবিলম্বে পাওয়ার গ্রিডের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেওয়ার দাবি জানান। সেই আন্দোলন এখনো চলছে। একইভাবে জমি অধিগ্রহণবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে বর্ধমানের অন্ডালেও।
কিন্তু কেন আবার জমিবিরোধী আন্দোলন? মমতা তো সাধারণ কৃষকের জমি ফিরিয়ে দিয়ে এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তারপর আবার জমিবিরোধী আন্দোলন গোটা রাজ্যজুড়ে বাসা বাঁধছে কেন? এক রাজনৈতিক নেতা বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন, তাতে অনুপ্রাণিত এই রাজ্যের মানুষ। আর তাতে এই বিশ্বাস জন্ম দিয়েছে, এবার জোর করে জমি অধিগ্রহণ করতে গেলে রক্ষা নেই। ফল ভোগ করতে হবে সরকারকেই। আর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পথ ধরে শুরু হয়েছে রাজ্যজুড়ে জমি অধিগ্রহণবিরোধী আন্দোলন। আর এই আন্দোলনকে পেছন থেকে শক্তি জোগাচ্ছে সরকারবিরোধীরা। নন্দীগ্রাম বা সিঙ্গুরে জমিবিরোধী আন্দোলনে সেদিন ঢুকে পড়েছিল নকশাল বা মাওবাদীরা। আর এবার সেই ভাঙড়েও ঢুকে পড়েছে মাওবাদীরা।
ফলে ভাঙড়ে মাওবাদীদের ইন্ধনে সেখানে জমিবিরোধী আন্দোলন তীব্র হয়েছে বলে সরকারি দলের অভিযোগ।
তাই যেসব এলাকায় বর্তমান বা সাবেক সরকারগুলো উন্নয়নের স্বার্থে জমি অধিগ্রহণ করেছিল, সেই জমির দাম এখন বেড়ে গেছে প্রচণ্ডভাবে। ফলে জমিদাতারাও সুপ্রিম কের্টের রায়কে হাতিয়ার করে এবং মমতার জমিবিরোধী আন্দোলনকে হাতিয়ার করে মাঠে নেমে পড়েছেন। যদি নতুন করে জমির মূল্য বা পোষ্যদের চাকরি পাওয়া যায়!
কিন্তু এই জমি অধিগ্রহণবিরোধী আন্দোলন রাজ্যের জন্য কতটা হিত হবে, সেই প্রশ্নও উঠে এসেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। কেউ কেউ বলছেন, এই আন্দোলনের জেরে মার খাবে পশ্চিমবঙ্গের শিল্পোন্নয়নের পথ। পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে দেশ-বিদেশে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছাবে। নিরুৎসাহিত হবেন দেশ-বিদেশের শিল্পপতিরা, পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগে উৎসাহ হারাবেন। আখেরে বাধাগ্রস্ত হবে পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন। কারণ, সরকার যেসব জমি অধিগ্রহণ করে রেখেছে, সেই সব জমিদাতা সিঙ্গুরের পথ ধরে অর্থ ও জমির প্রত্যাশায় প্রহর গুনছেন। অথচ পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের জন্য এমনটা হওয়া ঠিক নয়। যদিও মুখ্যমন্ত্রী এই রাজ্যের শিল্পোন্নয়নের জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছেন। ঘোষণাও দিয়েছেন, রাজ্যে রয়েছে ভূমিব্যাংক। সেখান থেকে শিল্পপতিরা কিনতে পারবেন জমি।
তারপরও থেকে যাচ্ছে কথা। সাহস পাচ্ছেন না অনেক শিল্পপতি এই রাজ্যে শিল্প গড়তে। পাছে ভয়, সেই জমির সাবেক মালিকেরা যদি আবার এক হয়ে বা বিচ্ছিন্নভাবে জমি ফেরতের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন? কারণ, এই আন্দোলনের পথ তো খোদ মুখ্যমন্ত্রী দেখিয়ে গেছেন পশ্চিবঙ্গবাসীকে। আর সেই পথ ধরে সেই আন্দোলন নতুন করে দানা বাঁধছে। যেমনটা বেঁধেছে ভাঙড়ে। ভাঙড়ই আজ হয়ে উঠছে দ্বিতীয় নন্দীগ্রাম বা সিঙ্গুর। যদিও মমতা চাইবেন না তাঁর রাজ্যে আরেকটি সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রাম তৈরি হোক। তাই তো ভাঙড় আন্দোলনকে সূতিকাগারেই যবনিকা টানতে চান মমতা। পারবেন কি মমতা, সেই প্রশ্নটাই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
অমর সাহা, প্রথম অলোর কলকাতা প্রতিনিধি।