মতামত

সাম্প্রদায়িক হামলা একটি আত্মঘাতী কাজ

ধর্মের নামে ঘৃণা-বচন ও অন্যের প্রতি ঘৃণা উচ্চারণ আইন করে বন্ধ করতে হবে
ছবি: দীপু মালাকার

কুমিল্লার পূজামণ্ডপের যে ঘটনার জের ধরে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের সময় দেশব্যাপী অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনা ঘটেছে, তা যে কোনো হিন্দু ব্যক্তির কর্ম ছিল না, সেটা এখন প্রমাণিত। এর কারণও আমাদের জানা আছে। ১৯৪৭–পরবর্তীকাল থেকেই এ দেশে হিন্দু সম্প্রদায় চাপের মধ্যে রয়েছে। পাকিস্তান আমলে তারা ছিল রাষ্ট্রের কাছে সন্দেহভাজন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক এবং রাষ্ট্রীয় নানা চাপ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার; তখনো মাঝেমধ্যে যেমন ১৯৫০ ও ১৯৬৪ সালে হয়তো রাষ্ট্রীয় উসকানিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামার শিকার হয়েছিল তারা।

বাংলাদেশ হলো ধর্মীয় জাতীয়তা ও উন্মাদনাভিত্তিক রাষ্ট্রের জবাবে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার অঙ্গীকার নিয়ে আবির্ভূত আধুনিক রাষ্ট্র। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীন বাংলাদেশেও হিন্দুদের এই দুর্ভোগ থামেনি। এক যুগ ধরে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধুর দল ক্ষমতায় আছে। প্রধানমন্ত্রী ও দলনেত্রী শেখ হাসিনা একজন অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক নেত্রী বলেই জিয়া-খালেদার আমলের মতো পাকিস্তানি ধারায় রাষ্ট্র হিন্দুদের সন্দেহভাজন নাগরিকের দ্বিতীয় স্তরে ঠেলে দেননি। কিন্তু সমাজে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা থামেনি, খুঁটিয়ে বিচার করলে বৃহত্তর সামাজিক পর্যায়ে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ও ক্রমবৃদ্ধি নজরে আসবে।

মূল ঘটনা উদ্‌ঘাটিত হওয়ার পরে দুটি প্রশ্ন তোলা দরকার। প্রথম প্রশ্ন হলো যে পুলিশ-র‌্যাব এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বিরোধী দলকে মাঠেই নামতে দেন না, টিকতে দেন না, তাঁরা কেন পরবর্তী হামলাগুলো ঠেকাতে পারলেন না? শুক্রবারের বাড়তি হামলার ভয় আগাম আঁচ করতে না পারা প্রশাসন ও সরকারের ব্যর্থতা ছাড়া আর কী? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখা ইকবাল গ্রেপ্তার হওয়ার পরে তদন্তে শৈথিল্য না দেখিয়ে কেন ওর পেছনের মূল হোতাদের খোঁজা ও ধরা হচ্ছে না? এসব ক্ষেত্রে অতিরিক্ত আমলানির্ভরতা বাদ দিয়ে রাজনৈতিক কর্মীদেরই পরিস্থিতি মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে হয়। কেননা এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশি তৎপরতা আবশ্যিক হলেও মানুষের মধ্যে যে ঘৃণা-বিদ্বেষ ও বিরোধিতার বোধ লালিত হয়, চর্চা হচ্ছে সেটা থামানো নিশ্চয় পুলিশ বা আমলাদের কাজ নয়।

আমরা জানি, বহুকাল ধরে একশ্রেণির ধর্মীয় বক্তা হেট স্পিচ বা ঘৃণা ছড়ানোর বক্তৃতা দিয়ে আসছেন। এ নিয়ে আলোচনা ওঠার পরে ওয়াজ সম্পর্কে কিছু নির্দেশনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তৈরি করা হয়েছিল। তাতে ‘ওয়াজের নামে হাস্যকর ও বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে ধর্মের ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট করা’ থেকে বিরত থাকা, ওয়াজকারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে নিবন্ধন, ওয়াজে ‘উসকানিমূলক ও বিদ্বেষ ছড়ানো’ নিবৃত্ত করা এবং ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য দেওয়া ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার’ কথাও বলা হয়। কিন্তু এসব কি মানা হচ্ছে? বাস্তবতা তা বলে না। আমরা লক্ষ করছি কোনো কোনো ধর্মীয় বক্তার ওয়াজ-নসিহতে চারটি বিষয়ের সমালোচনা প্রাধান্য পায়—হিন্দুধর্ম ও সম্প্রদায়, শিক্ষিত প্রগতিশীল নারী, গণতন্ত্র ও বিজ্ঞান।

বিজয়ার পরদিন যখন হিন্দু বন্ধু, যিনি একজন আধুনিক প্রগতিমনস্ক দেশপ্রেমিক, সৌজন্যের খাতিরে ফোন করলেন তখন আমি শুধু দুটি শব্দই উচ্চারণ করতে পারলাম, লজ্জায় অধোবদন। কেননা ইসলাম কখনো প্রতিবেশীকে দুঃখ–কষ্ট ও হতাশায় নিমজ্জিত রেখে নিজেকে ভালো থাকার শিক্ষা দেয় না। প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্বের কথা কোরআনে যেমন আছে, হাদিসেও তেমনি গুরুত্বের সঙ্গে রয়েছে। অবশ্যই প্রতিবেশীর ধর্ম বা সংস্কৃতি সেখানে বিচার্য বিষয় নয়, নির্দিষ্ট করেও বলে দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশে প্রায় স্বাধীনতার পর থেকেই একশ্রেণির উগ্র ধর্মান্ধ ব্যক্তি এবং আরেক শ্রেণির পরধনলোভী বেপরোয়া মানুষের ভূমিকায় আমাদের সহনাগরিক আজন্ম প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায় বারবার অবিচার-অন্যায়ের শিকার হয়েছে, হচ্ছে। এটা না কোনো ধর্মজ্ঞানী মুসলমানের কাজ, না কোনো বিশ্বাসের ও বিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষের কাজ।

বাংলাদেশে প্রায় স্বাধীনতার পর থেকেই একশ্রেণির উগ্র ধর্মান্ধ ব্যক্তি এবং আরেক শ্রেণির পরধনলোভী বেপরোয়া মানুষের ভূমিকায় আমাদের সহনাগরিক আজন্ম প্রতিবেশী হিন্দু সম্প্রদায় বারবার অবিচার-অন্যায়ের শিকার হয়েছে, হচ্ছে। এটা না কোনো ধর্মজ্ঞানী মুসলমানের কাজ, না কোনো বিশ্বাসের ও বিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষের কাজ।

আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সুস্পষ্ট বার্তা চাই, দলীয় সতীর্থদের প্রতি স্পষ্ট নির্দেশনা চাই, যেন তাঁর দলের নেতা-কর্মীরা মাঠে নেমে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য স্বস্তির পরিবেশ তৈরি করেন। ভুলে গেলে চলবে না অপরাধীদের অনেকেই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কর্মী। জনগণ জানে যে হিন্দুদের সম্পত্তি দখলের ক্ষেত্রে দলীয় পরিচয় ভুলে অনেক বেপরোয়া ব্যক্তি দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট করে থাকেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় শর্ষের ভেতরে ভূত তাড়াবেন, কেননা তাদের অনেকেই তাঁর দলের মধ্যে ভালো অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। ফলে তাঁর জন্য একটি বড় কাজ হবে একদিকে সংখ্যালঘু হিন্দুদের আশ্বস্ত করা, নিরাপত্তা দেওয়া এবং অন্যদিকে নিজ দলে আশ্রয় নেওয়া সাম্প্রদায়িক শক্তি ও দুর্বৃত্ত প্রকৃতির ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে দল থেকে বহিষ্কার ও আইনের হাতে সোপর্দ করা। এতে হামলা, হত্যা-ভাঙচুরে আতঙ্কগ্রস্ত নাগরিকেরা কিছুটা হলেও স্বস্তি লাভ করবে।

কিন্তু গোড়ায় তো সংস্কারের কাজ করতে হবে। সে কাজ বাদ রেখে বেশি দূর এগোনো যাবে না। একদিকে বলা হচ্ছে বিশ্বায়নের কথা, ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা, অন্যদিকে মাদ্রাসাশিক্ষা কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় সংস্কার হয়নি। এতে একদিকে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পক্ষে শিল্পবিপ্লবোত্তর পৃথিবীতে এবং জীবনযাপনের ক্ষেত্রে যে ব্যাপক রূপান্তর ঘটেছে, তার মর্মকথা উপলব্ধি করা সম্ভব হয় না, অন্যদিকে মাদ্রাসা–উত্তীর্ণের অনেক ক্ষেত্রে সমাজে এই যুগান্তরের জরুরি বার্তা এড়িয়ে গিয়ে ধর্মের অসম্পূর্ণ ও বিকৃত ব্যাখ্যা হাজির করছেন। এর মধ্যে রাজনীতিরও ভূমিকা রয়েছে। রাজনৈতিক স্বার্থে সাধারণ মানুষের অন্ধবিশ্বাস‌‌ ও সংস্কার প্রায় সব দলই নিজ স্বার্থে ব্যবহার করছে।

যে মাওলানা বোয়িং বিমানে চড়ে হজে যান, যিনি আধুনিক চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করেন, মুঠোফোন ও ইন্টারনেট বা কম্পিউটার ব্যবহার করেন, তাঁদের এটা মনে রাখা দরকার একালের সব মানুষের প্রয়োজনীয় অধিকাংশ সামগ্রীর আবিষ্কারক, উৎপাদক মুসলিম নন। অনেকেই দেশের তুলনায় ভারতের হিন্দুধর্মাবলম্বী চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা নিতে ভালোবাসেন। দেশেও প্রচুর হিন্দু ডাক্তার আপন মেধা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আদতে আধুনিক জীবনে কার চাষের ধান, কার কলের ভাঙানো চাল, কোন ধর্মের মানুষের আড়ত ও খুচরা দোকানের পসরা কিনছি কে বলবে?

আমরা বাস্তব জীবনে পরস্পরের সহযোগিতায় ও পারস্পরিক নির্ভরতার মাধ্যমেই বেঁচে থাকি। নিত্যদিনের দোকানি, যানচালক বা ব্যবহার্য পণ্যের আমদানিকারক ও বিক্রেতার মধ্যে কত ধর্মের, কত জাতের, কত সংস্কৃতির মানুষের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা রয়েছে, তা কে বলবে? বাস্তবে আমরা এক বিশ্ব সম্প্রদায়ের অংশ। তাকে অস্বীকারের উপায় নেই এবং তার কোনো অংশের ক্ষতিসাধনে নিজেরই অনিষ্ট ডেকে আনি। ক্ষণিকের সামান্য লাভের আশায় দীর্ঘদিনের বহু মানুষের অবদানে তৈরি সম্প্রীতির বাতাবরণ নষ্ট করা মানে নিজের ধ্বংস ডেকে আনা। তালেবান ও অন্য জঙ্গিরা খ্রিষ্টান-ইহুদিদের তৈরি অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করে আখেরে ধ্বংস হচ্ছে। কোন মানবগোষ্ঠী বা জাতি কেন ধ্বংস হয়, সে কথা কি ধর্মগ্রন্থে বলা হয়নি?

আমাদের হিন্দু প্রতিবেশীদের ওপর যা ঘটেছে ও ঘটে চলেছে, তার জন্য সরকার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের উচিত দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা চাওয়া। আর মানুষের মনের ভুল ও বিভ্রান্তির আবেগ কাটানোর জন্যও কাজ করা প্রয়োজন। প্রথমেই ধর্মের নামে ঘৃণা-বচন ও অন্যের প্রতি ঘৃণা উচ্চারণ আইন করে বন্ধ করতে হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ–সংক্রান্ত নির্দেশনা পালনে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। অতি উৎসাহী বিপথগামীদের এ কথাও মনে রাখতে হবে, তাদের অবিমৃশ্যকারী আচরণের জের ধরে ভারতে যদি এর প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তাহলে অনেক বড় চাপের সম্মুখীন হবে বাংলাদেশ। কতিপয় ব্যক্তির দায়িত্বহীন আচরণ সবার জন্য বিপদ ডেকে আনে, সবার শান্তি, নিরাপত্তা ও স্বস্তি নষ্ট করে। কোনো রাষ্ট্র এমন পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি চাইতে পারে না।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক