মতামত

সাংবাদিক বুরহান হত্যার হুকুমের আসামি কে?

বুরহান মুজাক্কির
বুরহান মুজাক্কির

সাম্প্রতিককালে বহু সাংবাদিক আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ঠুকে সাংবাদিকদের কারাগারে নিক্ষেপের ঘটনাও কম নয়। ১৯ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই পক্ষের সংঘর্ষে বুরহান মুজাক্কির নামের এক সাংবাদিকের খুন হওয়ার ঘটনা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। বুরহান ছিলেন দৈনিক বাংলাদেশ সমাচার ও নিউজ পোর্টাল বার্তা বাজারের  নোয়াখালী প্রতিনিধি। নোয়াখালী কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে তিনি সাংবাদিকতায় এসেছিলেন। কিন্তু ঘাতকের বুলেট মাত্র ২৫ বছর বয়সে তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিল।

এই হত্যার দায় কে নেবে? একসময় বিরোধী দলের হরতাল অবরোধকে কেন্দ্র করে রাজপথে সংঘাত-সংঘর্ষ হতো। এখন তো দেশে সেই পরিস্থিতি নেই। কিন্তু এরপরও সাংবাদিকের জীবন যে নিরাপদ নয়, কোম্পানীগঞ্জের ঘটনা তার প্রমাণ। আরও উদ্বেগের বিষয়, বুরহান যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ছিলেন, কেউ খোঁজ নেননি। মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে। আগে লাশ নিয়ে দুই দলে টানাটানি হতো। এখন একই দলেরই দুই পক্ষ। বুরহানের মৃত্যুর খবর কোম্পানীগঞ্জে পৌঁছার পর আবদুল কাদের মির্জা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমানের অনুসারীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। মিজানুর বলেছেন বুরহান তাঁদের লোক। মির্জা প্রথমে তাঁকে নিজের লোক বললেও পরে বলেছেন, তিনি একজন সাংবাদিক। তাঁর মৃত্যুতে শোকসভা ডেকেছেন তিনি।

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, শুক্রবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অনুসারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ওরফে বাদলের নেতৃত্বে চাপরাশিরহাট বাজারে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি চাপরাশিরহাট মধ্যবাজারে গেলে কাদের মির্জার সমর্থকেরা মিছিলে হামলা চালান। এ সময় পুলিশ ধাওয়া ও ফাঁকা গুলি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। কিছুক্ষণ পর কাদের মির্জার নেতৃত্বে তাঁর একদল সমর্থক চাপরাশিরহাট এলাকায় যান এবং বাজারসংলগ্ন মিজানুর রহমানের বাড়িতে হামলা চালান। এ সময় দুই পক্ষের সংঘর্ষের ভিডিও চিত্র ধারণকালে সাংবাদিক বুরহান গুলিবিদ্ধ হন।

সংঘর্ষের পর ফেসবুক লাইভে এসে বসুরহাট পৌরসভার মেয়র ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ভাই আবদুল কাদের মির্জা অভিযোগ করেছিলেন, চাপরাশিরহাটে তাঁর লোকজনের ওপর সাংসদ একরাম চৌধুরী ও সাংসদ নিজাম উদ্দিন হাজারীর লোকজন পরিকল্পিতভাবে হামলা চালিয়েছেন। হামলায় তাঁর পক্ষের অন্তত ৫০ জন আহত হন। অন্যদিকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদল বলেছিলেন, ‘বিকেলে আমার বাড়িতে ওবায়দুল কাদেরসহ দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদে আয়োজিত সভা চলাকালে বাড়ির চারদিকে থেকে অবিরত গুলি আসতে থাকে। হামলায় তাঁর সমর্থক অন্তত ৫০ জন নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন।’

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, করোনার কারণে বহুদিন তাঁদের বেচাকেনা বন্ধ ছিল। এখন আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের বিবাদের কারণে তাঁদের দোকানপাট বন্ধ রাখতে হচ্ছে। করোনার প্রকোপ কমলেও কোম্পানীগঞ্জে ক্ষমতাসীন দলের কোন্দল কমেনি।

ভাবা যায়, একটি উপজেলা সদরে মিছিল করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই পক্ষের প্রায় ১০০ লোককে আহত করা হয়েছে। একজন সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। মিছিলে একপক্ষ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছিল না দুই পক্ষই? মিছিলে যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটির কি লাইসেন্স ছিল? লাইসেন্স থাকলেই তা নিয়ে মিছিল করে মানুষ মারা যায়?

এই যে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে একজন সাংবাদিক মারা গেলেন, এর দায় কে নেবে? বৃহত্তর নোয়াখালী কিংবা কোম্পানীগঞ্জে অন্য কোনো দলের কোনো তৎপরতা নেই। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অন্য দল কোনো লোক প্রার্থী দিতেও সাহস পায় না। সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাস করেন। ডানেও আওয়ামী লীগ, বাঁয়েও আওয়ামী লীগ। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, করোনার কারণে বহুদিন তাঁদের বেচাকেনা বন্ধ ছিল। এখন আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের বিবাদের কারণে তাঁদের দোকানপাট বন্ধ রাখতে হচ্ছে। করোনার প্রকোপ কমলেও কোম্পানীগঞ্জে ক্ষমতাসীন দলের কোন্দল কমেনি।

সম্প্রতি নোয়াখালীর রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে বসুর হাট পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আবদুল কাদের মির্জা। তিনি এর আগেও দুবার পৌরসভার মেয়র ছিলেন। মির্জা নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই জানিয়ে দেন, যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসার জন্য গিয়ে তিনি শপথ নিয়েছেন সত্য কথা বলবেন। অন্যায়ের কাছে নতিস্বীকার করবেন না। তিনি আরও বললেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে নোয়াখালী এলাকার এমপিরা পালানোরও দরজা পেতেন না। ২০১৮ সালের নির্বাচনের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, মানুষ ভাতের অধিকার পেলেও ভোটের অধিকার পাননি।

তাঁর বক্তব্য একদিকে বিরোধী দলকে উৎসাহিত করেছে, অন্যদিকে সরকারকে বিব্রত করেছে। এত দিন বিরোধী দল ২০১৮ সালের নির্বাচনে কারচুপি নিয়ে কথা বলত। বিদেশি সংবাদমাধ্যম ও গবেষণা সংস্থাও কিছু তথ্য তুলে ধরেছে। এবারে ক্ষমতাসীন দলের একজন স্থানীয় প্রতিনিধি নির্বাচনে কারচুপির কথা বললেন। কেবল তা-ই নয়, তিনি নোয়াখালী অঞ্চলের অন্তত তিনজন সাংসদ ও জেলা কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে খোদ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।

নোয়াখালী আওয়ামী লীগে মির্জা বনাম মির্জাবিরোধী পক্ষের বিবাদ সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার দিকে গড়িয়েছে। বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জাকে সংগঠনের সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দিয়েছে জেলা আওয়ামী লীগ। কিন্তু এ বিষয়ে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর দলের জেলা সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনম চৌধুরী তা অস্বীকার করেন। সাধারণ সম্পাদক সাংসদ মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী বলেন, অব্যাহতির আদেশ বহাল রয়েছে।

আমরা বিষয়টি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে উপেক্ষা করতে পারতাম, যদি না একজন সাংবাদিক এই নৃশংসতার শিকার না হতেন। আইনের শাসনের স্বার্থেই অপরাধীদের চিহ্নিত ও বিচার করা প্রয়োজন। নিজেদের অপরাধ ঢাকতে দুই পক্ষই কর্মসূচি নিয়েছে। নিহত সাংবাদিকের জন্য মায়াকান্না করছেন। কিন্তু মিছিলের সময় এই কান্না কোথায় ছিল। অন্য কোনো গ্রহ থেকে আসা গুলিতে বুরহান নিহত হননি, তিনি খুন হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই পক্ষের সমর্থকদের গুলিতে। মিছিলে আগ্নেয়াস্ত্র কে বা কারা নিয়ে এসেছিল?

আবদুল কাদের মির্জা যে এত দিন শান্তির কথা বলে আসছিলেন, সেসব কি নিছকই কথার কথা ছিল? এর আগে তিনি নিজের কর্মীদের লাঠিসোঁটা নিয়ে সমাবেশে আসতে এবং হাঁটুর নিচে পেটাতে বলেছিলেন। শান্তির অতন্দ্রপ্রহরীর মুখে এই অশান্তির বাণী কেন?

বিএনপি আহূত হরতাল-অবরোধে বাসে আগুনে পুড়ে মানুষ মারা গেলে বিএনপির নেতারা যদি হুকুমের আসামি হন, আওয়ামী লীগের মিছিলকারীদের গুলিতে সাংবাদিক নিহত হওয়ার ঘটনায় তাঁরা কেন হুকুমের আসামি হবেন না? দুই পক্ষই বলছে, প্রতিপক্ষের গুলিতে বুরহান মারা গেছেন। এখন প্রকৃত খুনি কিংবা হুকুমের আসামিকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারেরই।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com