মতামত

সাপের ঝাঁপি ও ঠার ভাষার গল্প

বেদেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য গড়ে তোলা উত্তরণ ফ্যাশনসে কাজ করছেন বেদে নারীরা।
ছবি: সংগৃহীত

২০১৪ সাল।
একেকটা ঝাঁপিতে একেকটা বিষধর সাপ। কোনোটাতে কেউটে। কোনোটাতে গোখরা। কোনোটাতে দুধরাজ। কোনোটাতে চন্দ্রবোড়া। ঝাঁপির ডালা খুললেই ফোঁস ফোঁস করে ফণা তোলে তারা। এসব ঝাঁপি মাথায় নিয়ে বেদেরা টেকনাফে যান। সাপখেলা দেখান। আবার ফিরে আসেন। কিন্তু এত জায়গা থাকতে টেকনাফেই কেন বেদেরা এত বেশি সাপখেলা দেখাতে যান? সে প্রশ্নের জবাব কিছুদিনের মধ্যেই পুলিশের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। সাপের ঝাঁপির ডালা সরিয়ে সাপ বের করতেই দেখা যায় ঝাঁপির নিচে কায়দা করে ১০ থেকে ১৫ হাজার ইয়াবা বড়ি রাখা। পুলিশ জানতে পারে, এসব ইয়াবার আসল কারবারি বেদেরা নন। তাঁরা মূলত এই নেশার বড়ি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেন। বিনিময়ে কিছু টাকা পান।

গবেষণাগ্রন্থটির প্রচ্ছদ

এই বেদেদের একটা বড় অংশ থাকে সাভারের বেদেপল্লিতে। ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান খবর পেলেন ওই বেদেপল্লিতে মাদকের অভয়াশ্রম গড়ে উঠেছে। সেখানে যাওয়ার জন্য পাকা রাস্তা না থাকায় গাড়ি ঢুকতে পারে না। তাই মাদক কারবারিদের ধরা অসম্ভব। সেখান থেকে কাউকে ধরলে একযোগে সবাই এসে প্রতিহত করে। পুলিশ সুপার ঠিক করলেন, তিনি বেদেদের সঙ্গে কথা বলবেন। ১৭ জন গোত্রপ্রধানের সঙ্গে তিনি বৈঠকে বসলেন। গোত্রপ্রধানেরা জানালেন, তাঁদের জীবন আগে মাদকনির্ভর ছিল না। সময় তাঁদের এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

ঐতিহ্যগতভাবে তাঁরা নৌকাকেন্দ্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। গত কয়েক দশকে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায়, খাল-বিল মরে যাওয়ায় এবং দেশের সার্বিক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় তাঁদের জীবনযাপনের ধরন পাল্টে গেছে। একসময় তাঁরা সাপখেলা দেখাতেন। শিঙা লাগাতেন। সাপে কাটা রোগীর ‘বিষ নামাতেন’। নানা ধরনের গাছগাছড়া ও কবিরাজি ওষুধবিষুধ বিক্রি করতেন। ‘জাদুটোনা করে’ মনের মানুষ কাছে আনার ‘আধ্যাত্মিক তদবির’ দিয়ে রোজগার করতেন।

কিন্তু মানুষ এখন শিক্ষিত হয়েছে। তারা আর তুকতাকে বিশ্বাস করে না। তাদের হাতের নাগালে এখন আধুনিক চিকিৎসা। তাদের সামনে বিনোদনের হাজারো মাধ্যম চলে এসেছে। ফলে বেদেদের সেই সনাতনী সাপখেলার বিনোদন ও তুকতাক করা চিকিৎসায় আর মানুষের আগ্রহ নেই। অথচ এই পরিবর্তনের সঙ্গে বেদেরা নিজেদের হালনাগাদ করতে পারেনি। লেখাপড়া শিখে বা মূলধারার কর্মসংস্থানে ঢুকতে পারেনি। ফলে বাপ-দাদার পেশা হারিয়ে এই হতদরিদ্র মানুষগুলো আরও দরিদ্র হয়ে পড়েছে। আর সেই দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে তাদের মাদক ব্যবসায় ব্যবহার করছে নেপথ্যে থাকা মাদক কারবারিরা।

এই হতদরিদ্র নিষ্পেষিত মানুষের মানবেতর জীবনের ছোট ছোট গল্প হাবিবুর রহমানের মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। তিনি গোত্রপ্রধানদের কাছে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি যদি তাঁদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন, তাহলে তাঁরা মাদকের কারবার ছেড়ে দেবেন কি না। এ কথায় গোত্রপ্রধানেরা একবাক্যে মাদক কারবার ছাড়তে রাজি হয়ে যান। সমাজের দৃষ্টিতে অস্পৃশ্য এই আত্মপ্রত্যয়ী মানুষগুলোর ভালো থাকার আকুতি পুলিশ সুপারকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়।

হাবিবুর রহমান তাঁদের বিকল্প কী কর্মসংস্থান দেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে ভাবছিলেন। তিনি ঠিক করলেন, যেহেতু বেদে জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রধান উপার্জনের দায়িত্ব নারীদের, সেহেতু তাঁদের জন্য আগে কর্মসংস্থান ঠিক করতে হবে। তিনি তাঁর পরিচিতজনদের সহায়তা নিয়ে ‘উত্তরণ ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।

উত্তরণ কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে বেদে কিশোরেরা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে

এর আওতায় শুধু বেদে নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য প্রথমে ‘উত্তরণ ফ্যাশন’ নামের একটি বুটিক হাউস এবং পরে আরও অনেক বেশিসংখ্যক বেদে নারীর কর্মসংস্থানে ‘উত্তরণ ফ্যাশন’ নামের একটি কারখানা গড়ে তোলেন। বেদে শিশুদের পড়াশোনার পাশাপাশি সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পুরুষদের গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। খুব দ্রুত তাঁরা বিকল্প কর্মসংস্থানে ঢুকে যেতে শুরু করেন। বেদে সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি আত্মপরিবর্তনের আন্দোলন শুরু হয়। এই সময়ে হাবিবুর রহমান বিভিন্ন সভায় বেদে প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের রেওয়াজ চালু করেন। এ সময় বেদেরা নিয়মিত এসব সভায় আসতে থাকেন।

হাবিবুর রহমান একদিন খেয়াল করলেন, সভায় আসা বেদেরা নিজেদের মধ্যে অদ্ভুত একটি ভাষায় কথা বলছেন। সেই ভাষার আগামাথা তিনি ধরতে পারছেন না। তিনি তাঁদের মধ্য থেকে একজন পরিচিত বেদেকে এই ভাষা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। ওই বেদে লোকটি তখন তাঁকে জানালেন, বেদেরা নিজেদের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র ভাষায় কথা বলেন, যাতে অন্যরা তাঁদের কথা বুঝতে না পারেন। তাঁদের এই ভাষার কোনো লিপি নেই। এটি কথ্য ভাষা। এই ভাষাকে তাঁরা ‘ঠের’ বা ‘ঠার’ ভাষা বলেন। হাবিবুর রহমান তখন এই ভাষার বিষয়ে আগ্রহী হন। এরপর তিনি এই ভাষা নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা শুরু করেন। ঠারভাষী বেদে ও ভাষাবিজ্ঞানীদের নিয়ে কয়েক দফা সম্মেলনের আয়োজন করেন।

ঠার ভাষার গবেষক ও বাংলাদেশ পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান

২.
প্রায় এক দশকের বেশি সময় কেটে গেছে। হাবিবুর রহমান বাংলাদেশ পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি পদে আসীন হয়েছেন। কিন্তু বেদে জনগোষ্ঠী জীবনমান উন্নয়ন ও ঠার ভাষা নিয়ে তাঁর গবেষণা থেমে থাকেনি। তিনি সুখে-দুঃখে তাঁদের পাশে থেকেছেন। কোন ফাঁকে তিনি তাঁদের অভিভাবক হয়ে গেছেন, তা নিজেও তিনি বুঝতে পারেননি। এর মধ্যে ঠার ভাষা নিয়ে তাঁর গবেষণা চলতে থাকে। প্রায় এক দশক ধরে বিভিন্ন বিদ্যায়তনের শিক্ষক ও গবেষকদের সহায়তায় গবেষণা করে তিনি একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম ‘ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’।

বেদে জনগোষ্ঠীকে মাদক কারবার থেকে বের করে আনতে গিয়ে কীভাবে একজন পুলিশ কর্মকর্তা নিজের জীবনকে তাঁদের জীবনের সঙ্গে এক করে ফেললেন, কীভাবে গোটা দেশের বেদে সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা বদলে দিয়ে তাদের মূলধারায় যুক্ত করার মহান যজ্ঞে নিজেকে উৎসর্গ করলেন এবং সেই জনগোষ্ঠীর কথ্য ভাষাকে নিশ্চিত বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে রীতিমতো ভাষা গবেষক হয়ে উঠলেন, এর এক বিস্ময়-জাগানিয়া আখ্যানগ্রন্থ এ বই।

৩.
‘ঠার’ নামে যে একটি ভাষা আছে, সেটি সাধারণ মানুষের সিংহভাগ জানেই না। ফলে, এই ভাষার অবলুপ্তি নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকার কথাও নয়। কিন্তু যিনি একটি ভাষার ঐতিহ্যিক ও সামাজিক মূল্য উপলব্ধি করতে পারেন, তাঁর কাছে সেই ভাষার অবলুপ্তি কালের গলিত গর্ভে একটি মহামূল্যবান ইতিহাসের অন্যায্য অন্তর্ধান বলে মনে হয়। সেই ভাষা সংবেদনশীল মানুষ একান্ত আত্মিক দায়বদ্ধতা থেকে বিলীয়মান ভাষাকে আগলে রাখার দুর্নিবার চেষ্টা করতে থাকেন। গবেষক হাবিবুর রহমান সে কাজই করেছেন। তাঁর একান্ত আগ্রহ, উদ্যোগ ও নিরলস গবেষণায় ঠার ভাষার অস্তিত্বের মৌলিক তথ্য-উপাত্ত ও শব্দসম্ভার অপরিচয়ের অন্ধকারে চিরতরে বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছে। বহুরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ ভাষা নিয়ে তিনি নিরলস গবেষণা করেছেন। তিনি ভাষাটির শব্দসম্ভার বা ডিকশন ও গবেষণালব্ধ উপাত্তকে একটি বৃহৎ কলেবরে মলাটবন্দী করেছেন।

মাটির নিচে চাপা পড়া শতাব্দীপ্রাচীন পুরাকীর্তি খুঁড়ে বের করার সময় তা খননসরঞ্জামের আঘাতে যাতে বিন্দুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য প্রত্নতাত্ত্বিকেরা অতি সতর্কতায় গবেষণাস্থলের মাটিতে খননসরঞ্জাম সঞ্চালন করেন। বৃহত্তর সমাজের কাছে অপরিচিত ও বিলীয়মান একটি ভাষাও একজন নিবেদিতপ্রাণ ভাষাগবেষকের কাছে প্রত্নসম্পদের মতো। আনাড়ি খোদকের অনভিজ্ঞ কোদাল সঞ্চালনায় মহামূল্যবান প্রত্নসম্পদের অঙ্গহানির যেমন ঝুঁকি থাকে, তেমনি নিতান্ত ভাসা-ভাসা জ্ঞান ও ‘যেনতেন প্রকারণে’ ভাষার গবেষণায়ও সংশ্লিষ্ট ভাষাটির অপূরণীয় ক্ষতির আশঙ্কা রয়ে যায়।

অন্য সব ভাষার মতো ঠার ভাষারও উদ্ভব বা জন্ম এবং ক্রমবিকাশ বা বেড়ে ওঠা আছে। যে সত্তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা আছে, তা প্রকারান্তরে জীবনী সত্তা। সেদিক থেকে এ ভাষার একটি বিমূর্ত জীবনসত্তা আছে। আর যার জীবন আছে, তার জীবনী হতে পারে। এ বই যে আঙ্গিকে বিন্যস্ত হয়েছে, তাতে এটিকে ঠার ভাষার ‘জীবনী’ কিংবা ‘সমাত্মজীবনী’ বলা যায়। কারণ, ঠার ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ বর্ণনা করতে গিয়ে হাবিবুর রহমান শুধু সুনির্দিষ্টভাবে এ ভাষার প্রসঙ্গে আটকে থাকেননি; তিনি সর্বজনীন ভাষার একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেদে সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিজীবনের আবেগসঞ্জাত সংবেদনশীল অভিজ্ঞতা। ফলে, তিনি একটি লুপ্তপ্রায় ভাষার জীবনচিত্র এঁকেছেন, কিন্তু তাতে অন্য সব ভাষার সাধারণ সমাত্মজীবন ধরা পড়ে গেছে।

এ বইয়ের মাধ্যমেই আমরা জানতে পারছি, এর ব্যাকরণ ও গঠনশৈলী বাংলা ভাষার মতো। লেখক আমাদের জানাচ্ছেন, বেদে জনগোষ্ঠী ভবিষ্যতে যাতে তাদের মাতৃভাষার উৎস ও গঠনপ্রকৃতি সম্পর্কে সহজে জানতে পারে, সেটিও এ গবেষণার একটি বড় কারণ। ১১টি অধ্যায়ে বিভক্ত দীর্ঘ কলেবরের এই বইয়ের শুরুতে, অর্থাৎ প্রথম অধ্যায়ে ভাষার সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য, ভাষার উদ্ভব, ভাষার রূপভেদ ও ভাষার বৈচিত্র্য ইত্যাদি একেবারে একাডেমিক আঙ্গিকে বর্ণনা করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ভাষাবিজ্ঞানীদের তত্ত্ব থেকে শুরু করে ধর্মগ্রন্থে ভাষা সম্পর্কে যে ভাষ্য পাওয়া যায়, তার বিশদ তথ্য এ অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হয়েছে।

এর ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় অধ্যায়ে ঠার ভাষার প্রারম্ভিক আলোচনা এসেছে। ‘বেদে জনগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচয় ও ঠার ভাষা’ শীর্ষক অধ্যায়ে বেদে জনগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচয়, ঠার ভাষার উৎস সন্ধান, ভাষা ও সাহিত্যের বিচারে ঠার ভাষার অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ে কিংবদন্তি মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কির আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানতত্ত্বের আলোকে ঠার ভাষার একটি মৌলিক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। এরপরের অধ্যায়গুলোয় পর্যায়ক্রমে ঠার ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি, ধ্বনিতত্ত্ব ও ধ্বনি বিশ্লেষণের আলোকে এ ভাষার প্রকৌশলগত বিন্যাস, রূপতত্ত্ব, ঠার ভাষার মৌলিক শব্দ ও এই ভাষায় দেশি-বিদেশি শব্দের মিশ্রণ, ব্যাকরণ প্রকরণ ইত্যাদি ব্যাকরণগত দিক বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

এর বাইরে ‘ঠার ভাষার শব্দকোষ’ শীর্ষক একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রাখা হয়েছে। এ অধ্যায়ে ঠার ভাষার অসংখ্য শব্দ ও বাংলা ভাষায় তার সমার্থক শব্দ দেওয়া হয়েছে।
বইটির ধ্বনি বিশ্লেষণ পর্বে দেখানো হয়েছে, বাংলা ভাষার বর্ণমালা ও ধ্বনির সঙ্গে ঠার ভাষার ধ্বনির মিল আছে। বাংলা ভাষার ‘শ’ বর্ণটির ক্ষেত্রে ঠার ভাষায় সব সময়ই ‘ন’-এর ব্যবহার হয়। যেমন: বাংলা ভাষার ‘শত্রু’, ‘শরীর’, ‘শ্বশুর’, ‘শালা’, ‘শালি’—এই শব্দগুলো ঠার ভাষায় হয়ে যায় যথাক্রমে, ‘নত্রু’, ‘নরীর’, ‘নালা’, ‘নালি’। একইভাবে ‘স’, ‘ছ’ ও ‘ঝ’ আদ্যক্ষরযুক্ত শব্দও ঠার ভাষায় ‘ন’ আদ্যক্ষরযুক্ত শব্দে রূপ নেয়। যেমন: ‘ছাগল’, ‘ছাদ’, ‘সমস্যা’, ‘সোনালি’, ‘ঝাটা’, ‘ঝাড়ুদার’—এই শব্দগুলো ঠার ভাষায় হয় যথাক্রমে ‘নাগল’, ‘নাদ’, ‘নমস্যা’, ‘নাটা’ ‘নাড়ুদার’। একইভাবে আরও বহু বাংলা শব্দের অনুরূপ ঠার শব্দ আছে। যেমন: বাংলা ‘বারো’, ‘বাইশ’, ‘বিলেই’, ‘বাঘ’, ‘বাক্স’, ‘বাড়ি’, ‘মানুষ’, ‘মাস্টার’—এই শব্দগুলো ঠার ভাষায় হয়ে থাকে যথাক্রমে: ‘ঝারো’, ‘ঝাইশ’, ‘ঝিলেই’, ‘ঝাঘ’, ‘চ্যাক্স’, ‘চিউড়ি’, ‘চেনুষ’, ‘চেস্টার’।

এ ধরনের হাজারো ঠার শব্দ পাওয়া যাবে, যাকে সরাসরি বাংলা ভাষার অপভ্রংশ শব্দ হিসেবে প্রতীয়মান হবে। আবার বহু শব্দ পাওয়া যাবে, যেগুলো একেবারেই মৌলিক শব্দ। যেমন: ‘বাজকোই’ (অলংকার), ‘বান’ (আইন), ‘ঝইনতো’ (ওষুধ), ‘নাচলুই’ (গাছ), ‘গোনকি’ (চোখ), ‘ভোকতু’ (চুল), ‘ছেড়ফে দিগলা’ (ছেড়ে দে), ‘খাপাইতি করপাইছে’ (ডাকাতি করেছে), ‘পাঙফাইছিলাম’ (দেখেছিলাম) ইত্যাদি।

এবার বাক্য ধরে বলা যাক: ‘নেমরিগুলো ঝষ্ট পাগরায় ঝাদের ঝোনো চেভাই নিটুক খুমটোয়’ (মেয়েগুলো কষ্ট পায় তাদের কোনো ভাই নেই বলে)।
হাবিবুর রহমানের গবেষণার অনন্য একটি দিক হলো, তিনি শুধু ঠার ভাষার আদ্যোপান্ত অনুসন্ধানেই থেমে থাকেননি; তিনি এ ভাষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সে বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করেছেন। সে পদক্ষেপগুলো সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কীভাবে কার্যকর করা সম্ভব হবে, তা নিয়েও বিশেষ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। ঠার ভাষার বিলুপ্তি ঠেকাতে তিনি কয়েকটি সুপারিশ করেছেন। যেমন বেদেসহ সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জাতিসত্তা, ভাষা ও সংস্কৃতির সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা; ঠার ভাষা উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় পাঠ্যবই প্রস্তুত করা; সরকারি উদ্যোগে ঠার ভাষার অভিধান প্রণয়ন করা ইত্যাদি।

এ বইয়ে কয়েকটি বিষয় উঠে এসেছে। প্রথমত, এর মধ্যে ভাষা-সম্পর্কিত সর্বজনীন তত্ত্ব ও তথ্যের সন্নিবেশ দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে বেদে সম্প্রদায়ের জীবন ও তাদের ভাষার বিশদ ধারণা দেওয়া হয়েছে। সর্বোপরি, পুরো বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান পাল্টে দেওয়ার জন্য লেখক যে উদ্যোগ নিয়েছেন, সেটিও এ গ্রন্থে উঠে এসেছে। তিনি বেদে জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিশ্চিত করায় কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গ্লানিকর জীবন থেকে মুক্তি দিতে তিনি যে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, এর প্রতিফলও রয়েছে এ বইয়ে। সেদিক থেকে এটি সমগ্র বেদে জনগোষ্ঠীর পরিচিতিমূলক এক মহান আখ্যানগ্রন্থ। ৩৫২ পৃষ্ঠার এ বই প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী পাবলিকেশনস লিমিডেট।


সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই-মেইল: sarfuddin2003@gmail.com