আমি আওয়ামী লীগ সরকারের কিছু কাজের তীব্র সমালোচক। সমালোচকদের এ দেশে এড়িয়ে চলা হয়, পারলে নিপাত করা হয়। আওয়ামী লীগ আমলে আমার বিরুদ্ধে চারটি গুরুতর মামলা বা এর চেষ্টা হয়েছে। সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন সংস্কারমূলক প্রকল্পে দাতাদের পরামর্শক হিসেবে কাজ করতাম, সেখান থেকে বাদ পড়তে হয়েছে। বিদেশ যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে কারণ ছাড়া বসিয়ে রাখা হয়েছে দুবার, গুলি করে মেরে ফেরার হুমকি দেওয়া হয়েছে একবার।
বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে এরপরও আমি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনবার উঁচু পর্যায়ের পরামর্শ সভায় আমন্ত্রণ পেয়েছি। প্রথমবার ২০১০ সালে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নেতৃত্বে সংবিধান সংশোধনীবিষয়ক কমিটির সভায়, দ্বিতীয়বার ২০১৭ সালে নূরুল হুদা কমিশনের প্রথম পরামর্শ সভায়। শেষবার পেলাম আগামী শনিবার অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন কমিশন গঠনসংক্রান্ত অনুসন্ধান কমিটির (সার্চ কমিটি) সভায়।
২.
প্রথমবারের কথা বলি। আমি পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরাট ভক্ত। ফলে সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত তাঁর কমিটির বৈঠকে বিপুল উৎসাহে সংবিধান সংশোধনীমূলক প্রস্তাব লিখে নিয়ে গেলাম। সেখানে প্রায় সবই ছিল পুরোনো কথা। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে মন্ত্রিসভা আর রাষ্ট্রপতিকে আরও ক্ষমতায়িত করতে হবে, কিছু কিছু অর্থনৈতিক অধিকারকে আদালতের মাধ্যমে বলবৎযোগ্য করতে হবে, ৭০ অনুচ্ছেদের প্রয়োগ শুধু অনাস্থা ভোটের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ করতে হবে, উচ্চ আদালতে বিভিন্ন নিয়োগের আইন করতে হবে। মনে হলো সংবিধান সংশোধন কমিটির সবাই খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনেছেন। তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য লিখিত কপি সবাইকে দিয়ে এলাম।
এই কমিটি খুব ভালো নিয়ত নিয়ে শুরু করেছিল। কিন্তু শেষে দেখা গেল সরকার এর পরামর্শের প্রায় কোনো কিছুই গ্রহণ করেনি। কমিটি সংস্কার সাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার প্রস্তাবও দিয়েছিল। আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে এটিসহ কমিটির বহু পরামর্শ অগ্রাহ্য করা হয়। পর্বতের মূষিক প্রসব নামে একটা কথা আছে বাংলায়, তাই হলো।
দ্বিতীয়বার পরামর্শ সভা ডাকেন নূরুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন। তিনি মাত্র দায়িত্ব নিয়েছেন তখন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে এই আশায় সবাই ইতিবাচকভাবে দেখছিলেন সবকিছু। প্রথমবারের হতাশা সত্ত্বেও তাই কমিশনের বৈঠকে গেলাম। আমার প্রধান পরামর্শ ছিল নির্বাচনের আগে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা, নির্বাচনী কেন্দ্রে গ্রেপ্তারের ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং পেপার ট্রেইলবিহীন ইভিএম চালু না করা ইত্যাদি। এমন পরামর্শ আরও কেউ কেউ দিয়েছিলেন। এসব পরামর্শ কতটা আমলে নেওয়া হয়েছে তা সবাই জানেন। নূরুল হুদা কমিশনের অধীনে নির্বাচনে বরং নির্বাচনব্যবস্থায় ধস নামল।
৩.
এই সরকারের আমলে তৃতীয়বারের পরামর্শ সভাটি ডেকেছে বিচারপতি ওবায়েদুল হাসানের নেতৃত্বে অনুসন্ধান কমিটি। তিনি একজন শ্রদ্ধাভাজন বিচারক। অতীতে তাঁর আদালতে কিছু বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে আমিও হাজির হয়েছিলাম আসামি হিসেবে। আসামিদের মধ্য থেকে তিনি আমাকেই প্রথমে ডেকে নিয়েছিলেন বক্তব্য দেওয়ার জন্য। আদালত অবমাননা মামলায় আসলে আসামির বলার সুযোগ খুব কম। কিন্তু দেখা ও বোঝার সুযোগ ছিল। মনে হয়েছিল, দেশে যদি উন্নত রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকত, তিনি ভালো অনেক কিছু করতে পারতেন।
এবার গেলে আমি বিচারপতি ওবায়েদুল হাসানের কমিটিতে যাব আলোচক হিসেবে। নিশ্চয়ই সেখানে মন খুলে কথা বলার সুযোগ থাকবে। আমার এবং অন্য অংশগ্রহণকারীদের কথা কমিটি হয়তো মন দিয়ে শুনবেও। কিন্তু তা তারা বিবেচনায় নিতে পারবে কি?
২০১৮ সালের নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে এই আশায় সবাই ইতিবাচকভাবে দেখছিলেন সবকিছু। প্রথমবারের হতাশা সত্ত্বেও তাই কমিশনের বৈঠকে গেলাম। আমার প্রধান পরামর্শ ছিল নির্বাচনের আগে পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা, নির্বাচনী কেন্দ্রে গ্রেপ্তারের ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং পেপার ট্রেইলবিহীন ইভিএম চালু না করা ইত্যাদি। এমন পরামর্শ আরও কেউ কেউ দিয়েছিলেন। এসব পরামর্শ কতটা আমলে নেওয়া হয়েছে তা সবাই জানেন। নূরুল হুদা কমিশনের অধীনে নির্বাচনে বরং নির্বাচনব্যবস্থায় ধস নামল।
৪.
অনুসন্ধান কমিটি যে ১০ জনের নাম প্রস্তাব করবে, তার মধ্যে চূড়ান্তভাবে ৫ জনকে বেছে নেবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তিনি নিজে অতীত দুটি বিতর্কিত নির্বাচনের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী এবং সমর্থক। বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে তাঁর পরামর্শেই চূড়ান্ত হবে আগামী নির্বাচন কমিশনাররা। ফলে অনুসন্ধান কমিটিকে ১০টি নামই পাঠাতে হবে সুচিন্তিতভাবে।
এটি সুচিন্তিতভাবে করার একটি সহজ উপায় হচ্ছে কিছু লোককে বিবেচনা থেকে বাদ দেওয়া। যেমন: যারা বিভিন্ন সরকারের আমলে অতিরিক্ত আনুকূল্য পেয়েছে বা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে বা যাদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনকালে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি ও পক্ষপাতিত্ব অভিযোগ ছিল তাদের বাদ দেওয়া।
১০ জনের নাম বাছাই শুধু সঠিকভাবে করলে হবে না, এটি যে সুচিন্তিতভাবে করা হয়েছে, তা মানুষকে বোঝাতে হবে। এটা বোঝানোর সোজা উপায় হচ্ছে যাদের বাদ দেওয়া হলো ও যাদের নেওয়া হলো এ সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করে তা অনলাইনে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া। নিয়ত ঠিক থাকলে এগুলো দুরূহ না।
৫.
অতীত বৈঠক নিয়ে হতাশা আছে। যেভাবে নির্বাচন কমিশন আইন হলো তা নিয়ে প্রশ্ন আছে, অনুসন্ধান কমিটি আরও গ্রহণযোগ্য হতে পারত এমন কষ্ট আছে। শনিবার বৈঠকে তাই যাব কি যাব না, তা আমি নিজেই নিশ্চিত হতে পারছি না।
তবে আমাকে ও আমার মতো আরও কয়েকজন স্পস্টভাষী মানুষকে ডাকার জন্য অনুসন্ধানী কমিটিকে অভিনন্দন। এ দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার চরম সংকটকালে অনুসন্ধান কমিটি সর্বোত্তম সিদ্ধান্তটি নিতে পারবে এবং এর ফলে বাংলাদেশের মানুষ তার ভোটাধিকার ফিরে পাবে, আগামী নির্বাচন হবে সত্যি সত্যি অবাধ এবং সুষ্ঠু—এই প্রত্যাশা থাকল।
আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক