১৯৯৪ সালে ইংল্যান্ডে পড়তে গিয়ে আমি একটা বিষয় বুঝতে পারি। সেটি হচ্ছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বা লিভারপুল শুধু নয়, সেখানে আরও অনেক ক্লাব খুবই জনপ্রিয়, সম্পদশালী ও ঐতিহ্যবাহী। ১২৯ বছরের পুরোনো নিউক্যাসল ফুটবল ক্লাব হচ্ছে এ রকম কিছু। ১৯৯২ সালে প্রিমিয়ার লিগ চালু হওয়ার পর আক্রমণাত্মক ও গতিময় খেলা খেলে তারা মন জয় করে নেয় বহু ‘নিরপেক্ষ’ দর্শকের, এমনকি একসময় আবাহনী ফুটবল ক্লাবের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত আমার মতো ফুটবল পাগলেরও। ১৯৯৫ সালে তারা রানার্সআপ হয় বছরের প্রায় পুরোটা সময় শীর্ষে থেকে, ইউরোপে খেলার যোগ্যতা অর্জনও ছিল ক্লাবটির জন্য ডালভাতের মতো।
পরে ইংলিশ ফুটবলে রাশান ‘মাফিয়া মানি’ (চেলসি ফুটবল ক্লাব), আবুধাবির পেট্রোডলার (ম্যানচেস্টার সিটি) আর আমেরিকান পুঁজিপতি (ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড) পরিবারের বিত্তের ঢল নামলে পিছিয়ে পড়ে নিউক্যাসল। গত ১০ বছরে এমনকি দুবার রেলিগেশনের শিকার হয়ে পড়ে তারা। এর পাশাপাশি ছিল ক্লাবের ব্যবস্থাপনায় তখনকার মালিক মাইক অ্যাসলের কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও অর্থ খরচে কাপর্ণ্য। নিউক্যাসলের সমর্থকেরা প্রাণপণে কামনা করেছেন বিশাল অর্থবিত্তের নতুন কোনো মালিকানার, বারবার বলেছেন জিততে নয়, অন্তত স্বপ্ন দেখার দুঃসাহসটা ফেরত চাই আমরা।
তাঁদের প্রায় দেড় যুগের অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। নিউক্যাসলের ৮০ শতাংশ মালিকানা কিনে নিয়েছে সৌদি আরবের ‘সেভিং অ্যাকাউন্ট’ হিসেবে পরিচিত পিআইএফ (পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড), যার প্রধান হচ্ছেন স্বয়ং সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। পিআইএফের অর্থবিত্ত আবুধাবি আর ফ্রান্সের পিএসজি কিনে নেওয়া কাতারি প্রতিষ্ঠানের চেয়েও অনেক বিশাল (২৫০ বিলিয়ন পাউন্ড), নিউক্যাসল ক্লাব ৩০০ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে কেনাটা মাত্র সূচনার বিনিয়োগ তাদের। যাঁরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী সালমানকে চেনেন, তাঁরা জানেন এমবাপ্পে, হরল্যান্ড, লেভা, ফনডাইক বা জর্জিনহো মাপের খেলোয়াড়দের না কিনে ছাড়বেন না তিনি থামবেন না ইউরোপের ফুটবল পরাশক্তি না হওয়া পর্যন্ত।
সমস্যা হচ্ছে সালমান শুধু উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়, একজন নির্মম মানুষ হিসেবেও পরিচিত। তাঁর দেশ সৌদি আরবের মানবাধিকার রেকর্ডও খুব খারাপ। সালমানের এ বিনিয়োগপ্রক্রিয়ায় আপত্তি করেছে ইংল্যান্ডের অন্য ক্লাবগুলো, সমালোচনায় মুখর হয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো প্রতিষ্ঠান। মানবাধিকারসচেতন বহু মহলের আশঙ্কা, সালমানের এ বিনিয়োগ হচ্ছে ‘ফুটবল ওয়াশিং’, ফুটবলের জনপ্রিয়তা আর প্রভাবের প্রলেপে নিজের কুখ্যাতি ঢাকার চেষ্টা, আরও প্রতাপশালী ও স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া।
ফুটবল ওয়াশিংয়ের এমন উদাহরণ আমরা দেখি ইউরোপের আরও বহু দেশে। এর পাশাপাশি আছে দেশি বিনিয়োগে কুখ্যাতি ঢাকার চেষ্টাও, যা আমরা দেখি আমাদের খেলাধুলার সীমিত বাজারের এ দেশেও। এ ছাড়া ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিকসহ কল্যাণমূলক বহু কাজে অর্থ ঢেলে নিজের অতীতকে জায়েজ করার চেষ্টা দেখি আমরা নানাভাবে। নিউক্যাসলের টেকওভার ঘটনা হয়তো আমাদের অনেকের মধ্যে এসব নিয়ে কিছুটা হলেও আত্মবিশ্লেষণের অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছে। তাগিদ সৃষ্টি করেছে বিনিয়োগকারীর ট্র্যাকরেকর্ড নিয়ে ভাবার ন্যায্যতা নিয়ে।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান শুধু উচ্চাকাঙ্ক্ষী নয়, একজন নির্মম মানুষ হিসেবেও পরিচিত। তাঁর দেশ সৌদি আরবের মানবাধিকার রেকর্ডও খুব খারাপ। ইংলিশ ফুটবলে সালমানের বিনিয়োগপ্রক্রিয়ায় আপত্তি করেছে ইংল্যান্ডের ক্লাবগুলো, সমালোচনায় মুখর হয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো প্রতিষ্ঠান। মানবাধিকারসচেতন বহু মহলের আশঙ্কা, সালমানের এ বিনিয়োগ হচ্ছে ‘ফুটবল ওয়াশিং’, ফুটবলের জনপ্রিয়তা আর প্রভাবের প্রলেপে নিজের কুখ্যাতি ঢাকার চেষ্টা।
মানবাধিকার লঙ্ঘন পরিমাপের সহজ একটি মানদণ্ড হচ্ছে মৃত্যুদণ্ডের হিসাব। জনসংখ্যার হার হিসেবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড চীনে হয় এটা অনুমিত, কিন্তু এর সঠিক হিসাব পাওয়া কঠিন। চীন বাদে পৃথিবীতে যত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রেকর্ড আছে, তার মধ্যে ৮৮ শতাংশ ঘটে মাত্র চারটি দেশে। সৌদি আরব তার মধ্যে একটি। সেখানে মৃত্যুদণ্ডের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে আবার সংখ্যালঘু শিয়াদের সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি। সৌদি আরবে ভিন্নমতের সুযোগ নেই, নারীদের অধিকার খুব সীমিত এবং জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিপীড়িত।
এত কিছুর পরও সৌদি আরবের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বাদবাকি বিশ্বের যথেষ্ট মাথাব্যথা ছিল না, পেট্রোডলার, আমেরিকান প্রশ্রয় ও ধর্মীয়ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো সেখানে থাকার কারণে। তবে ২০১৯ সালে তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে ভিন্নমতালম্বী সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে পরিকল্পিত ও নৃশংসভাবে হত্যা ও লাশ গুম করার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। খাসোগিকে হত্যার জন্য সালমানকে বাদ রেখে লোকদেখানো বিচার হয়েছে সৌদি আরবে। কিন্তু ২০১৯ সালে জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ারের একটি প্রতিবেদনে এতে যুবরাজ সালমানের জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে বলা হয়। দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করা ও বিদেশে আরও কিছু ভিন্নমতালম্বীকে হত্যা করার অভিযোগও আছে তাঁর বিরুদ্ধে। সৌদি নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দিয়ে সালমান একটা শোর তুলেছিলেন একসময়, কিন্তু দূতাবাসের ভেতর খাসোগিকে করাত দিয়ে কেটে টুকরা টুকরা করার নৃশংসতম বিবরণ যাঁরা কিছুটা হলেও জানেন, তাঁদের অনেকের কাছে সালমানকে ক্ষমা করা অসম্ভব হয়ে ওঠে।
তবে ব্রিটিশ ফুটবল দল নিউক্যাসল কিনে নেওয়ার ঘটনা এ জন্য ঠেকিয়ে দেওয়া যায়নি, এটি বদলে দেওয়াও যাবে না হয়তো কখনো। নিউক্যাসলের স্থানীয় সমর্থকেরা সালমানের বিশাল বিনিয়োগে নতুন দিনের সম্ভাবনায় বরং উচ্ছ্বসিত। সালমানের পক্ষে এমন কথাও বলা হচ্ছে যে অল্প হলেও তাঁর নেতৃত্বাধীন পিআইএফের বিনিয়োগ রয়েছে ডিজনি, উবার, ফেসবুক, ফাইজার, স্টারবাকসে্র মতো প্রতিষ্ঠানে, যার কোনো না কোনোটির ভোক্তা পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষ।
পিআইএফ ভবিষ্যতে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে সৌর ও বায়ুবিদ্যুতের মতো দূষণমুক্ত জ্বালানি খাতে। ভবিষ্যতে এসব খাতের বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে। সালমান সে বিবেচনায়ই হয়তো বিনিয়োগ করবেন সেখানে। নিউক্যাসল ক্লাব কিনে নেওয়ার পর নর্থ-ইস্ট ইংল্যান্ডে বায়ুবিদ্যুতে বিনিয়োগে তাঁর নেটওয়ার্কিংয়ের সুযোগও বেড়েছে।
সালমানকে ঠেকানো হয়তো সম্ভব হবে না। জামাল খাসোগিকে করাত দিয়ে কাটার শব্দের অনুরণন একসময় হারিয়ে যেতে পারে চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদ বা বায়ার্ন মিউনিখের বিরুদ্ধে তাঁর ক্লাব নিউক্যাসলের জয়ের উল্লাসে। সালমানকে দেখা যেতে পারে একদিন জলবায়ু পরিবর্তনের যুদ্ধে চ্যাম্পিয়ন হিসেবেও। কিন্তু তাই বলে অতি জনপ্রিয় নিউক্যাসলে তাঁর বিনিয়োগ বা ইন্টার মিলানে তাঁর ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন করা থামাচ্ছে না কিছু মানুষ। কারণ, এটি নৈতিকতার প্রশ্ন, জয় বা বিজয়ের নয়।
বিনিয়োগকারীদের নিয়ে প্রশ্ন করা পাশ্চাত্যে নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে, তাঁদের মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় জনকল্যাণকর কোনো কাজে অর্থায়নের সময়ও। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের মতো দেশে এটি তোলা হয় না প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই। ফুটবল ক্লাব থেকে শুরু করে ধর্মীয় কোনো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ, অর্থায়ন বা চাঁদা এলেই আমরা খুশি হয়ে উঠি, অতীত ভুলে অর্থদাতার বন্দনায় মেতে উঠি কখনো কখনো। সমিতি, সংগঠন বা ক্লাবে কোনো অনুদান পেলে, কোনো পুরস্কার প্রবর্তন হলে, কোনো একটা কল্যাণ ভাতা এলে আমরা ভুলেও ভেবে দেখি না এটি গ্রহণ করার ন্যায্যতা। এভাবেই আমরা সমাজের শিরোমণি করে রেখেছি দুর্নীতিবাজ, অপরাধী, ভূমিদস্যু, মাদক ব্যবসায়ী অনেক মানুষকে।
নিউক্যাসল ক্লাবের সমর্থকদের ক্ষেত্রেও হয়তো তা–ই হতে চলেছে, কিন্তু সেখানে অন্তত প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অন্তত এ নিশ্চয়তা নেওয়া হয়েছে যে নিউক্যাসল পরিচালনার বিষয়ে থাকবে না সৌদি রাষ্ট্রের কোনো হস্তক্ষেপ। এটুকু হয়তো সামান্য, কিন্তু গুরুত্বহীন নয়।
এ সামান্য চর্চার গুরুত্ব আমরাও ভাবতে পারি।
● আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক