এই লেখা যখন আপনারা পড়ছেন, তখন গ্রিসের সামোস দ্বীপের ছোট ছোট ছাপরায় আশ্রয় নেওয়া অভিবাসীদের (তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে) কারাগারের আদলে বানানো নতুন শিবিরে নেওয়া হচ্ছে। নতুন এই তথাকথিত ‘কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত’ ক্যাম্পের ঘরগুলোতে তিন হাজার শরণার্থীকে রাখা হবে। এর মধ্যে আটককেন্দ্রও বানানো হয়েছে, যেখানে ৯০০ লোককে রাখা হতে যাচ্ছে। জনবসতি থেকে অনেক দূরে বানানো এই শিবিরের চারপাশে তিন স্তরের সামরিক মানের কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। সঙ্গে থাকছে সর্বাধুনিক নজরদারি প্রযুক্তি।
হাস্যকর বিষয় হলো, এই শিবিরকে ইউরোপিয়ান কর্তৃপক্ষ তাদের মানবিক কার্যক্রমের সাফল্য হিসেবে তুলে ধরছে। আসল সত্য সম্পূর্ণ উল্টো। আসল সত্য হলো যে মানুষগুলো বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছে, সেই মানুষগুলোর আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবা এবং মানবিক মর্যাদা চাওয়াকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বলপূর্বক এই শিবিরে ঢোকানো হচ্ছে। এই মানুষগুলোর ‘অপরাধ’ হচ্ছে তাঁরা ইউরোপে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, নাগরিক সুরক্ষা, শরণার্থীর মর্যাদা এবং একটু ভালোভাবে জীবন কাটানোর আবেদন করেছিলেন।
আসলে ইউরোপের অভিবাসন নীতি এককথায় পীড়নদায়ী। সেখানকার অভিবাসন নীতি আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে শরণার্থীদের অধিকার সমুন্নত রাখার বদলে পদে পদে অভিবাসীদের অপরাধী সাব্যস্ত করে, তাঁদের অপমান করে এবং শাস্তি দেয়। এই নীতির নিষ্ঠুরতাকে ঢাকতে তারা এমন ‘স্যানিটাইজড’ ভাষার সম্পূর্ণ নতুন একটি অভিধান তৈরি করছে, যা দিয়ে আশ্রয়ের দাবিদার ও শরণার্থীদের প্রতি তাদের অবৈধ আচরণকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে।
২০২০ সাল থেকে ইউরোপিয়ান কমিশন গ্রিসের সরকারকে নতুন নতুন আটককেন্দ্র ও জেলখানার আদলে বানানো কথিত শরণার্থীশিবির বানানোর জন্য লাখ লাখ ইউরো দিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপিয়ান কমিশনের ছাড় করা সেই অর্থে বানানো প্রথম শিবিরটি সামোস দ্বীপে। এটি উদ্বোধন করা হতে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, এখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা অনেক উন্নত। কিন্তু যেসব শিবির বানানো হচ্ছে, তার সবগুলোর ধরন একই রকম। প্রতিটি শিবির লোকালয় থেকে অনেক দূরে, মাত্রাতিরিক্ত নিরাপত্তাবেষ্টনীতে আবদ্ধ ও চারপাশে এমন আবহ তৈরি করা, যাতে যে কারও মনে হবে এটি অপরাধীদের আবাসস্থল। এখান থেকে কেউ চাইলেই বের হতে পারবে না। আন্তর্জাতিক শরণার্থী ও মানবাধিকার আইন মানার ক্ষেত্রে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও গ্রিস সরকারের সুস্পষ্ট বাধ্যবাধকতা থাকার পরও এই শরণার্থীদের মানবিক মর্যাদা রক্ষায় তারা যথেষ্ট তৎপর হতে ব্যর্থ হয়েছে।
ইউরোপের অভিবাসন নীতি আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে শরণার্থীদের অধিকার সমুন্নত রাখার বদলে পদে পদে অভিবাসীদের অপরাধী সাব্যস্ত করে, তাঁদের অপমান করে এবং শাস্তি দেয়। এই নীতির নিষ্ঠুরতাকে ঢাকতে তারা এমন ‘স্যানিটাইজড’ ভাষার সম্পূর্ণ নতুন একটি অভিধান তৈরি করছে, যা দিয়ে আশ্রয়ের দাবিদার ও শরণার্থীদের প্রতি তাদের অবৈধ আচরণকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবামূলক সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (মেডেসিনস স্যানস ফ্রন্টিয়ার্স, সংক্ষেপে এমএসএফ) গ্রিক দ্বীপপুঞ্জে আটকে পড়া আফগান, সিরিয়ান ও সাব-সাহারান শরণার্থীদের সেবাশুশ্রূষার কাজ করে আসছে। এই সময়ে আমরা দেখেছি সেখানে আশ্রয়ের খোঁজে আসা মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ার পর সরকারি কর্তৃপক্ষ কী নিদারুণ অবহেলায় তাঁদের ফেলে রাখে।
২০২১ সালের এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত সামোস দ্বীপে আমরা যতসংখ্যক অসুস্থ অভিবাসনপ্রত্যাশীর চিকিৎসা দিয়েছি, তার অর্ধেকের বেশি রোগী আত্মহত্যা করার চিন্তা করেছিল। প্রতি ১০ জনের মধ্যে ২ জনই আত্মঘাতী হওয়ার ঝুঁকিতে ছিল। কয়েক মাস ধরে আমরা লক্ষ করেছি, আমরা যাঁদের চিকিৎসা দিচ্ছি, তাঁদের অধিকাংশের মধ্যে এখন সরকারের নতুন আশ্রয়শিবির আতঙ্ক ধরিয়ে দিয়েছে।
গত জুনে আমরা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। ওই প্রতিবেদনে নতুন শরণার্থীশিবিরের ভয়ংকর নিবর্তনমূলক ব্যবস্থাপনার কী পরিণাম হতে পারে, তা দেখানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এমনিতেই এসব লোক দেশছাড়া হয়ে ছিন্নমূল মানুষের মতো তাঁবুতে থেকে একটি মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকছে। এর ওপর যদি তাদের কাঁটাতারে ঘেরা বন্দিশালার মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে তাদের মানসিক ক্ষরণ আরও ভয়ানক রূপ নেবে। এতে তারা আরও হতাশ হবে এবং উন্মত্ত ও সহিংসও হয়ে উঠতে পারে।
ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক, ইথিওপিয়া ও আফগানিস্তানের যুদ্ধকবলিত এলাকায় আমরা চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কাজ করার সময় দেখেছি কীভাবে মানুষ প্রাণভয়ে নিজেদের বাস্তুভিটা ছেড়ে পালায়। একটু নিরাপত্তা ও জীবনের নিশ্চয়তার জন্য তারা জীবন হাতে করে এই দূর পরবাসে এসেছে। তাদের সঙ্গে এ আচরণ কোনোভাবেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে পারে না।
২০১৫ সালে জার্মানি কয়েক লাখ সিরীয় শরণার্থীকে উষ্ণ আলিঙ্গনে গ্রহণ করেছিল। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন চাইলেই সেই আইডিয়াকে গ্রহণ করতে পারে। এটি তাদের জন্য বিশ্বদরবারে অত্যন্ত মর্যাদার বিষয় হতে পারে। সীমান্তে দেয়াল তোলা এবং জেলখানার আদলে কথিত শরণার্থীশিবির বানানোর পেছনে লাখ লাখ ডলার খরচ না করে সেই অর্থ যদি শরণার্থীদের পুনর্বাসন এবং তাদের মূলধারার ইউরোপীয় জীবনে আনার চেষ্টায় খরচ করা হয়, তাহলে তা অনেক বেশি ফলপ্রসূ হবে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● ক্রিস্টিনা সারা এমএসএফ, গ্রিসের মহাপরিচালক এবং
● স্টিফেন করনিশ এমএসএফের জেনেভাভিত্তিক অপারেশনাল সেন্টারের মহাপরিচালক