সাহেদ গং এবং টক শো হোস্টদের দায়

মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম। ফাইল ছবি
মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম। ফাইল ছবি

টক শো নিয়ে বিবিধ ঘটনা আছে আমার জীবনে। বছর দশেক আগের একটা ঘটনা বলি। শেয়ারবাজারে ধস নিয়ে তখন তুলকালাম কাণ্ড চলছে দেশে। কারা আছে এর পেছনে, আভাসে ইঙ্গিতে তা বলা হচ্ছে পত্রিকায়। রাতে এক টক শোতে আমি স্পষ্ট করে সন্দেহভাজন পাঁচজনের নাম বললাম। তাঁরা খুবই ক্ষমতাশালী ও অর্থবান মানুষ। কিছুদিনের মধ্যে একে একে তাঁদের তিনজন যোগাযোগ করলেন আমার সঙ্গে। দেখা করে বোঝাতে চাইলেন যে তাঁরা আসলে দায়ী না এ জন্য। তাঁদের করুণ অবস্থা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। টক শো এত শক্তিশালী হয়ে গেছে বাংলাদেশে!

টক শোতে তখন নিয়মিত অংশ নিতাম। অংশ নিতেন আসাফ-উদ-দৌলা, ব্যারিস্টার রফিকুল হক, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, পিয়াস করিম, নুরুল কবীর, আমেনা মোহসীন, শ্যামল দত্ত, নঈম নিজাম প্রমুখ। টিভি চ্যানেলে টক শোর সংখ্যা তখন কম ছিল, বাক্‌স্বাধীনতা খুব বেশি রুদ্ধ ছিল না, মামলার যন্ত্রণাও ততটা ছিল না। মূলত ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের পর থেকে অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হতে থাকে। পুরোনো অনেককে বিভিন্নভাবে বাদ দিতে বা কম আনতে চাপ দেওয়া হয়। অন্যদিকে টক শোতে এসে ভিড় করে সরকারের কার্যক্রমে মুগ্ধ মানুষজন। একপক্ষীয় আলোচনার কারণে এর জনপ্রিয়তা কমে যায়।

আমি নিজে টক শো দেখতাম মাঝেমধ্যে। কিন্তু একটা সময়ের পর আর তা দেখার আগ্রহ থাকেনি। টক শোতে যাঁরা আসতেন তাঁদের অনেককে নামে পর্যন্ত চিনতাম না। বহুল বিতর্কিত রিজেন্ট হাসপাতালের মো. সাহেদ তাঁদের একজন। এ নামে যে একজন কেউ আছেন, তিনি নিয়মিত আসতেন টক শোতে, এ সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না আমার।

যা-ই হোক, পরে তাঁর কাণ্ডকীর্তি সবই জানা হয়েছে আমাদের সবার। অনেকে তাঁর প্রতি রুষ্ট হয়েছেন, অনেকে তাঁর কর্মকাণ্ডে হতবাক হয়েছেন। আমি দ্বিতীয় মানুষদের দলে। আমি জানতাম টক শো করলে মানুষ মামলা খায়, হয়রানির সম্মুখীন হয়, জনগণ খুশি হলেও সরকার রুষ্ট হয়। সরকারের পক্ষে যাঁরা বলেন, তাঁদের বড়জোর বৈধ কিছু সুবিধা হয়। যেমন: রাজনীতিক হলে দলের নেতার সুদৃষ্টি পড়ে, সম্পাদক হলে তাঁর পত্রিকা সরকারি বিজ্ঞাপন পায়, ব্যবসায়ী হলে ব্যবসা নিরাপদ থাকে—এ রকম। কিন্তু টক শো করলে যে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা কামানো যায়, দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মেয়ের বিয়ের দাওয়াতে যাওয়া যায়, এরে-তারে হুমকি দিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা যায়—সাহেদের ঘটনার আগে এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না।

২.
মো. সাহেদের অপরাধবৃত্তির জন্য তাই এখন টক শো হোস্টদেরও দায়ী করা হচ্ছে। টক শোতে সুযোগ পাওয়ার কারণে কেউ কেউ দাপুটে একটা ভাব ধরে চলতে পারত এবং সহজে মানুষকে প্রতারণা করতে পারত, এ ধরনের অভিযোগ করা হচ্ছে। তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন টক শো হোস্ট এবং সহ-আলোচকদের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কয়েক দিন আগে এটি নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছিঃ ছিঃ করার মানুষও বেড়েছে।

তবে কেউ কেউ আবার গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছেন। যেমন মো. সাহেদকে যদি গণভবন আর বঙ্গভবনে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা যায়, তাহলে তাঁকে টিভিতে আনতে দোষ কী! টক শো হোস্টদের কি দায়িত্ব রয়েছে তাঁরা কাদের ডাকবেন সে বিষয়ে নিজে থেকে খোঁজখবর করার? রাষ্ট্র নিজে ব্যবস্থা না নিলে এটি কতটুকু সম্ভব তাঁদের পক্ষে? কেউ কেউ আবার বলছেন, এ রকম বহু সাহেদ বা আরও বড় সাহেদরা এখনো টক শোতে আসছেন, তাঁদের কাণ্ডকীর্তি বলার সাহস পর্যন্ত নেই আমাদের, কাজেই শুধু সাহেদের জন্য টক শো হোস্টদের দোষ দিয়ে লাভ কী!

এই বক্তব্যের সারবত্তা অবশ্যই আছে। টক শোতে এমন লোকদেরও দেখা যায়, যাঁদের নাম ব্যাংক লুটপাট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি বা অন্যান্য দুর্নীতিতে উচ্চারিত হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। বহুগুণে ক্ষমতাশালী বলে এঁদের বিরুদ্ধে তেমন তদন্ত হয়নি বা তাঁদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে তদন্তের একপর্যায়ে। করোনা কেলেঙ্কারিতে বিদেশে আমাদের প্রবেশাধিকার ও সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন না হলে হয়তো সাহেদের বিষয়েও সেভাবে তদন্ত হতো না। কাজেই অন্যদের বিষয়ে প্রশ্ন না তুলে শুধু সাহেদকে ডাকার জন্য টক শো হোস্টদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া আসলেই কতটুকু সংগত?

তারপরও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। সেটি হলো: সাহেদের মতো একজন উপকমিটি পর্যায়ের নেতাকে বঙ্গভবনে দেখা গেলেই ডাকতে হবে কেন? আর ডাকতেই যদি হয়, তাহলে টক শো প্ল্যাটফর্মকে কেন তাঁর নিজের সুবিধামতো ব্যবহার করতে দেওয়া হবে? গত নির্বাচনের আগে বেশ কয়েকটি টক শোতে তিনি বলেছেন, ‘দেশের সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্রের শীর্ষ থেকে নিম্ন পর্যায় পর্যন্ত সবাই চায় আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসুক।’ এ ধরনের বক্তব্যের পর তাঁকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, সেনাবাহিনী বা আমলাদের এ দৃষ্টিভঙ্গির কথা তিনি কীভাবে জানলেন? টক শো হোস্টরা বুদ্ধিদীপ্ত, যৌক্তিক ও জ্ঞানগর্ভ প্রশ্ন করলে মো. সাহেদের মতো লোকদের তো ভয়েই সেখানে আসার কথা না!

আমার অন্য প্রশ্নটি আরও গুরুতর। পত্রিকা পড়ে জেনেছি, তিনি নাকি টক শোতে সরকারের পক্ষে এভাবে কথা বলতেন দেখেই তাঁর প্রতাপ দেখাতে পারতেন। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা নেওয়া হতো না, দণ্ডাদেশ কার্যকর হতো না, প্রতারণা মামলাগুলোর তদন্ত হতো না। এগুলো সত্যি হলে তো বলতে হবে, দেশে আইনের শাসন বলতে কিছুই নেই আসলে! একটা লোক শুধু সরকারের পক্ষে কথা বলার কারণে দেশের পুলিশ, গোয়েন্দা আর বিচারালয় এত বছর ধরে উপেক্ষা করে গেছে তাঁর সব অপরাধ? আর সরকারের গুণকীর্তন করেই যদি আইনের ঊর্ধ্বে থাকা যায়, তাহলে যাঁরা নিজেরা সরকারে আছেন, তাঁরা কি দায়মুক্তি ভোগ করছেন এ দেশে?

৩.
সাহেদের পেছনে কারা আছেন তার তদন্ত চাইছেন কেউ কেউ। আমার মতে সেটা সমস্যার লক্ষণমাত্র। মূল সমস্যা হচ্ছে জবাবদিহি না থাকার, অস্বচ্ছতার, বিচারহীনতার। শুধু সাহেদের বিচার না, এ জন্য যেকোনো অন্যায়কারীর বিচার করতে হবে। আমাদের সংবিধান আর আইন তা-ই বলে। টক শোতে একটু স্তবকতা করে আর হোমরাচোমরাদের সঙ্গে ছবি তুলে যদি খোদ সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখানো যায়, তাহলে বলতে হবে খুব অরাজক একটা অবস্থা বিরাজ করছে এখন দেশে।

শক্তভাবে আইনের শাসন প্রয়োগ ছাড়া এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ নেই। এটি প্রয়োগের মতো নৈতিক দৃঢ় বল শাসকদের থাকতে হয়। মূল দায় তাদের।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক