মতামত

সাবধান! আগুনের মৌসুম চলছে

চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের দুই বছর পার হয়ে গেছে, পুলিশ তদন্ত শেষ করতে পারেনি
ছবি: প্রথম আলো


মাঘ-ফাল্গুনের হাওয়ার সঙ্গে আগুনের একটা যোগ আছে। শীতে শুকিয়ে থাকা খড়কুটো, শুকনো পাতায় আগুন লাগে সহজে আর মাঘ-ফাল্গুনের বাতাসে সে আগুন বেগ পায় নিমেষে। গত পাঁচ সপ্তাহে মাঘ-ফাল্গুনের আগুনে পুড়েছে পানবরজ, পাটগুদাম, বাজার, দোকান, শ্রমিক কলোনি, কারখানা, বস্তি, সরকারি হাসপাতাল, গ্যাসপাইপ, এমনকি সুন্দরবন। মানুষের মৃত্যুর খবরও আছে। আছেন তালিকায় শিশু, পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রবীণ, কারখানায় আটকে পড়া নিয়োগপত্রবিহীন শ্রমিক।

সুন্দরবনের আগুন  
সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জে আগুন লাগে ৮ ফেব্রুয়ারি ভরদুপুরে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে আনতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বনের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলে, ওপরের আগুন নিভে গেলেও আবার দপ করে জ্বলে উঠতে পারে চাপা পড়া আগুন। গার্মেন্টসের ঝুট গুদামের আগুনের সঙ্গে এই আগুনের মিল অনেক। বনে গাছের পাতা পড়ে পড়ে কয়েক ফুটের স্তর হয়ে যায়। ফলে নেভানোর পরও মাঝে মাঝে জ্বলে ওঠে। তাই এবার সময় লেগেছে।

সুন্দরবনে এখন প্রায় প্রতিবছরই আগুন লাগে। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে গত ২০ বছরে ২৪ বার আগুন লেগেছে। দুর্যোগ ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে ২০০২ সালে কটকা এলাকায় একবার, নাংলী ও  মান্দারবাড়িয়া এলাকায় দুবার, ২০০৫ সালে পচাকোরালিয়া, ঘুটাবাড়িয়ার সুতার খালে দুবার, ২০০৬ সালে তেরাবেকা, আমুরবুনিয়া, খুরাবাড়িয়া, পচাকোরালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার, ২০০৭ সালে পচাকোরালিয়া, নাংলি ও ডুমুরিয়া এলাকায় তিনবার, ২০১০ সালে গুলশাখালীতে একবার, ২০১১ সালে নাংলিতে দুবার, ২০১৪ সালে গুলশাখালীতে একবার, ২০১৬ সালে নাংলি, পচাকোরালিয়া ও তুলাতুলিতে তিনবার, ২০১৭ সালে মাদ্রাসাছিলায় একবার এবং সর্বশেষ ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর এলাকায় আগুন লেগে চার শতক বনভূমি পুড়ে যায়।

বন বিভাগের হিসাবমতে, এসব অগ্নিকাণ্ডে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনভূমির ক্ষতি হয়েছে। খুব রেখেঢেকে করা এক হিসাব অনুযায়ী ক্ষতির আনুমানিক আর্থিক মূল্য ১৮ লাখ ৫৫ হাজার ৫৩৩ টাকা। সুন্দরবন নিয়ে যাঁরা ভাবেন, তাঁদের মতে যে হিসাব দেখানো হয়েছে, প্রকৃত ক্ষতি তার চেয়ে কয়েক শ গুণ বেশি। বন বিভাগ অভ্যন্তরীণ কমিটি দিয়ে তদন্ত করেছে। তাদের স্বার্থেই ক্ষতিপূরণ কম দেখানো হয়েছে। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত ক্ষতি এবং ক্ষতিপূরণের হিসাব থাকা উচিত।

আমরা জানি, অগ্নিকাণ্ডের পরে কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি নির্দিষ্ট সময়ে সুপারিশসহ রিপোর্টও পেশ করে। তবে সেসবই ফাইলবন্দী হয়ে থাকে। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে তদন্ত কমিটির করা সুপারিশ ১৫ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। আগুন লাগার কারণ হিসেবে মৌয়ালদের ব্যবহৃত আগুনের কুণ্ডলী, জেলেদের সিগারেট, দাবদাহ, অনাবৃষ্টি, খরা, বন অপরাধে সাজাপ্রাপ্তদের প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা, দুষ্কৃতকারীদের দ্বারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে বনে আগুন লাগিয়ে দেওয়াকে দায়ী করা হয়। আগুনের স্থায়িত্বের জন্য গাছের পাতার পুরু স্তরকে দায়ী করে তদন্ত কমিটি। শরণখোলা রেঞ্জের বনসংলগ্ন এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় অন্য কারণ। তাঁদের মতে অসাধু বন কর্মকর্তাদের যোগসাজশেই বনের মধ্যে আগুন ধরানো হয়। উদ্দেশ্য বনের মধ্যে মাছ ধরা। পরে মাসোহারা দিয়ে অগ্নিদগ্ধ জায়গায় জাল পেতে মাছ ধরে ‘ওয়ান টাইম’ জেলেরা। এসব কারণে সুন্দরবনে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির দাবি, বিভিন্ন সময় বনরক্ষীদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ ওঠে, তার সঠিক তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, না হলে বন অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রোধ করা যাবে না। সুন্দরবনকে সুরক্ষা করতে হলে লোকালয়-সংলগ্ন নদী-খাল খনন করে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকগুলো আরও জোরালো ও টেকসই করা প্রয়োজন।

এ নগরেই নানা ইমারতের এমন এমন সব তোরণ বানাচ্ছি, যেগুলো দিয়ে জরুরি মুহূর্তে ফায়ার সার্ভিস মই নিয়ে ঢুকতে পারবে না। হয় দেয়াল ভাঙতে হবে, নইলে তোরণ। আগুন কি সেই সময় দেবে?

বারবার যেখানে আগুন লাগে
২৭ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের হাসিনা মার্কেটে আগুন লাগে। এখানে গোডাউন, রেস্তোরাঁ, মরিচের মিল, বিকাশের দোকান, সেলুন ছিল। আগুনে কমপক্ষে ৪০-৫০টি দোকান পুড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত দোকানমালিকেরা জানান, হাসিনা মার্কেটে প্রায়ই আগুন লাগে। দুই সপ্তাহ আগেও মার্কেটের একটি দোকানে আগুন লাগে। দুই বছর আগে লাগা এক আগুনে মার্কেটের তিন শতাধিক দোকান পুড়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত দোকানমালিকদের অভিযোগ, একটি চক্র এই মার্কেটে আগুন ধরিয়ে দেয়।

কারওয়ান বাজারের আরেক আগুনপ্রবণ স্থান বিএসইসি ভবন। ২০০৭, ২০১০-এর পর ২০১৪ সালের নভেম্বরে এই ভবনে আবার আগুন লাগে। ২০০৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির আগুনে অন্তত চারজন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছিলেন। ওই সময় এনটিভি, আরটিভিসহ ১০টি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় পুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। উদ্ধারকাজে প্রথমবারের মতো বিমানবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার ব্যবহৃত হয়। ২০০৭ সালের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তের শুরুতেই বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এটিকে নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং বড় ধরনের নাশকতা বলে সন্দেহ প্রকাশ করে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটিও প্রাথমিক রিপোর্টে ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত’ বলে সন্দেহ করে। কিন্তু পরে আর এ ব্যাপারে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি।

চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের দুই বছর পার হয়ে গেছে, পুলিশ তদন্ত শেষ করতে পারেনি। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত (সিএমএম) পুলিশকে এ পর্যন্ত ১৬ বার সময় দিয়েছেন। কবে মামলার তদন্তকাজ শেষ হবে, তা-ও জানাতে পারছে না পুলিশ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার পরিদর্শক কবির হোসেন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেছেন, চুড়িহাট্টার আগুনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে। অল্প সময়ের মধ্যেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে। দুই বছরেও কেন তদন্ত শেষ হয়নি, এ সম্পর্কে কবির হোসেন বলেন, ‘সব কাগজপত্র সংগ্রহ করে, সবকিছু ঠিকঠাক করে আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। এ মামলায়ও সঠিক ও নির্ভুল তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’

অবশ্য প্রতিবেদন পেলেও কি কিছু হয়? বছর দুয়েক আগে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ারে লাগা প্রাণঘাতী আগুনের কথা নিশ্চয় মনে আছে। ওই ঘটনার আট বছর আগেও একবার সেখানে আগুন লেগেছিল। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে তখন ভবনে আগুন প্রতিরোধে করণীয় কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী আগুন প্রতিরোধে করণীয় কোনো নির্দেশনাই মানা হয়নি। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ এই ভবনটিতে আবার ভয়াবহ আগুনে প্রাণ যায় ২৫ জন মানুষের, নিখোঁজদের তালিকা আরও লম্বা।

নির্বাপণ ও প্রতিরোধ—দুটোই জরুরি
দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। কিন্তু দুর্ঘটনার ঝুঁকি কামানোর কাজটা ভবনমালিকদের দায়িত্ব। এফআর টাওয়ারের দুই দিকে অন্তত ১৫-২০টি ভবন আছে, যেগুলোর একটিরও অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। প্রশ্ন উঠতেই পারে, সিটি করপোরেশন বা রাজউক কেন কোনো তদারকি করেনি। ফায়ার সার্ভিস এসব ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা জোরদার করতে বারবার তাগিদ চিঠি দিয়েছিল। কেউ আমলে নেয়নি, কোনো কাজও হয়নি।

বহুতল ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ফায়ার সার্ভিস এখন আগের চেয়ে অনেক প্রস্তুত। তাঁদের পেশাদারত্ব অহংকার করার মতো। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, দিন দিন আমরা তাদের কাজটা কঠিন করে তুলছি। এ নগরেই নানা ইমারতের এমন এমন সব তোরণ বানাচ্ছি, যেগুলো দিয়ে জরুরি মুহূর্তে ফায়ার সার্ভিস মই নিয়ে ঢুকতে পারবে না। হয় দেয়াল ভাঙতে হবে, নইলে তোরণ। আগুন কি সেই সময় দেবে? ফায়ার সার্ভিসকে তাদের সিভিল ডিফেন্স অংশের ওপর আরও বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করলে আগুন প্রতিরোধে ও নিয়ন্ত্রণে তাঁদের শক্তি অনেক বাড়বে।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক