সার্চ কমিটি: পাঁচজন ত্রাতা বা খলনায়কের খোঁজে

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন কমিশন হয়েছে, কোনোটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়
ছবি : প্রতীকী

২০২৩ সালে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করবেন ২০ ডিসেম্বর। প্রথম দিনই আমন্ত্রণ পেয়েছে জাতীয় পার্টি। সৌভাগ্যই বটে তাদের। এরশাদ প্রতিষ্ঠিত যে দলকে নব্বইয়ে জনগণ আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল, সেই দল বেশির ভাগ সময়ই ক্ষমতার হিস্যা নিচ্ছে, সরকারে থেকে বা সংসদে বিরোধী দলের আসন নিয়ে।

২০১২ ও ২০১৭ সালেও সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছিল। এটি প্রক্রিয়া হিসেবে মন্দের ভালো হলেও ফলাফল হয়েছে বিষময়। সার্চ কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া হলো রাষ্ট্রপতি প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে তাদের প্রস্তাবিত নাম জানতে চাইবেন। পরবর্তী সময় সেসব নাম থেকে চূড়ান্ত তালিকা করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করবেন, যারা প্রস্তাবিত নাম যাচাই-বাছাই করে একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা ফের পাঠাবে রাষ্ট্রপতির কাছে।

সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের কথা উল্লেখ আছে। এতে বলা হয়েছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’

কিন্তু গত ৫০ বছরে কোনো সরকারই এ আইন করার উদ্যোগ নেয়নি। কে এম নূরুল হুদা কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে। এই প্রেক্ষাপটে বিরোধী দল বিএনপি ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশন আইন প্রণয়নের দাবি জানানো হয়েছিল। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে খসড়া আইনের একটি কপিও দিয়েছিল। কিন্তু তিনি বলেছেন, এই সময়ের মধ্যে আইন করা সম্ভব হবে না। ভবিষ্যতে আইনের কথা ভাবা যাবে। এই প্রেক্ষাপটেই ২০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছেন।

প্রশ্ন হলো রাষ্ট্রপতির সংলাপে নিবন্ধিত সব দল যাবে কি না? বিশেষ করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আগে থেকেই বলে দিয়েছে, তারা দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না। সার্চ কমিটিও মানবে না। ২০১৭ সালে নির্বাচন কমিশন গঠনের সময়ও বিএনপি অনুরূপ দাবি করেছিল। এরপরও তারা সংলাপে গিয়েছিল এবং তাদের কথা বলে এসেছিল। এবার দৃশ্যপট ভিন্ন। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত (নির্বাহী আদেশে তাঁর কারাদণ্ড স্থগিত আছে) এবং বিদেশে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও দণ্ডিত। তবে বিএনপি সরাসরি সংলাপ নাকচ করেছে, তা-ও নয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে সংলাপের চিঠি পেলে দলের স্থায়ী কমিটিতে এ নিয়ে আলোচনা হবে। বিএনপি সংলাপে যাবে কি না, সেটা বৈঠক করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন কমিশন হয়েছে, কোনোটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। পরাজিত দল সব সময়ই তাদের হেরে যাওয়ার জন্য কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আবার যারা বিজয়ী হন, তারা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আগে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাই কমিশনের প্রধান হতেন। কিন্তু বিচারপতি সাদেক আলীর নেতৃত্বাধীন কমিশন একতরফা ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার পর সাবেক আমলারা এর দায়িত্ব নেন এবং তাঁরা কয়েকটি নির্বাচন করতে পেরেছে।

বিএনপি সংলাপে না গেলে ২০-দলীয় জোটের অন্য শরিকদেরও না যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে আহূত সংলাপে স্বাভাবিকভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের শরিক কিংবা জাতীয় পার্টির উৎসাহ থাকবে। তারা চাইবে নিজেদের পছন্দের লোকদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হোক। যেমনটি হয়েছে গত দুটি নির্বাচন কমিশন। কে এম নূরুল হুদা কমিশনের পাঁচ সদস্যের একজনের নাম বিএনপি থেকে এসেছিল বলে জানা যায়। বাকি চারজন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগীদের তালিকা থেকে।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন কমিশন হয়েছে, কোনোটি বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। পরাজিত দল সব সময়ই তাদের হেরে যাওয়ার জন্য কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। আবার যারা বিজয়ী হন, তারা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আগে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরাই কমিশনের প্রধান হতেন। কিন্তু বিচারপতি সাদেক আলীর নেতৃত্বাধীন কমিশন একতরফা ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার পর সাবেক আমলারা এর দায়িত্ব নেন এবং তাঁরা কয়েকটি নির্বাচন করতে পেরেছে। বিএনপি সরকার ফের বিচারপতি এম এ আজিজের নেতৃত্বে কমিশন করলেও তারা কোনো জাতীয় নির্বাচন করতে পারেনি। এরপর সেনাসমর্থিত সরকার এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন গঠন করে। তাদের অধীনে নবম সংসদ নির্বাচন দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছিল।

নির্বাচন কমিশনের কাজ কী? সংবিধান বলছে, ‘রাষ্ট্রপতি পদের ও সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অনুরূপ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকিবে এবং নির্বাচন কমিশন এই সংবিধান ও আইনানুযায়ী ক. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করিবেন; খ, সংসদ সদস্যদের নির্বাচন করিবেন; গ. সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত করিবেন এবং ঘ. রাষ্ট্রপতির পদের এবং সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুত করিবেন।’

ভোটার তালিকা নিয়ে নয়ছয় হওয়ায় এম এ আজিজ কমিশন নির্বাচনই করতে পারেনি। এখন নির্ভুল ভোটার তালিকা আছে। কিন্তু ‘ভোট নেই’। ভোটার ভোটকেন্দ্রে না গলেও অদৃশ্য ছায়া ভোট দিয়ে যায়। সার্চ কমিটির মাধ্যমে গঠিত বর্তমান নুরুল হুদা কমিশন দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাটিকে যেভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে, তা থেকে উত্তরণের উপায় কী? তাই, কোন প্রক্রিয়ায় কমিশন গঠিত হলো, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কাদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে এবং তারা দেশবাসীকে কী ধরনের নির্বাচন উপহার দেবে?

আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ৫ জন যোগ্য মানুষ অবশ্যই খুঁজে পাওয়া যাবে, যাঁরা জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা করতে পারবেন। তবে যোগ্য মানুষ হলেই হবে না, সেই যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগও থাকতে হবে। জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কোনো দলের সেবক না হয়ে প্রজাতন্ত্রের সেবক হতে হবে।

প্রতি পাঁচ বছর পরপর জাতীয় নির্বাচন (স্থানীয় সরকার নির্বাচনের নামে যা হচ্ছে, সেসব এখানে উল্লেখ করলাম না) ও কমিশন নিয়ে এই বিতর্ক কি প্রমাণ করে না জনগণের প্রতি আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কোনো আস্থা নেই। বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় থাকেন। বিরোধী দলে থাকতে ভোটাধিকারের জন্য মায়াকান্না, কত আন্দোলন সংগ্রাম! একসময় নির্বাচনে দেশে পেশিশক্তি ও কালো টাকার বিষয়টি বেশ আলোচিত ছিল। এখন সেই স্থান নিয়েছে ‘পদ্ধতিগত কারচুপি।’ জনগণ ভোট দিক বা না দিক, কেন্দ্রে যাক বা না যাক, যেকোনো মূল্যে জয়ী হতে হবে।

আমরা এ বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন করছি। কিন্তু নির্বাচনী বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা প্রকাশ্যে না হলেও ব্যক্তিগত আলাপে নির্বাচনে কারচুপির কথা স্বীকার করেন। পাল্টা প্রশ্ন করেন: সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে কি আপনারা ফের মৌলবাদী, শক্তিবাদী ও জঙ্গিবাদী শক্তিকে ক্ষমতায় আনতে চান? সুষ্ঠু নির্বাচন হলে যে মৌলবাদী শক্তি ক্ষমতায় আসতে পারে না, তার প্রমাণ তো এ দেশের মানুষ সত্তরের নির্বাচনেই দিয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বও তো প্রবল প্রতিকূলতা পেরিয়ে ১৯৯৬ ও ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেছিল। ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে যদি মৌলবাদী শক্তি ক্ষমতায় আসে, সেই ব্যর্থতা আওয়ামী লীগেরই। একটানা ১৩ বছর ক্ষমতায় থেকে তারা কাদের দিন বদল করেছে? জনগণ যদি বুঝতে পরে এই দল বা নেতা তাদের কল্যাণে কাজ করবেন, তাহলে তারা সেই দলকে ভোট দেবে। আর যদি বুঝতে পারে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে সবকিছু করছে, জনগণ তাহলে অবশ্যই মুখ ফিরিয়ে নেবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় ন্যায়ের শক্তি দিয়ে। অপরাজনীতিকে পরাস্ত করতে হয় বৃহত্তর জনগণের কল্যাণের রাজনীতি দিয়ে।

আরেকটি কমিশন গঠনের আগে সরকারকে বলতে হবে, নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংসের দায় কার? নির্বাচন কমিশনের পদাধিকারীদের, নাকি যারা তাদের নিয়োগ দিয়েছে তাদের? গেল দুই বার সার্চ কমিটির মাধ্যমে দেশবাসী ভোটের ত্রাতা খুঁজতে গিয়ে পাঁচজন করে খলনায়ক পেয়েছে। তৃতীয়বার কি সত্যি আমরা কোনো ত্রাতাকে খুঁজে পাব, যারা মানুষের ভোটাধিকার রক্ষা করতে পারবেন?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি।

sohrabhassan55@gmail.com