বৈষম্য

সাম্য ও মানবিক মর্যাদার স্বপ্ন কত দূরে

১৭ এপ্রিল চলে গেল। ১৯৭১ সালের এই দিনে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়েছিল। অঙ্গীকার করা হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা হবে। কিন্তু এসব অঙ্গীকার পূরণ হয়নি। বরং দিনে দিনে বৈষম্য বেড়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের ৪৭ বছর পরে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশে অতিধনী ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ হারে। সাধারণ ধনী বৃদ্ধির হারের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় দেশ। আর সবচেয়ে বেশি গরিব মানুষ যেসব দেশের নাগরিক, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম।

স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্যই ছিল সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে বৈষম্যমুক্ত সমাজ গড়ে তোলা। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে মানুষে মানুষে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদ বণ্টনব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে।’

স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে বৈষম্য নিয়ে গবেষণা করেছেন অর্থনীতিবিদ আজিজুর রহমান খান। এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশ ছিল অত্যন্ত দরিদ্র, কিন্তু আয়বণ্টনের বৈষম্য ছিল সীমিত। সে তুলনায় আজকের বাংলাদেশ হতদরিদ্র দশা কাটিয়ে উঠেছে, বিশেষভাবে গত সিকি শতাব্দীকালে সামরিক শাসনের অবসান-পরবর্তী ‘গণতন্ত্রায়ণের’ যুগে জাতীয় আয়ের দ্রুত প্রবৃদ্ধি ঘটেছে এবং একই সঙ্গে বণ্টনবৈষম্য দ্রুত বেড়েছে।’ [প্রথম আলো, ২৬ মার্চ ২০১৮]।

বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশের পথে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিভাগ বলছে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ ১০ প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের একটি। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে অধিক হারে সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। সিংহভাগ মানুষ উন্নয়নের কোনো সুফল পাচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশের মাত্র ৫ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের প্রায় ২৮ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশের মালিক। শীর্ষ ১০ শতাংশ ব্যক্তির আয়ের ভাগ ৩৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। বিপরীতে সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের মাত্র শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশের মালিক। জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের আয় হয় কমেছে বা এক জায়গাতেই থমকে আছে।

অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বাংলাদেশের অভ্যুদয় বইতে লিখেছেন,‘গণমানুষের এই সর্বাত্মক অংশগ্রহণ বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামকে একধরনের অন্য অধিকাংশ সংগ্রাম থেকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে। ঠিক এ কারণেই এ দেশে এমন একটা সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার ছিল, যেখানে এই মানুষগুলো তাদের অবদানের স্বীকৃতি পায় এবং তারা একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। তার পরিবর্তে আমরা এমন এক সমাজ গড়ে তুললাম, যা উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা যে সমাজটি পেয়েছিলাম তার চেয়েও অধিক বৈষম্যপীড়িত।’

২০১১ সালে স্বাধীনতার ৪০ বছর স্মারক অনুষ্ঠানেও তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘গত ৪০ বছরে উন্নয়নকৌশলগুলো অন্যায্যতা ও তীব্র বৈষম্যের জন্ম দিয়েছে, যা বাংলাদেশে দুটি সমাজ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সমসাময়িক এ চরিত্রের সঙ্গে তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অর্থনীতির মিল আছে। [প্রথম আলো ৩১.১২.২০১১]।

দারিদ্র্য দূর করে, বৈষম্য কমিয়ে আমরা অবশ্যই মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই। কিন্তু তার আগেই ‘উদিত দুঃখের দেশ’ কীভাবে ‘উদিত ধনীর দেশে’ রূপ পেল, তার বিশ্লেষণ করেছেন লেখক ও সাংবাদিক হাসান ফেরদৌস। তাঁর মতে, ‘সাম্প্রতিক সময়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে এমন প্রতিটি সরকারে আমরা দেখেছি ক্ষমতার আশপাশে রয়েছে এমন মানুষেরাই লাভবান হয়েছেন বেশি। ওই যে ১৭ শতাংশ হারে অতিধনী বাড়ছে, এঁরা সবাই ক্ষমতার নিকটবর্তী সেই সব মানুষ।’ [প্রথম আলো ১৬.১০.২০১৮]।

অর্থাৎ রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলে ধনীদের আরও ধনী হওয়ায় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, যা সম্পূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যের পরিপন্থী।

কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ২০১৮ সালের শহীদজননী জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতায় বলেন, ‘সমাজতন্ত্রকে বিদায় জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তার যে একটা মূল কথা মানুষের সঙ্গে মানুষের ভয়ানক বৈষম্য রাখা যাবে না, এ কথারও দায় থেকে মুক্তি পেতে গণতন্ত্রকে এখন অবাধ করা গেছে। পর্বতসমান ধন সংগ্রহ, আকাশচুম্বী বিষমতা এখন সমাজের মধ্যে সত্যিই অবাধ। যদি এটা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী না হয়, কী যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী আমার জানা নেই।’

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের ৩০ লাখ শহীদের রক্তঋণকে সম্মান করতে হলে সবার আগে বৈষম্য কমাতে হবে।

জহির রায়হান একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদকর্মী

jrjewel90@gmail.com