শীতলযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যেসব বৈঠক হতো, সেসব বৈঠকে সাধারণত পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবং এ ধরনের অস্ত্র প্রযুক্তি হস্তান্তর ব্যবস্থাকে একটি নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা ইস্যুর ওপর জোর দেওয়া হতো। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে এখনো সে ধরনের আলোচনা হয়ে থাকে। তবে সম্প্রতি জেনেভায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে যে বৈঠক হলো তাতে ভিন্ন একটি প্রযুক্তির পরিসর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেটি হলো সাইবারস্পেস। এ বিষয়ে তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেন গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা শক্ত নয়, কারণ সাইবারস্পেস এবং ইন্টারনেট আধুনিক অর্থনীতি, সমাজ, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সামরিক কার্যক্রমসহ সব ক্ষেত্রের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে উঠেছে। বৃহৎ শক্তিগুলো এ সাইবারস্পেস নিয়ন্ত্রণের অভিলাষে মেতে আছে, কেননা এর মধ্য দিয়ে প্রতিপক্ষের বিভিন্ন খাতে সীমাহীন বিপর্যয় নামানো সম্ভব।
শুধু রাষ্ট্রযন্ত্র নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরের বেসরকারি অনেক পক্ষ সাইবার হামলায় বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে পারে এবং সেই হামলা কখন কীভাবে কারা পরিচালনা করছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে বুঝে ওঠা খুবই দুরূহ। এ কারণে সব পক্ষই এ ক্ষমতায় শক্তিশালী হতে চায়।
বাঁধ প্রকল্প, স্বাস্থ্যসেবাসংক্রান্ত অবকাঠামো, গ্যাস ও তেল উৎপাদন কেন্দ্র, বিদ্যুৎকেন্দ্র, পরমাণু অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, বিমানবন্দর, বড় বড় কারখানাসহ স্পর্শকাতর সব ধরনের স্থাপনায় সাইবার হামলার লক্ষ্যবস্তু বানানোকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এ স্থাপনাগুলোকে সাইবার হামলার আওতামুক্ত করা না গেলে সাইবার সক্ষমতা একটি গণবিধ্বংসী অস্ত্রে পরিণত হতে পারে
একটি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে কখন এবং কোত্থেকে হামলা চালানো হলো তা আমরা সবাই বুঝতে পারি। কিন্তু একটি সাইবার হামলা কখন হলো তা জানতেই অনেকটা লম্বা সময় লেগে যায়। কারা সেই হামলার জন্য দায়ী তা বের করতে আরও অনেক সময় লেগে যায়। এ ধরনের একটি ধীর এবং অনিশ্চিত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রক্রিয়া প্রতিশোধের হুমকিকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
রাশিয়ার সাইবার যোদ্ধারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে প্রচার চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো স্পর্শকাতর অবকাঠামোর সাইবার সিস্টেমে কয়েকবার ঢুকে পড়তে পেরেছে বলে যে ধারণা ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, হতে পারে সেই ধারণাই বাইডেন-পুতিন বৈঠকে এ ইস্যুকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
শুধু রাশিয়াই যে যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ আছে তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে বলা হয়ে থাকে, চীন ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের চাকরি করেন এমন ২ কোটি ২০ লাখ লোকের ব্যক্তিগত নথিপত্র হাতিয়ে নিয়েছে, যা দিয়ে কোন ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করে থাকতে পারেন তা বের করতে সহায়তা করবে।
ঐতিহ্যগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভাষায় ‘উন্মুক্ত, বাধাহীন, সুরক্ষিত এবং নির্ভরযোগ্য’ ইন্টারনেট ব্যবস্থা জারি রাখার পক্ষে। তাদের নীতিগত সিদ্ধান্তের জায়গায় আইডিয়া ও তথ্যের প্রবাহ অবাধ রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সাইবার জগতে ব্যক্তির একান্ত নিভৃতি নিশ্চিত করার বিষয়ে জোর দিয়ে আসছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এখন মনে করতে শুরু করেছে তাদের সেই অবাধ তথ্যপ্রবাহের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে মেধাসম্পদ চুরি করা হচ্ছে ও গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
এ কথা মনে রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্র নিজেই তার ঘোষিত নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থানে চলে গেছে। এমন অভিযোগ এসেছে যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার অন্যের অনুমতি ছাড়াই চিঠির খাম খুলে পড়ার কায়দায় তার নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য ঝাঁপি খুলে দেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল একজোট হয়ে ইরানের পরমাণু স্থাপনায় অন্তর্ঘাত চালানোর জন্য সেখানে ভাইরাস বা ম্যালওয়্যার ইনস্টল করেছিল বলেও অভিযোগ আছে।
এ কারণে সাইবারস্পেসে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা কে কখন চালাবে তার নিশ্চয়তা দেওয়া কঠিন। পুতিন ও বাইডেনের আলোচনার ধারাবাহিকতা হিসেবে এরপর দুই দেশের একটি সমঝোতায় পৌঁছানো উচিত। বাঁধ প্রকল্প, স্বাস্থ্যসেবাসংক্রান্ত অবকাঠামো, গ্যাস ও তেল উৎপাদন কেন্দ্র, বিদ্যুৎকেন্দ্র, পরমাণু অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, বিমানবন্দর, বড় বড় কারখানাসহ স্পর্শকাতর সব ধরনের স্থাপনায় সাইবার হামলার লক্ষ্যবস্তু বানানোকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এ স্থাপনাগুলোকে সাইবার হামলার আওতামুক্ত করা না গেলে সাইবার সক্ষমতা একটি গণবিধ্বংসী অস্ত্রে পরিণত হতে পারে।
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে চুক্তিবদ্ধ হলে ভবিষ্যতে তা অন্যদের জন্য মডেল হবে। এ মডেলে চীন, ইউরোপ ও অন্যরা নিজেদের মধ্যে চুক্তি করতে পারবে। তাহলেই সাইবারস্পেসকে নিরাপদ রাখা অনেক সহজ হয়ে আসবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● রিচার্ড এন হাস কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট