পৃথিবীর প্রায় সব দেশে কিছু প্রান্তিক ও দুর্বল মানুষ প্রয়োজনীয় পণ্য, সেবা, সহযোগিতা পায় না। তাদের নানা চাহিদা মেটানোর জন্য নানা ধরন ও কলেবরে তৈরি হয়েছে অনেক বেসরকারি সংস্থা (নন-গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন বা এনজিও)। সরকার ও ব্যবসায়িক খাতের পাশাপাশি এটি তৃতীয় একটি খাত হিসেবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অবদান রাখে। দেশে দেশে এটি সামাজিক খাত নামে পরিচিত।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে এনজিওগুলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী অধিকার, বাসস্থান, কর্মসংস্থান ও সমাজের নানা ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও এনজিওর ভূমিকা ছিল, দিনে দিনে ভূমিকা আরও বাড়ছে। ধনী–গরিবের ব্যবধান বাড়ছে, বয়স্ক পরনির্ভরশীল মানুষ ও আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়ছে। মানুষের নানাবিধ পণ্য ও সেবা চাহিদা তৈরি হচ্ছে, কিন্তু সরকার বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে সবাইকে তা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই এনজিওগুলোর স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আরও বড় পরিসরে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে।
একটি সমাজের সব মানুষ সরাসরি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বা সরকারে অংশগ্রহণ করে না। অনেকের ইচ্ছা ও সামর্থ্য থাকে সমাজের জন্য কিছু করার। তারা একটি মতামত দেওয়ার প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে চায়। সে প্রেরণা থেকেই তারা এনজিও তৈরি করে অবদান রাখতে চায়। তারা যখন আর্থিক শক্তি, সেবা ও কাজের মাধ্যমে সমাজে অধিকতর অবদান রাখার যোগ্যতা অর্জন করে, তখন তারা শক্তিশালী সুশীল সমাজের অংশ হয়ে ওঠে। যেকোনো বিষয়ে প্রভাব ফেলা বা মতামত দেওয়ার জন্য কিছু যোগ্যতা অর্জন করে দেখাতে হয়। এ যোগ্যতা হলো আর্থিক, সামাজিক বা মানসিকভাবে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে পণ্য, সেবা, তথ্য, অর্থ ইত্যাদি দিয়ে সহায়তা করা। যারা এটি বেশি করতে পারে, তাদের সামাজিক মূলধন (সোশ্যাল ক্যাপিটাল) বেশি হয়, তাদের মতামত দেওয়ার সক্ষমতা বাড়ে। তখন তারা তাদের টার্গেট গোষ্ঠীর হয়ে রাষ্ট্রের কাছে তাদের মতামত বা দাবিদাওয়া তুলে ধরতে পারে।
এ দেশে একসময় এনজিওগুলোর বেশির ভাগ কার্যক্রম থাকত ক্ষুদ্রঋণ ঘিরে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের এনজিওগুলোরও কাজের ও পরিচালনার ধরনে পরিবর্তন আসছে। ব্যবসায়িকভাবে বিনিয়োগ করে মুনাফা দিয়ে বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান, ফাউন্ডেশন ইত্যাদির কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে একধরনের হাইব্রিড এনজিও চালু হয়েছে। অর্থাৎ গুটিকয় ব্যক্তির সদিচ্ছার ভিত্তিতে মানুষের উপকারের জন্য অপেশাদার উদ্যোগের মধ্যে এনজিও এখন আর সীমাবদ্ধ নেই। এটি বৈশ্বিক ব্যাপ্তি পেয়েছে এবং দিনে দিনে এ পরিসর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের বড় এনজিওগুলোর মধ্যে যেমন ‘ব্র্যাক’ ও ‘কেয়ার’ হচ্ছে প্রথাগত ধরনের এনজিও। ‘উইকিমিডিয়া ফাউন্ডেশন’ (উইকিপিডিয়ার পরিচালনা প্রতিষ্ঠান) ও ‘খান একাডেমি’র মতো শিক্ষা ও তথ্যনির্ভর এনজিও কাজ করে শিক্ষাবিস্তার ও বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রাপ্তি সহজীকরণ ও সম্প্রসারণে। ব্যক্তিগত অনুপ্রেরণায় তৈরি ‘বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’, ‘চ্যান জাকারবার্গ ইনিশিয়েটিভ’ ইত্যাদি কাজ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি, পরিবেশ, দারিদ্র্য দূরীকরণসহ নানা বিষয় নিয়ে। আমাদের দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর উচ্চবিত্ত মানুষ তৈরি হচ্ছে। তাঁরাও এনজিও কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষের সেবায় কিছু করতে চান, সমাজে অবদান রাখতে চান।
এনজিও পরিচালনার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট কৌশল প্রণয়ন করতে হয়। আর্থিক ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সরকার বা বাণিজ্যিক খাত যা দিতে পারে না, তা সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া তার উদ্দেশ্য। এ জন্য দেশি ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর কার্যপদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা বিশদভাবে জানতে হয়। চুক্তিতে অনেক সময় ছোট দেশি এনজিওগুলো বাইরের বড় এনজিওর কাছ থেকে অর্থ নিয়ে সেবা, পণ্য সরবরাহ করে বা তাদের পক্ষে কাজ করে দেয়। এটার নানা আইনি দিক রয়েছে। সব বড় বড় দাতব্য প্রতিষ্ঠান বা ধনী লোকজনই যে ফাউন্ডেশন বা এনজিওর করবেন, তা নয়। সামাজিক বোধসম্পন্ন যে কেউ কাজের ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করে এগোতে পারেন। সারা দুনিয়ায় দাতব্য কাজের জন্য ‘ফান্ড রেইজিং’ বা অর্থ সংগ্রহ একটি জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অনলাইন ব্যাংকিং বিষয়টিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। প্রাপ্ত আর্থিক সাহায্য যথাযথ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে খরচ করে মানুষের উপকার করার জন্য চাই উপযুক্ত দক্ষ মানবসম্পদ। সামাজিক ব্যবসা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে হাইব্রিড এনজিওগুলো ব্যবসায় দ্রুত মুনাফা অর্জন করে সে মুনাফা মানবকল্যাণে ব্যয় করতে পারে। এসব বিষয়ের সঙ্গে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক আইন ও বিধিমালা জড়িত। দ্রুত পরিবর্তনশীল এ খাত নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও সর্বাধুনিক তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকা অর্জন করা জরুরি।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সেরা সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এনজিও বিষয়ে মাস্টার্স, ডিপ্লোমা ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করছে। এভাবে এ বিষয়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে উঠছে এবং উন্নত গবেষণার মাধ্যমে এনজিও কার্যক্রম বিস্তৃত ও ফলপ্রসূ হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ বিষয়ে পড়ানো হয় না।
বাংলাদেশের তরুণ–তরুণীরা সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য কিছু করার কথা ভাবে। নিজের ক্যারিয়ারের মাধ্যমেই দেশ ও দশের সেবার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে চায়। নিজের মতামতকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এনজিওবিষয়ক মাস্টার্স, ডিপ্লোমা, পিএইচডি বা সার্টিফিকেট কোর্স চালুর মাধ্যমে তাদের যথাযথ দক্ষ করে গড়ে তুললে তারা এসব ভাবনা কাজে লাগাতে পারবে। সমাজসচেতন বিত্তবান, উদ্যমী মানুষেরা এনজিও ও ফাউন্ডেশন স্থাপন করতে চাইলে তারা সঠিক দিকনির্দেশনা দেবে। সংশ্লিষ্ট সরকারি ব্যক্তিদের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারকদের দ্রুত এ বিষয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন।
তৌহিদ এলাহী: যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটির দ্য বুশ স্কুল অব গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক সার্ভিসে অধ্যয়নরত গবেষক
towheedelahi@gmail.com