সাবেক দুই সিইসির কথা কি শুনবেন আউয়াল

কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) ১৩ মার্চ থেকে সংলাপ শুরু করতে যাচ্ছে। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও সংলাপ করার চিন্তা আছে আছে তাদের। দায়িত্ব নেওয়ার পর সিইসি আউয়াল বিএনপির সঙ্গে আলোচনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, একটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কীভাবে করা যায়, এ বিষয়ে অংশীজনদের কাছ থেকে পরামর্শ নেবেন। পর্যায়ক্রমে নাগরিক সমাজ, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, নির্বাচন বিষয়ে গবেষকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।

এর আগে বিগত তিনটি নির্বাচন কমিশন অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ করেছিল। কিন্তু বিগত দুই জাতীয় নির্বাচনে তার প্রতিফলন ছিল না। তাই নতুন কমিশনের সংলাপের আয়োজন নিয়ে আগাম কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। নূরুল হুদা কমিশনের বিদায়ের পর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নতুন কমিশন শপথ নেয়।

নূরুল হুদা কমিশন নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পুনরুদ্ধার নয়, এর ধ্বংস প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছে। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, নূরুল হুদা কমিশনের সংলাপে ৩৯টি রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক সংস্থা, নারীনেত্রী ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা অংশ নিয়েছিলেন। সেই সংলাপে জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন, ইভিএম ব্যবহার, ‘না’ ভোটের বিধান চালু করাসহ কয়েকটি বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত এসেছিল। অথচ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল’ হিসেবে চিহ্নিত করেই দায়িত্ব শেষ করে ইসি।

নতুন নির্বাচন কমিশন যখন কাজ শুরু করতে যাচ্ছে, তখন সাবেক দুই প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা ও এ টি এম শামসুল হুদা নির্বাচনী চ্যালেঞ্জকে কীভাবে দেখেছিলেন বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। মোহাম্মদ আবু হেনা কমিশন ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে গঠিত হয়। শামসুল হুদা কমিশন ২০০৮-২০১৩ মেয়াদে দায়িত্বে ছিল।

মোহাম্মদ আবু হেনা নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন, ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনও পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো মাত্র দুই মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল দেশের এক সংকটময় মুহূর্তে। নবগঠিত নির্বাচন কমিশনকে দুরূহ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছিল ওই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে দৃঢ় ও সাহসিকতার সঙ্গে। সংশ্লিষ্ট সবার আস্থা অর্জন ও অনুকূল নির্বাচন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির দিকে কমিশনকে সর্বোচ্চ মনোযোগ ও অগ্রাধিকার দিতে হয়েছিল। সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, চিহ্নিত মাস্তান ও দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার, সতর্কতার সঙ্গে নির্বাচন কর্মকর্তা বাছাই ও প্রশিক্ষণ, প্রচারাভিযানে সব দলের সমান সুযোগ, ভোটার সচেতনতা কর্মসূচি, নির্বাচন ব্যবস্থাপনার সব স্তরে স্বচ্ছতা ইত্যাদির দিকে মনোযোগ দেওয়া ছাড়াও সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে কমিশন একটা সর্বসম্মত নির্বাচনী আচরণ বিধিমালা (আরপিও ১৯৭২ আওতায়) জারি করে। আচরণবিধিমালার লঙ্ঘনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। (সূত্র: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৮, প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের তথ্যাবলি। আগামী প্রকাশনী)

নতুন কমিশনের সাফল্য-ব্যর্থতা সম্পর্কে আমরা এখনই ভবিষ্যদ্বাণী করছি না। তাদের মনে রাখা প্রয়োজন আবু হেনা ও শামসুল হুদা কমিশন নির্বাচন করতে গিয়ে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল, বর্তমান কমিশনকে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল। এখন দলীয় সরকার।

২০০১-২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকতে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারে বেশ কিছু প্রস্তাব করেছিল। প্রস্তাব এসেছিল নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও। বিএনপি সরকার সেসব প্রস্তাব আমলে না নিয়ে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়। এক–এগারোর পটপরিবর্তনের কারণে শেষ পর্যন্ত সেই নির্বাচন হয়নি। পরবর্তীকালে ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও ১৯৭২)-এর কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনে। ফলে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করা সম্ভব হয়েছিল।

সেসব আইন, বিধি এখনো বহাল আছে। অথচ ২০১৪ ও ২০১৮ সালে দেশবাসী সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পায়নি। এই দুটি নির্বাচনে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হয়নি। প্রথমটি হয়েছে বিরোধী দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে। আর দ্বিতীয়টিতে সব দল অংশ নিলেও নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মতে, সামরিক শাসনামলেও এত খারাপ নির্বাচন হয়নি।

নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে এ টি এম শামসুল হুদা লিখেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে স্বাধীনচেতা ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়া অবশ্যই সঠিক পদক্ষেপ। কিন্তু স্বাধীনতার বিভিন্ন উপাদান বিশ্লেষণ করে যেসব ক্ষেত্রে ঘাটতি কিংবা দুর্বলতা আছে, সেসব প্রশমনের জন্য ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা না হলে শুধু বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তা অন্তঃসার রাজনৈতিক বক্তব্যেই পর্যবসিত হবে।...বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে, এমনকি আইনি বিধানের সঙ্গে সংযোজন করার যে ক্ষমতা সাধারণত নির্বাচিত সংসদের জন্য নির্ধারিত, ইনহেরেন্ট বা অন্তর্নিহিত ক্ষমতা হিসেবে তা ব্যবহারের এখতিয়ার কমিশনের রয়েছে (আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাশেম ৪৫ ডিএলআর)। (সূত্র: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৪; প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের তথ্যাবলি। আগামী প্রকাশনী)

নতুন কমিশনের সাফল্য-ব্যর্থতা সম্পর্কে আমরা এখনই ভবিষ্যদ্বাণী করছি না। তাদের মনে রাখা প্রয়োজন আবু হেনা ও শামসুল হুদা কমিশন নির্বাচন করতে গিয়ে যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল, বর্তমান কমিশনকে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় ছিল। এখন দলীয় সরকার।

কমিশন বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে সংলাপ করবে ভালো কথা। প্রশ্ন হলো সেই সংলাপে যেসব প্রস্তাব বা সুপারিশ আসবে, সেগুলো আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, না নূরুল হুদা কমিশনের মতো স্বেচ্ছাচারী কায়দায় কাজ করবে?

আউয়াল কমিশন আগামীকাল থেকে যে সংলাপ শুরু করছে, আমাদের প্রস্তাব হলো তা সরাসরি রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমে প্রচার করা হোক। এতে অন্তত দেশের মানুষ জানতে পারবে কে কী বলছেন, কী চাইছেন। প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের বিষয়ে এখনো কমিশন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। সিইসি নিজেই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের কথা বলেছিলেন, এখন সেই অবস্থান থেকে তারা পেছনে সরে গেলে মানুষ ভাববে সরকারের ইঙ্গিত বা ইচ্ছাতেই এটি হচ্ছে।

দুই সাবেক সিইসি সুষ্ঠু নির্বাচন বিষয়ে বেশ কিছু করণীয় নির্দেশ করেছেন অভিজ্ঞতার আলোকে। আউয়াল কমিশন যদি সত্যিই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে চায়, তাহলে নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের অপচ্ছায়া দূর করতেই হবে। নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়টিকে সিইসি রাজনৈতিক বিষয় বলে চিহ্নিত করেছেন। সেই সমস্যা স্বীকার করেও যে প্রশ্নটি করব, তা হলো রাজনৈতিক সরকারের অধীন নির্বাচন হলেও কেন একটি সংসদ বহাল রেখে অরেকটি সংসদ নির্বাচন হবে এবং সাংসদেরা কেন স্বপদে থেকে নির্বাচন করবেন? তাহলে স্থানীয় সরকার সংস্থার পদাধিকারীদের নির্বাচনের আগে পদত্যাগের বিধানটিও তুলে দিতে হয়। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে যদি এ রকম কোনো বিধান করত, আওয়ামী লীগ কি মেনে নিত? ক্ষমতাসীন দলের বিজ্ঞ নেতারা কী বলেন? এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনেরও সুস্পষ্ট বক্তব্য চাই।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

    sohrabhassan55@gmail.com