দক্ষিণ চীন সাগরে বিনা বাধায় আধিপত্য বিস্তার করতে পেরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এখন হিমালয়ঘেঁষা স্থলভাগেও একই কায়দা অনুসরণ করছেন। বিশেষ করে ভারত, ভুটান ও নেপালের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় নিজের নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চীন হিমালয় অঞ্চলঘেঁষা তাদের ভূখণ্ডের সীমানায় ও সীমান্ত ছাড়িয়ে অন্য দেশের ভূখণ্ডে অনেক নতুন গ্রাম ও বসতি গড়ে তুলছে, সামরিক স্থাপনাও বসাচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরে নতুন নতুন দ্বীপ গড়ে তোলার সঙ্গে সীমান্তে চীনের নতুন নতুন গ্রাম গড়ে তোলার মিল রয়েছে।
চীনের এই বিস্তারবাদী পদক্ষেপ সরাসরি সামরিক সংঘাতের উসকানি হিসেবে কাজ করছে। অনেক আগে থেকেই চীন হিমালয়ঘেঁষা প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূখণ্ডের মধ্যে একটু একটু করে ঢুকেছে। আপত্তি উঠলে বা বাধার মুখে পড়লে যতটুকু ঢুকেছে, সেখানে থেমে গিয়ে শান্তি আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করেছে এবং সেই সময়ে দখলকৃত জায়গায় স্থায়ী দখলদারি গেড়েছে। অনেক দিন চুপচাপ থেকে সেখান থেকে আবার নতুন করে অনুপ্রবেশ ও দখলদারি করেছে।
চীন হিমালয় অঞ্চলে এখন সেই পুরোনো খেলা শুরু করেছে। হংকংভিত্তিক সংবাদপত্র সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট একটি প্রতিবেদনে বলেছে, হিমালয়ের বিতর্কিত এলাকায় চীন সরকার ৬২৪টি গ্রাম গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে। ‘দারিদ্র্য বিমোচন’ ও পুনর্বাসনের নামে তিব্বতি যাযাবরদের সীমান্তসংলগ্ন পার্বত্য এলাকায় গড়ে তোলা কৃত্রিম গ্রামগুলোতে পাঠিয়ে দিচ্ছে, তাদের ওপর নজরদারি করার ব্যবস্থা করছে। যে দুর্গম সীমান্তে আগে কেউ যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি, চীন সেখানে ঢুকে পুরো এলাকার মালিকানার বিষয়ে একটি বিতর্ক সৃষ্টি করছে। সেখানে বসতি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে নিজেদের সেই জায়গার মালিক বলে দাবি করছে। ভিনদেশের জায়গা দখলের এ কৌশলে সি চিন পিং বেসামরিক মিলিশিয়াদের ব্যবহার করছেন। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব চীন সাগরে মাছ ধরার নৌকায় যে বেসামরিক জেলেরা মাছ ধরার জন্য ঘুরে বেড়ায়, তারা আসলে কোস্টগার্ডদের সমর্থনপুষ্ট ‘মিলিশিয়া’। একইভাবে সীমান্ত এলাকায় সাধারণ গ্রামবাসীর ছদ্মবেশে মূলত মিলিশিয়া মোতায়েন করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কোনো ভূখণ্ডের মালিকানা দাবির মূল ভিত্তি হলো ওই এলাকায় সংশ্লিষ্ট দেশটির শান্তিপূর্ণ সার্বভৌমত্বের চর্চা। অর্থাৎ কোনো দেশ তার দাবি করা ভূখণ্ডে সামরিক উপস্থিতি জারি রাখলেই সেখানকার বৈধ দাবিদার হতে পারবে না, এ জন্য সেখানে তার জনগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ বসতি থাকতে হবে। চীন এত দিন ভূখণ্ড দখলের ক্ষেত্রে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি অনুসরণ করলেও সম্প্রতি আন্তর্জাতিক আইন নিজের পক্ষে টানতে দখল করা জায়গায় বসতি গড়ার দিকে মন দিয়েছে। বসতি ঠিকঠাক গড়ে তুলতে পারলে তারা আন্তর্জাতিক আইন নিজের পক্ষে ব্যবহারের সুযোগ পাবে। কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা গ্রামগুলোকে তারা প্রতিপক্ষের দেশের সামরিক তৎপরতায় নজরদারি করতে পারবে।
চীন খুব দ্রুত গ্রামগুলো গড়ে তুলছে, নতুন নতুন রাস্তাঘাটের পাশাপাশি সামরিক স্থাপনা গড়ে তুলছে। সম্প্রতি ভারতের সীমান্ত রাজ্য অরুণাচল প্রদেশে একটি গ্রাম গড়ে তোলার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে চীন সরকার বলেছে, তারা কখনোই অরুণাচলকে ভারতের ভূখণ্ড বলে স্বীকৃতি দেয়নি। চীনের এ থাবা থেকে বিশ্বের ক্ষুদ্রতম দেশ ভুটান এমনকি চীনপন্থী কমিউনিস্ট শাসিত সরকারের দেশ নেপালও রেহাই পায়নি। ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তিব্বতের যাযাবর সম্প্রদায়কে ভারতের সীমান্ত লাগোয়া পার্বত্য এলাকায় থিতু হয়ে আবাসন গড়ে তুলতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। শুধু ভারতের হিমালয়ঘেঁষা সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করতে প্রেসিডেন্ট সি ‘দারিদ্র্য বিমোচন’ প্রকল্প চালু করে সেখানে যাযাবরদের জন্য বসতি স্থাপন করেন। সাগরে চীনের বিস্তারবাদী তৎপরতা যেভাবে পরিবেশ-প্রতিবেশকে হুমকিতে ফেলেছে, তার ভূমি দখলভিত্তিক এ তৎপরতাও একইভাবে পরিবেশকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে।
একটি আন্তর্জাতিক সালিস আদালতের মতে, দক্ষিণ চীন সাগরে সি চিন পিংয়ের দ্বীপ গড়ে তোলার কারণে প্রবাল প্রাচীর সংশ্লিষ্ট প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। একইভাবে অরুণাচলঘেঁষা পার্বত্য অঞ্চলে কৃত্রিম গ্রাম ও বসতি গড়ে চীন এশিয়ার প্রধান নদীগুলোর উৎস হিমালয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশকে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে। ভুটান দোকলাম নামের যে মালভূমির মালিকানা দাবি করে থাকে, ২০১৭ সালে সে জায়গাটি চীন দখল করে নেয় এবং সেখানে সামরিক স্থাপনা গড়ে তোলে। এরপর থেকে সেখানে কী পরিমাণ পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে, তা সবার কাছেই দৃশ্যমান হচ্ছে।
চীনের এ আগ্রাসনকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করা দরকার। ভারতের সেনাপ্রধান মনোজ মুকুন্দ নরবান সম্প্রতি বলেছেন, চীনের এ ছলচাতুরীর কৌশল ‘কাজ করবে না’। সামরিক শক্তির মোকাবিলা ছাড়াই চীনের এ আগ্রাসন থামাতে হবে। ভারত যদিও সীমান্তে তার সামরিক তৎপরতা অনেক বাড়িয়েছে, তবু প্রায় এক বছর আগে চীন ভারতের যতটুকু ভূখণ্ড দখল করেছিল, তার বেশির ভাগই এখনো তাদের দখলে রয়েছে। সাগরে চীনের আগ্রাসন কৌশল যেভাবে সফল হয়েছে, ভূমিতেও সেই কৌশল কার্যকর রয়েছে। চীনের এ অপকৌশল ঠেকাতে ভারতের সঙ্গে অন্য প্রভাবশালী দেশগুলোকে কাজ করতে হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
ব্রহ্ম চেলানি: নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বিষয়ের অধ্যাপক