শিক্ষা

সাহিত্যে সৃষ্টিছাড়া সৃজনশীলতা

আমার মায়ের মুখে প্রথম ‘সৃষ্টিছাড়া’ শব্দটি শুনেছিলাম সেই শৈশবে। দুষ্টুর শিরোমণি হিসেবে এই অভিধা জুটেছিল আমার। বড় হয়ে এ শব্দটির দ্ব্যর্থবোধকতা অনুধাবন করে আমি চমকে উঠেছিলাম। এর একটি অর্থ ‘যে বা যা কোনো কিছু সৃষ্টি করে না বা করতে পারে না’ (মা বোধকরি এই অর্থেই আমাকে বুঝিয়েছিলেন); আর অন্যটি হলো ‘স্বয়ম্ভু বা যার কোনো স্রষ্টা নেই’। আজকের পাঠ্যপুস্তকে, বিশেষ করে বিষয় হিসেবে ‘বাংলা’য় যে সৃজনশীলতার প্রয়োগ দেখতে পাচ্ছি, তাকে তাই অভিহিত করছি ‘সৃষ্টিছাড়া সৃজনশীলতা’ বলে। এই সৃষ্টিছাড়া সৃজনশীলতার মধ্যে আমরা যে প্রজন্ম পাব, তারা কি সত্যিই সৃষ্টিশীল হয়ে উঠবে, নাকি হবে সৃষ্টিছাড়া?

‘“বলাই” ছোটগল্পের লেখক কে?’ এর উত্তর হবে: ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। কোনো পরীক্ষার্থী যদি ‘রবিন্দ্রনাত টাকুর’ লেখে অথবা শুধু ‘ড়বিন্দ্রণাত’ এ ধরনের বানানেও লেখে, তারপরও তাকে সম্পূর্ণ নম্বর অর্থাৎ ১-এ ১ নম্বর দিতে হবে

অনেক আশা নিয়ে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষানীতির প্রতি মানুষ তাকিয়ে ছিল। সরকারের নিরলস প্রচেষ্টা ও আর্থিক প্রণোদনায় বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীরা বিনা মূল্যে সব বই পাচ্ছে, উপবৃত্তি লাভ করছে, মেয়েরা পড়ছে বিনা বেতনে, শ্রেণিকক্ষ ডিজিটাল করার প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়েছে, ভৌত কাঠামোর উন্নয়ন ঘটছে, এমনকি শিক্ষকদের বেতনও বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের এই উদ্যোগ ‘প্রকৃত শিক্ষা’র বিস্তার না ঘটলে সাফল্যের মুখ দেখবে না। এই যে ‘প্রকৃত শিক্ষা’ তার কী অবস্থা? প্রশ্ন উঠেছে, ‘সৃজনশীলতা’র নামে এখন যে ‘রেডিমেড’ উত্তর লিখন পদ্ধতির প্রবর্তন হয়েছে, তা সত্যিই কি ‘সৃজনশীল’? যাঁরা এই সৃজনশীল ধারার উদ্গাতা, তাঁরা কি ভেবে দেখেছেন যে বিষয় হিসেবে ‘বাংলা’র সৃজনশীলতা আর ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’-এর সৃজনশীলতা এক নয়? বাংলা বা ইংরেজি বিষয়ে যেখানে ভাষার দক্ষতা অর্জন ও প্রকাশের সুযোগ রাখার প্রয়োজন ছিল, সেখানে এই সৃজনশীলতার ছাঁচে এর সামান্যটুকুও দেখানোর জো নেই। তাই প্রশ্ন জাগে, সব বিষয়ের জন্যই এক মাপের উত্তর লেখার যে ‘রেডিমেড’ ব্যবস্থা, তা কতটুকু বাস্তবসম্মত?
প্রথমেই বলা যাক প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষায় ‘যোগ্যতাভিত্তিক’ প্রশ্নের ব্যাপারে। এই ‘যোগ্যতাভিত্তিক’ প্রশ্নকেই প্রাথমিক-উত্তর পর্যায়ে অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে সৃজনশীল ধারার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। সৃজনশীল ধারার প্রবর্তকগণ একটি সরব স্লোগান দিয়ে থাকেন এই বলে যে ‘মুখস্থকে না বলুন’। এই স্লোগানের কারণে এখন বাংলা কবিতা মুখস্থ করার ব্যাপারটি আর নেই; আছে পুনর্বিন্যাস। আগে আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে কবিতার পর কবিতা মুখস্থ করতাম। সেই কবিতা এখনো আমাদের মনে আছে। নানা আয়োজনে, অনুষ্ঠানে বা ছোটদের মনে রেখাপাত করতে এখনো আমরা ছোটবেলার সেই কবিতা মুখস্থ আওড়াই। এখন শিক্ষার্থীদের কবিতা মুখস্থ করতে হয় না। পরীক্ষার প্রশ্নে কবিতার কয়েকটি মাত্র (এখন মাত্র ছয়টি) চরণ এলোমেলো করে দেওয়া থাকে, সেগুলো পুনর্বিন্যাস করতে হয়। ফলে, প্রায় সবাই কবিতার শেষ শব্দগুলো খেয়াল রাখে, পরীক্ষার সময় বুদ্ধি করে লিখে দেয়। মুখস্থকে ‘না’ বলার নামে এই যে বাংলা ও ইংরেজি কবিতা মুখস্থ করা থেকে শিক্ষার্থীদের বিরত রাখা হচ্ছে, তা ছাত্রছাত্রীদের সত্যিই কি সৃজনশীল করবে?
সাহিত্যে শব্দ ও এর বানান খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সৃজনশীল প্রশ্ন কাঠামোয় এই বানান সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে। সৃজনশীল প্রশ্ন কাঠামোয় প্রথম প্রশ্নটিকে বলা হয় ‘জ্ঞানমূলক’। এর জন্য বরাদ্দ থাকে ১ নম্বর। যেমন: ‘“বলাই” ছোটগল্পের লেখক কে?’ এর উত্তর হবে: ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’। কোনো পরীক্ষার্থী যদি ‘রবিন্দ্রনাত টাকুর’ লেখে অথবা শুধু ‘ড়বিন্দ্রণাত’ এ ধরনের বানানেও লেখে, তারপরও তাকে সম্পূর্ণ নম্বর অর্থাৎ ১-এ ১ নম্বর দিতে হবে। এখানে আধা নম্বরও কাটা যাবে নাÑ এমনই নির্দেশ কর্তৃপক্ষের। কারণ কী? সৃজনশীল ধারার উদ্গাতারা বলছেন, পরীক্ষার্থীর ‘জ্ঞান’ আছে প্রশ্ন সম্পর্কে। পরীক্ষার্থী যেহেতু জানে লেখক কে, সেহেতু সে পূর্ণ নম্বর পাওয়ার যোগ্য। প্রিয় পাঠক, আপনি কী বলেন? ‘জ্ঞান’ মানে কি শুধু মুখে উচ্চারণ? ঠিকঠাকভাবে তা প্রকাশ করার ক্ষমতা নয়? যদি তা না হয়, তাহলে তো বাসার ময়না বা টিয়ে পাখিটিও ‘মহাজ্ঞানী’; সেটাও ১-এ ১ পেতে পারে! এই ময়না বা টিয়ে পাখির জ্ঞান দিয়ে কী করবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম?
এরপর আছে ‘অনুধাবন’ ও ‘প্রয়োগ’ পর্যায়। এটিও কাঠামোবদ্ধ। নির্দিষ্ট বাক্যের বেশি লেখা নিষিদ্ধ। পরের বা শেষ ধাপটির নাম ‘উচ্চতর প্রয়োগ দক্ষতা’। এটিও মোটামুটি নির্ধারিত। শুধু তা-ই নয়, এখন অনুচ্ছেদে তো বটেই, রচনা বা প্রবন্ধ লেখার ক্ষেত্রেও শব্দ উল্লেখ করে আয়তন বেঁধে দেওয়া হয়। অথচ কে না জানে, সাহিত্য শুধু ‘বিষয়’ নয়, এর ‘প্রকাশ’ও। বরং বলা চলে, ‘প্রকাশই সাহিত্য’। একই বিষয় নানাজন নানাভাবে লিখবে, এটাই কাম্য। আর এই প্রকাশের ভিন্নতায় শিক্ষার্থী তাদের স্বকীয়তা প্রদর্শন করতে পারে, অতীতে তা-ই হয়েছে। ভবিষ্যতে যাঁরা সাহিত্যে অবদান রাখবেন, তাঁরা ছাত্রজীবনে হাত পাকাবেন, এমনকি সাহিত্যের খাতাতেও যে ছাপ রাখবেন, এটাই তো প্রার্থিত। এখন সাহিত্যে দেড় শ বা দুই শ শব্দের পরিধি বেঁধে দেওয়া হবে, আবার বলা হবে সৃজনশীলতা দেখাতে, এটি কি পরস্পরবিরোধী নয়?
‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’, ‘বিজ্ঞান’, ‘ধর্ম’ ইত্যাদি বিষয়ের সৃজনশীল ধারার সঙ্গে সাহিত্যের সৃজনশীল ধারার যে পার্থক্য আছে, তা কর্তৃপক্ষের বুঝতে হবে। তাদের অনুধাবন করতে হবে, উচ্চারণ কাছাকাছি হলেও ‘তাল’ আর ‘তালা’ এক নয়। সাহিত্যের তালকে অন্য বিষয়ের তালা দিয়ে বন্ধ করলে ভুল হবে। চলমান সৃষ্টিছাড়া সৃজনশীলতার ধারা অব্যাহত থাকলে আমরা ভবিষ্যতে যে প্রজন্ম পাব, সে প্রজন্ম না জানবে একটি বাংলা বা ইংরেজি কবিতা সম্পূর্ণভাবে মুখস্থ বলতে, না জানবে ঠিক বানানে লেখকের নাম বা রচনার শিরোনাম যে লিখতে হয়, এই মৌলিক বিষয়টি পর্যন্ত। আর আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পনার বর্ণিল গগনে ভাষার রঙিন কাগজে সৃষ্টির ঘুড়ি ওড়ানোর খেলা সে খেলতে পারবে না কখনো। যদি তা না-ই হলো তাহলে একে কী বলব আমরা? দেড় শ শব্দের ‘রেডিমেড’ সৃজনশীলতা; যা কার্যত সৃষ্টিহীন ও দৃষ্টান্তরহিত! সাহিত্যে এই প্রক্রিয়া সত্যি এক সৃষ্টিছাড়া উদ্ভাবন।
সৌমিত্র শেখর: নজরুল-অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।