উপমহাদেশ স্বাধীন হয়ে ১৯৪৭ সালে অনেকগুলো সীমান্ত হয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় টান ও টানাপোড়েন আলাদা করা যায়নি। সম্ভব নয় সেটা। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা—সর্বত্র ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে বিপুলসংখ্যক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়। ফলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন শঙ্কা প্রকাশ করেন উপমহাদেশের এক দেশে সাম্প্রদায়িক অন্যায় অপর দেশে প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে,Ñ তখন তিনি রূঢ় এক বাস্তব সত্য তুলে ধরেন। রাজনীতিবিদ হিসেবে এই সত্য উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তিনি উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সংকট মোকাবিলার যথার্থ পথও দেখান। কুমিল্লা ও ত্রিপুরা আমাদের সেই বাস্তবতার কথাই জানায়।
উপমহাদেশজুড়ে হঠাৎ করে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস বেড়েছে। বাংলাদেশের কুমিল্লার পর ভারতের ত্রিপুরায় কয়েক দিন ধরে মসজিদগুলোতে আগুন দেখা যাচ্ছে। তবে এক অর্থে এটা ‘হঠাৎ’ চিত্র নয়। পুরো উপমহাদেশে এ রকম সমস্যার বয়স শত বছরের পুরোনো। কিন্তু কেন এর সমাধান করা যাচ্ছে না? এমনকি ধর্মের ভিত্তিতে ‘দেশ’ভাগের পরও এই সমস্যার লাগাম টানা যায়নি। এর নিশ্চয়ই বহু কারণ রয়েছে। একটি কারণ নিশ্চয়ই এ রকম যে রাজনীতিবিদেরা সত্যকে আড়াল করেছেন নিজ নিজ স্বার্থে। প্রত্যেকে নিজ দেশের করণীয় আড়াল করে অপর দেশকে দোষারোপ করে বাহবা পেতে চেয়েছেন।
উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যা যেকোনো একক দেশের সমস্যা নয়। এর সমাধানে যে এ অঞ্চলের সবার সম্মিলিত দায় রয়েছে, সেটাই ইঙ্গিত করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ১৪ অক্টোবর। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার স্বার্থে ভারতে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয় যে গুরুত্ব পাওয়া উচিত, সেটাই শেখ হাসিনার বক্তব্যের সারকথা ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘(ভারতে) এমন কিছু যেন না করা হয়, যার প্রভাব আমাদের দেশে এসে পড়ে।’ একইভাবে বলা যায়, আশপাশের যেকোনো দেশেই এমন আচরণ অসংগত, যা অপর দেশে খারাপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। সাম্প্রদায়িক সমস্যা যে আন্তদেশীয় চরিত্রের একটা ‘ক্যানসার’, অন্তত এই উপমহাদেশেÑ তারই মোটাদাগের স্বীকৃতি এই বক্তব্য।
এই বক্তব্য একই সঙ্গে উপমহাদেশের প্রতিটি দেশের সরকারের গুরুতর দায়দায়িত্বের কথাও বলে। কোনো সুনির্দিষ্ট ঘটনায় অপর দেশকে একচেটিয়াভাবে নিন্দা করার আগে মিয়ানমার থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত এ অঞ্চলের প্রতিটি দেশের সরকারের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস বন্ধে নিজেদের আচরণ নিয়ে অবশ্যই সতর্ক হওয়া উচিত। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এই অর্থে আন্তদেশীয় এই সমস্যার খোলামেলা স্বীকৃতি। অপর দেশের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস নিয়ে সংকীর্ণ রাজনীতি না করারও পরোক্ষ আকুতি রয়েছে তাতে। যে কারণে আমরা দেখছি, কুমিল্লার ঘটনাবলি যখন ভারতে ধূমায়িত করা হচ্ছে, তখন ত্রিপুরার জ্বালাও-পোড়াও নিয়ে বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কঠোরভাবে ধৈর্য ধারণের নীতি কাজ করছে।
বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রশ্নে এখন এত সতর্ক যে ত্রিপুরায় কী ঘটছে, সেটাও এখানকার কাগজগুলোতে সামান্যই মনোযোগ পাচ্ছে এই মুহূর্তে! অথচ বিবিসি-ইংরেজিতে খোদ ভারতীয় সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক ২৮ অক্টোবর লিখেছেন, ‘ত্রিপুরায় মুসলমানবিরোধী সহিংসতা জ্বলে উঠেছে।’ এ রকম শিরোনামে ঢাকায় কোনো কাগজ ত্রিপুরার সংবাদ তুলে ধরেনি এখনো। যদিও বিবিসির ওই প্রতিবেদকের লেখায় সেখানকার রাজ্য-পুলিশের ভাষ্যই বেশি ঠাঁই পেয়েছে, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি প্রকৃতই উদ্বেগময়। কয়েক দিন ধরে এই রাজ্যে মসজিদ আক্রান্ত হয়েছে। ক্রমাগত সংঘর্ষ হচ্ছে। বিপুল পরিমাণ ধর্মগ্রন্থ পুড়ে গেছে।
ত্রিপুরার আসন্ন নির্বাচন ও তার সমীকরণের সঙ্গে মিলিয়ে এই অবস্থার পূর্বাপর বোঝা কঠিন নয়। ভারতের সুপরিচিত প্রচারমাধ্যম স্ক্রল.ইন ২৮ অক্টোবর ত্রিপুরার ঘটনাবলির বিবরণ দিয়ে মাঠপর্যায় থেকে লিখেছে, ‘তৃণমূল কংগ্রেস যখন এই রাজ্যে ঢুকতে চাইছে, Ñ(তখন) বিজেপি হয়তো তার পক্ষে বাঙালি ভোটব্যাংককে সংহত করার লক্ষ্য নিয়েছে।’ বাস্তবতা ওই রকম হলেও ঘটনার ব্যাপকতা ও নির্মমতা বাংলাদেশে সরকার ও জনসমাজে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে বৈকি। এই উদ্বেগ একটা বাস্তবতা। এ রকম বাস্তবতার পাল্টা প্রতিক্রিয়া অনাকাঙ্ক্ষিত, কিন্তু রোধ করার উপায় কী? শেখ হাসিনার পরামর্শ এই অর্থেই প্রাসঙ্গিক। সাম্প্রদায়িকতাকে থামাতে হবে সব উৎসে। এ নিয়ে পদ্ধতিগত রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। উপমহাদেশের কিছু পুরোনো রাজনৈতিক দল যা করেছে দশকের পর দশক।
গত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল সামান্য একটা সমাবেশ করতে পারে না ত্রিপুরায়। তাৎক্ষণিকভাবে সেগুলো বিজেপির হামলার শিকার হয়। অথচ সেখানে দিনের পর দিন অপর ধর্মের ইবাদতের স্থানে আক্রমণ থামানো গেল না,Ñ এটা বিস্ময়কর! একই রকম উদাসীনতা নিশ্চয়ই অন্য কোনো দেশেও কাম্য নয়। বাংলাদেশেও নয়। আবার এ রকম সন্ত্রাসের বিরোধিতার নামে কোনো দেশের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগতভাবে বিশ্বজুড়ে প্রচার আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টাও কাম্য নয়। বাংলাদেশ এই মুহূর্তে সে রকম এক সংকীর্ণ আন্তমহাদেশীয় রাজনীতির শিকার। কিন্তু বাংলাদেশ কখনো আসাম-ত্রিপুরা-পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের দুর্দশা নিয়ে জেনেভা বা নিউইয়র্কে যায়নি।
বলা হচ্ছে, ত্রিপুরার ঘটনা কুমিল্লার ঘটনার প্রতিক্রিয়া। তাহলে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে কয়েক দশক ধরে যে তথ্য-প্রমাণ ছাড়া হরহামেশা বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চলে, তার কী ব্যাখ্য পাওয়া যাবে? পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামে নির্বাচন এলেই বাংলাদেশ আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠা ঢাকার জন্য অবশ্যই অসহনীয় এক বাস্তবতা।
আসামে বাংলাভাষী দরিদ্র মুসলমানমাত্র ‘বাংলাদেশি বহিরাগত’ ধরে নিয়ে ‘বিদেশি খেদানো’র রাজনীতি চলছে কয়েক দশক হলো। রক্তাক্ত সেই রাজনীতির ফল হিসেবে এনআরসি হলো, কিন্তু ‘চল্লিশ লাখ বাংলাদেশি মুসলমান’–এর কোনো হদিস পাওয়া গেল না। একই রাজনীতি আছে ত্রিপুরায়, পশ্চিমবঙ্গে। উপমহাদেশে আন্তদেশীয় স্বাস্থ্যকর সম্পর্কের স্বার্থে এসব প্রচারণা বাদ দিয়ে একান্ত স্থানীয় চরিত্রের ভোটের রাজনীতির অভ্যাস করতে হবে সব দলকে। বাংলাদেশ সরকার যে আজও আসামের বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় চুপ থাকার নীতি নিয়ে আছে,Ñ সেটা বিরল এক কূটনৈতিক নজির। কিন্তু বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের আহত আবেগের টুঁটি চেপে ধরে রাখা অতি কঠিন কাজই বটে।
উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আরও এক কারণে জরুরি মনোযোগ দাবি করে। কয়েক বছর ধরে বিশ্বরাজনীতির নতুন ভরকেন্দ্র হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। এটা লক্ষণ হিসেবে শুভ নয়। মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ চলছে। আফগানিস্তানে মাঝেমধ্যেই ধর্মবাদী সন্ত্রাসে ৫০-১০০ জন করে মরছে। এ রকম সময়ে এ অঞ্চলের দেশগুলোর নেতৃত্ব ও জনসমাজে বাড়তি সতর্কতা ও সংযম দরকার। নিজেদের হানাহানির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মুরব্বিদের এখানে আরও বেশি করে ডেকে আনা সুবিবেচনাপ্রসূত হবে না। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। অঞ্চলে অঞ্চলে জাতিগত ও ধর্মীয় উসকানি থামাতে না পেরে বহু জনপদ ছারখার হয়ে গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের নামে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এসব থেকে মোটাদাগে ফায়দা নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়াকে একই পরিণতি থেকে বাঁচাতে এখনি সার্কভিত্তিক যৌথ উদ্যোগ জরুরি। কোনো দেশে কোনো রাজনৈতিক দল সংখ্যালঘুর ধর্ম ও জাত নিয়ে ঘৃণা ছড়াবে না এবং এ রকম ‘রাজনীতি’ তাৎক্ষণিকভাবে দমনের সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি। এ রকম অঙ্গীকারের জন্য একত্রে বোঝাপড়ার লক্ষ্যে সার্ক ছাড়া আঞ্চলিক আর কোনো কাঠামো নেই আমাদের।
সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা কোনো এক দেশের সমস্যা নয়, দ্বিপক্ষীয় সমস্যাও নয়, এটা দক্ষিণ এশিয়ার সম্মিলিত দায়। এর সমাধান চেষ্টা হতে হবে বহুপক্ষীয়। এই বৃহত্তর পটভূমিতেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আলোচনার দাবি রাখে। রাজনীতি ও রাজনীতিবিদ ছাড়া প্রশাসন একা এই সমস্যা রুখতে পারবে না।
● আলতাফ পারভেজ, দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক