অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তাঁর ফেসবুক পেজে নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশন নিয়ে কিছু বিবেক জাগ্রত হওয়ার কথা বলেছেন। তিনি সাধারণত গণমাধ্যম এড়িয়ে চলেন, সাংবাদিকেরা অনেক চেষ্টা করেও সাক্ষাৎকার নিতে পারেন না। আবার জাতীয় কোনো সংকট মুহূর্তে নিজ থেকে বিবৃতি দেন, কথা বলেন। ৬ ফেব্রুয়ারি ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ ফেসবুকে যে কথাগুলো বলেছেন, তা মোটেই গতানুগতিক নয়। কথার কথা হিসেবেও এগুলো তিনি লিখেননি। দেশের একজন সচেতন নাগরিক ও অর্থনীতিবিদ হিসেবে কথাগুলো লিখেছেন। আমরা আসলে কেউ রাজনীতির বাইরে নই।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ লেখেন: ‘নির্বাচন কমিশন গঠন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কারণ, এটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রথম ধাপ এবং দেশে বিশ্বাসযোগ্য শক্তিশালী জাতীয় প্রতিষ্ঠান গঠন আদৌ সম্ভব কি না, তার একটা পরীক্ষাও। অবশ্য নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হতে হবে সেটা আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাতে সন্দেহ নাই।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হিসেবে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্ভবত তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে কথাগুলো লিখেছেন। তিনি জানেন, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকা।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ লিখেছেন, নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের গুনাগুণ কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে নাগরিক সমাজের সংগঠনসমূহ ও নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা তাঁদের সুচিন্তিত মতামত দিচ্ছেন। প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা এবং সেই সঙ্গে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার ওপর তাঁরা যথার্থই গুরুত্ব দিচ্ছেন। এরপরই তিনি লিখেছেন, ‘আমার কাছে আরও কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়: যাঁদের নির্বাচন কমিশনের প্রধান বা সদস্য পদ পাওয়াটা এবং এ ধরনের উচ্চপদের জৌলুশ উপভোগ করাটাই জীবনের পরম প্রাপ্তি বলে মনে হবে না এবং দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠা থাকলেও নিছক উচ্চপদে আসীন হওয়া ছাড়াও জীবনের সফলতার অন্য মাপকাঠিও যাঁদের আছে। এ রকম ব্যক্তিত্বের মানুষেরাই কোনো কারণে দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে পদের মোহ ত্যাগ করে পদত্যাগ করতে দ্বিধা বোধ করবেন না এবং অন্তত ভবিষ্যতের জন্য একটা সঠিক বার্তা রেখে যেতে পারবেন। এ রকম মানুষ নিশ্চয়ই আছেন, তবে তাঁদের খুঁজে বের করতে হলে সার্চ কমিটির সে রকম উদ্দেশ্য থাকতে হবে এবং খোঁজখবর নেওয়ার জন্য একটু কষ্ট স্বীকার করতে হবে।’
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের বক্তব্য ব্যাখ্যা করলে যে সত্যটি বেরিয়ে আসে তা হলো, যাঁরা উচ্চ পদের জৌলুশ ভোগ করবেন না, যাঁরা পদকে বড় করে দেখবেন না এবং দায়িত্ব পালন করতে না পারলে পদ ছেড়ে দিতে দ্বিধা করবেন না, সে রকম ব্যক্তিদেরই নির্বাচন কমিশনে আসা উচিত। তাঁর আশা, এ রকম লোক পাওয়া দুর্লভ নয়, তবে কষ্ট করে সার্চ কমিটিকে খুঁজে বের করতে হবে।
নির্বাচনের দুটি দিক আছে, একটি আইনি ও আরেকটি নৈতিক। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো নৈতিকতা। আইনিভাবে বাংলাদেশে সব নির্বাচনই বৈধ কিন্তু সব নির্বাচন নৈতিক ভিত্তি ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছে, তারা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন লড়াই করেছে। এখন যদি তাদের আমলে সামরিক শাসনামলের চেয়েও খারাপ নির্বাচন হয়, সেটি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্যই লজ্জাজনক।
কথা হলো সার্চ কমিটি সেই কাজটি করতে রাজি আছে কি না। থাকলেও সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কি না। সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতাই নেই। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই তাঁকে সব কাজ করতে হয়। সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, মাজার জিয়ারত ছাড়া রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতা নেই। জাতীয় সংসদে তিনি যে ভাষণ দেন সেটিও মন্ত্রিসভার অনুমোদনপ্রাপ্ত।
সার্চ কমিটি নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সময় স্বল্পতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করতে না পারলেও তাদের কাছে নাম চাইবে বলে জানিয়েছে। প্রশ্ন হলো, বিএনপিসহ যেসব দল রাষ্ট্রপতির ডাকা বৈঠকে অংশ নেয়নি, তারা নাম দেবে কি না। বিএনপি ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, সার্চ কমিটির বিষয়ে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীন কোনো নির্বাচনে তারা যাবে না।
এ অবস্থায় সার্চ কমিটির পক্ষে সবার আস্থাভাজন একটি কমিশনের লক্ষ্যে নাম বাছাই করা সহজ হবে না। তদুপরি কাজটি করতে হবে দ্রুতই।
বর্তমান নূরুল হুদা কমিশনের মেয়াদ শেষ হবে ১৪ ফেব্রুয়ারি। তার আগেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে; যদিও আইনে ১৫ দিন সময় পাবে তারা। এখানে কোনো শূন্যতা সৃষ্টি না হয়, সেটাও দেখার বিষয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান কমিশনের প্রধান ও অন্যান্য সদস্য বিদায় নেবেন, নতুন কমিশন গঠিত হোক বা না হোক।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তাঁর ফেসবুক বার্তায় যে কথাগুলো লিখেছেন, তা কিছু দলকানা মানুষ ছাড়া দেশের প্রায় সব মানুষেরই কথা। দলের নেতা-কর্মীর নিজেদের পক্ষে কথা বলবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সমাজে কিছু মানুষ তো থাকতে হবে, যাঁরা কারও মুখ দেখে কথা বলবেন না। কে খুশি হলেন বা বেজার হলেন, তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না। নির্বাচনটি সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের, জন্য। নির্বাচনের নিয়ামক শক্তি আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নয়। এর নিয়ামক শক্তি হলো জনগণ। নির্বাচন কমিশনের কাজ হলো ভোটের আয়োজন করা। সরকার বা প্রশাসনের দায়িত্ব হলো তাকে সহায়তা করা, তার ওপর কর্তৃত্ব বা খবরদারি করা নয়।
কিন্তু আমাদের নিকট অতীতের কিংবা তার আগের অভিজ্ঞতা খুবই হতাশাজনক। যখনই দলীয় সরকারের অধীন ভোট হয়, সেই ভোটে জনগণের রায়ের প্রতিফলন ঘটে না, ঘটতে দেওয়া হয় না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেছে, তা-ও কিন্তু অনুষ্ঠিত হয়েছিল নির্দলীয় সরকারের অধীন। বিএনপির ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন হলে তাদের পক্ষেও ক্ষমতায় আসা সম্ভব হতো না। আবার ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দলীয় সরকারের মতো ব্যবহার করতে গিয়ে তারা নির্বাচনটিই ভন্ডুল করে দিল। আওয়ামী লীগ ২০১৪ ও ২০১৮ সালে কৌশলে সফল হয়েছে, এর অর্থ এই নয় যে জনগণের রায়ের প্রতিফলন ঘটেছে। নির্বাচনের দুটি দিক আছে, একটি আইনি ও আরেকটি নৈতিক। গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো নৈতিকতা। আইনিভাবে বাংলাদেশে সব নির্বাচনই বৈধ কিন্তু সব নির্বাচন নৈতিক ভিত্তি ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছে, তারা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন লড়াই করেছে। এখন যদি তাদের আমলে সামরিক শাসনামলের চেয়েও খারাপ নির্বাচন হয়, সেটি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্যই লজ্জাজনক।
রাষ্ট্রপতির নিয়োগ করা সার্চ কমিটির জন্য পাঁচজন ‘ত্রাতা’ খুঁজে বের করা কঠিন পরীক্ষাও বটে। তারপরও আমরা মনে করি, যদি তারা কারও ইঙ্গিতে কাজ না করে, তাহলে সতেরো কোটি মানুষের মধ্য থেকে পাঁচজন ত্রাতা বা অতিমানব খুঁজে বের করা অসম্ভব নয়। প্রশ্ন হলো, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতেই হবে।
বাংলাদেশে অনেক মানুষ আছে, যারা পদের চেয়ে বড়। আবার অনেকের কাছে পদপদবি ও সুযোগ-সুবিধাই বড়। দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষের সংখ্যাই বেশি। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্ভবত দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ সম্পর্কে সার্চ কমিটিকে সজাগ করে দিয়েছেন। এখন দেখার বিষয়, পূর্বসূরিদের মতো পাঁচজন খলনায়কের নাম প্রস্তাব করবে না সত্যিকার নায়কদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে? খলনায়ক খুঁজলে কোনো কষ্টই করতে হবে না। নানাভাবে তাঁরা এসে ধরা দেবেন।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি