‘আমিত্ব’ আর ‘পশুত্ব’ একে অন্যের দোসর। মানুষের মধ্যে আমিত্ব গ্যাঁট হয়ে বসলে পশুত্ব শিকড় গাড়ে। এতে মানবতাবোধ পালায়, পাশবিকতা ডালপালা ছড়ায়। আমিই শুধু খাব, অন্য কাউকে খেতে দেব না; আমিই শুধু বলব, আর কাউকে বলতে দেব না, আমার কথার বাইরে ভিন্নমত সহ্য করব না—এই আমিত্ব সর্বনেশে।
বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তা জাজ্বল্যমান।
আবরারকে যাঁরা মেরেছেন, তাঁরা তাঁদের আমিত্বকে জিইয়ে রাখতে গিয়ে মানবতাবোধ, মমত্ববোধ, নৈতিকতা সব খেয়ে ফেলেছেন। এখানে আমিত্বের কাছে পশুত্বের জয় হয়েছে।
আবরার হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া সবাই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। যেকোনো ছাত্রসংগঠনই নির্দিষ্ট কিছু আদর্শকে সামনে রেখে গড়ে ওঠে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা ঘিরে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হওয়ার দিকনির্দেশনা থাকে। মূল লক্ষ্য থাকে শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষার্থীদের সার্বিক কল্যাণসাধন।
কিন্তু আবরার হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থীরা সাংগঠনিক নীতি-আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে ‘আমিত্বের’ বেড়াজালে আষ্টেপৃষ্ঠে এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের বিবেক ও মানবতাবোধ বলে কিছু ছিল না। তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন একজন ‘আমি’। সংগঠনপরিপন্থী কাজের দায়ে এর মধ্যে ১৪ জন নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আমিত্ব ধারণ করার এটাই পরিণতি। এরপর হত্যার অভিযোগে আইনি বিচার তো আছেই।
আমি বা আমরাই সেরা, ভিন্নমতের ভিন্ন কারও অস্তিত্বই রাখব নাÑনশ্বর পৃথিবীতে, এ ধরনের মনোভাব বাতুলতা বৈ কিছু নয়। কারণ মানুষ কোনো কিছু যত শক্ত করেই আঁকড়ে ধরুক না কেন, সময়ের পরিক্রমায় তার মুঠো এক সময় আলগা হবেই। সে ক্ষেত্রে সর্বজনীন ভূমিকা সম্মানের আসনে বসাবে, আর আমিত্ব তাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেবে।
‘আমিত্বের’ কঠিন পূজারি ছিলেন জার্মান একনায়ক হিটলার। গোটা বিশ্বকে তাঁর পদতলে রাখতে গিয়ে কী নির্মম পরিণতি তিনি বরণ করেছিলেন, তা সবারই জানা। হ্যাঁ, তিনি অমর হয়েছেন। তবে নিন্দার পাত্র হয়ে।
উগান্ডায় সত্তরের দশকে ক্ষমতায় আসা সামরিক স্বৈরশাসক ইদি আমিন নিজেকে ছাড়া আর কিছুই বুঝতেন না। প্রায় এক দশকের শাসনামলে গোটা উগান্ডাকে তিনি জীবন্ত নরক বানিয়ে ছাড়েন। তিনি নির্বিচারে শুধু মানুষই হত্যা করতেন না, নরমুণ্ডু সাজিয়ে তামাশা দেখতেন। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দূরে থাক, কেউ তাঁর বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করলেই মাথা কেটে নিতেন। তাঁর টর্চার সেলে যে কত মানুষের প্রাণ গেছে, এর ইয়ত্তা নেই। কুখ্যাতি জুটেছিল ‘বুচার অব উগান্ডা’ বলে। ১৯৭৮ সালে তাঁরও পতন হয়েছিল নির্মমভাবে। তিনি সেই যে দেশ ছেড়েছিলেন, মরণেও দেশের মাটিতে ঠাঁই হয়নি। অথচ এটাই ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছা।
প্রত্যেক মানুষের সঙ্গে ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায় দানব। সময় সুযোগ বুঝে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে। মার্ক টোয়েনের ‘ক্যানিবালিজম ইন দ্য কারস’ শীর্ষক গল্পে আছে যে দুর্গম অঞ্চলে আটকে পড়া একদল মানুষ এক সপ্তাহ না খেয়ে থাকার পর একে অপরের মাংস খাওয়ার জন্য কীভাবে ব্যাকুল হয়ে ওঠে।
১৯৭২ সালের একটি বাস্তব ঘটনা তো গল্প-কাহিনিকেও হার মানায়। সে বছর এই অক্টোবরেই আন্দেজ পর্বতমালার দুর্গম অঞ্চলে আছড়ে পড়েছিল উরুগুয়ের এক উড়োজাহাজ। প্রাণে রক্ষা পেয়েছিল ২৬ জন যাত্রী। বরফ ছাওয়া ওই বিরূপ পরিবেশে দিনের পর দিন না খেয়ে থেকে তাঁরাও বাধ্য হয়েছিলেন নরমাংস খেতে। আমাকে বাঁচতে হবে, পেটে কিছু দিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হবে—দুর্নিবার এই তাড়না থেকে তাঁরা নরখাদক বনে গিয়েছিলেন।
কিন্তু আবরারকে যেভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, এর মধ্যে প্রাণ বাঁচানোর কোনো তাড়না ছিল না। ছিল এক ধরনের বুনো উন্মাদনা। এ ঘটনায় যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, সবাই ভদ্র বা নিরীহ পরিবারের সন্তান। প্রত্যেকেই যে মেধাবী, তা বলাই বাহুল্য। নইলে বুয়েটে পড়ার সুযোগ পাবেন কেন? বিভিন্ন ওয়েবসাইটে তাঁদের স্বজন ও পাড়া-পড়শির যে বক্তব্য দেখা যায়, এতে কারও পটভূমি উচ্ছৃঙ্খল ছিল না। কেউ কোনো অপরাধ বা সহিংসতায় জড়াননি। বরং বেশির ভাগই শান্তসুবোধ ভাবমূর্তি নিয়ে বুয়েটে এসেছেন। পরে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রশাসনিক দুর্বলতায় ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগে ক্রমে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। যার পরিণতি এই দুর্বৃত্তায়ন।
আবরার হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া ১৯ জনের মধ্যে ৫ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁদের কথায় এসেছে যে শিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার সন্দেহে আবরারকে পেটানো হয়। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংগঠনভিত্তিক ছাত্ররাজনীতির এই সহিংসতা নতুন নয়। শুধু ছাত্রলীগকে দুষলেই তো হবে না। ছাত্রদল বা শিবিরও কি কম? বিশেষ করে শিবিরের রগকাটা সুবিদিত। দেখা গেছে, যে ছাত্রসংগঠনই সুযোগ পেয়েছে, তারাই অন্য সংগঠনের ওপর বলপ্রয়োগের মাধ্যমে একক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেছে। সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ঘটনায় কত যে শিক্ষার্থীর জীবন গেছে, তার হিসাব মেলা ভার।
কিন্তু বুয়েটের মতো বিশেষায়িত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের সহিংসতা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত। সংবাদমাধ্যমে এসেছে, ফেসবুকে আবরারের দেওয়া একটি স্ট্যাটাসের কারণে তাঁর ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বড় ভাইয়েরা’ রুষ্ট হয়েছিলেন। সমাজ বা রাষ্ট্রে কোনো ঘটনা ঘটলে সেই সমাজ বা রাষ্ট্রের মানুষ মতামত দেবেই। এসব বিষয়ে নানাজনের নানা মত হওয়াই স্বাভাবিক। এখানে বড় কথা হলো, কাজটা সমাজ বা রাষ্ট্রের পক্ষে সত্যিই কল্যাণকর হলো কি না। তা যদি হয়, তবে তো সমালোচকদের থোঁতা মুখ এমনিতেই ভোঁতা হয়ে যাবে। তাঁকে ছেঁচা দেওয়ার দরকারটা কী? আর জোর করে কি সাধারণের মুখ আটকানো যায়? ঠেকানো যায় জনমত?
এই যে সৌদি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে তুরস্কের সৌদি দূতাবাসে কেটে টুকরা টুকরা করা হলো, এতে কি সৌদি প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান সমালোচনা-ধিক্কার থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন? এক খাসোগি চোখ বুজেছেন তো শত খাসোগি জেগে উঠেছেন। তাঁরা সবই দেখছেন, আগের চেয়ে কঠোর ভাষায় লিখছেন। একপর্যায়ে মোহাম্মদ বিন সালমান তো মেনেই নিলেন, যেহেতু সৌদি দূতাবাসে এ ঘটনা ঘটেছে, সেই হিসেবে এই হত্যার দায়ভার তাঁর ওপরও বর্তায়।
বুয়েট এ দেশের বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের কাছে তীর্থস্থানসম। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী শৈশব থেকে বুয়েটে পড়ার স্বপ্ন লালন করে। অনেক অভিভাবক স্বপ্ন দেখেন, আদরের সন্তান বুয়েটে পড়ে প্রকৌশলী হবে। সীমিত আসন ও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সে স্বপ্নসাধ পূরণ হয় না। যাঁরা বুয়েটে পড়েন, তাঁরা অবশ্যই শিক্ষার্থী হিসেবে বিশেষ যোগ্যতার অধিকারী। তাঁদের কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশাও অনেক। এই শিক্ষার্থীরা সংগঠনভিত্তিক গণ্ডিবদ্ধ কর্মকাণ্ডে আবদ্ধ থেকে পেশিশক্তির চর্চা করবেন, তা অনভিপ্রেত ও বড্ড বেমানান। তাঁদের জ্ঞানবুদ্ধির চারণভূমি হবে গোটা দেশ, সারা বিশ্ব। সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে থেকে তাঁরা মুক্তবুদ্ধির অবারিত দ্বারে উপনীত হবেন। তাঁদের নানা মত, বুদ্ধিবৃত্তিক নানা কৌশল দেশ ও জাতির জন্য এনে দেবে সাগর সেঁচা কাঙ্ক্ষিত মুক্তা; যার মঙ্গল দ্যুতিতে উদ্ভাসিত হবে সারা দেশ। বুয়েট হবে এমন এক পবিত্র বিদ্যাপীঠ, যার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের মনে হবে—এটা আমাদের দেশ গড়ার ভবিষ্যৎ কারিগরদের লালনভূমি, যার মধ্যে মঙ্গল আলোক ছাড়া আর কিছু নেই।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক ও সাহিত্যিক।
shariful.bhuiyan@prothomalo.com