সর্বজনীন পেনশন বাস্তবায়নে যে বাধাগুলো রয়েছে

সরকার ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী নাগরিকের জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছেন। আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে এই ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হবে বলে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন। প্রথম দিকে এই ব্যবস্থা ঐচ্ছিক হবে। অর্থাৎ যাঁর ইচ্ছা তিনি এই পেনশন স্কিমে যুক্ত হবেন। পরবর্তীতে এটি সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হবে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যানুসারে শুরুতে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মীরা এই কর্মসূচির বাইরে থাকবেন। কারণ তাঁরা এরই মধ্যে পেনশন সুবিধা পাচ্ছেন। গেল কয়েক বছর ধরেই অর্থ বিভাগ একটি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করে আসছিল। গেল ১৭ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ষাটোর্ধ্ব নাগরিকদের সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর নির্দেশনা দেন। সেই সঙ্গে এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নেরও তাগিদ দেন। একই দিন গণভবনে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার’ ওপর একটি কৌশলপত্র উপস্থাপন করেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২১ সালের খসড়া হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮ কোটি ৪৬ লাখ ৫৯ হাজার ৫১০। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ১৪ লাখের বেশি। তাঁদের বাদ দিলে আগামী এক বছরে সরকার প্রায় ৮ কোটি ৩২ লাখের বেশি মানুষকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে চাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, পেনশনব্যবস্থা সম্পর্কে সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে- বার্ধক্যজনিত কারণে যাঁরা অভাবগ্রস্ত হবেন, তাঁদের এই সুবিধা দেওয়া হবে। এই অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য সাহায্যের প্রয়োজন হবে। এই সাহায্য পাওয়া রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার।  

বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান গড় আয়ু ৭৩ বছর। ২০৫০ সালে সেটি ৮০ বছর হবে। ২০৭৫ সালের প্রাক্কলনে গড় আয়ু হবে ৮৫ বছর। ফলে আগামী তিন দশকে মানুষ অবসর গ্রহণের পর আরও ২০ বছর বেঁচে থাকবেন। অর্থ বিভাগ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার খসড়া অনুযায়ী, প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি পেনশন অ্যাকাউন্ট থাকবে। কেউ চাকরি পরিবর্তন করলেও পেনশন হিসাব অপরিবর্তিত থাকবে। মাসিক সর্বনিম্ন জমার অর্থ নির্ধারিত থাকবে। তবে প্রবাসীরা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে অর্থ জমা দিতে পারবেন। অর্থ জমা দিতে ব্যর্থ হলে হিসাব সাময়িক বন্ধ থাকবে। পরে জরিমানাসহ বকেয়া দিয়ে হিসাব চালু করতে পারবেন। কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিলে নাগরিকেরা পেনশন পাওয়ার যোগ্য হবেন। ৬০ বছর পূর্তিতে তাঁরা নির্ধারিত হারে পেনশন পাবেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁরা এই সুবিধা পাবেন। ৭৫ বছর বয়সের আগে কেউ মারা গেলে তার নমিনি পেনশন সুবিধা পাবেন। সে ক্ষেত্রে নমিনি ৭৫ বছর পর্যন্ত পেনশন পাবেন। তবে জমাকারীর অবর্তমানে এককালীন টাকা তোলার সুযোগ থাকবে না।

খসড়া অনুযায়ী, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পেনশনের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ হিসেবে উত্তোলন করা যাবে। এ জন্য সুদ গুনতে হবে। কেউ ১০ বছর অর্থ জমা দেওয়ার পর মারা গেলে টাকা পাবেন তাঁর নমিনি। পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার জন্য একটি আলাদা পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। প্রণয়ন করা হবে পৃথক আইন। খসড়ায় আরও বলা হয়, পেনশনের জন্য নির্ধারিত জমা দেওয়া অর্থ বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে এবং মাসিক পেনশন বাবদ প্রাপ্ত অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। এ ব্যবস্থা স্থানান্তরযোগ্য ও সহজগম্য। কর্মী চাকরি পরিবর্তন বা স্থান পরিবর্তন করলেও তাঁর অবসর হিসাবের স্থিতি, চাঁদা ও অবসর সুবিধা অব্যাহত থাকবে।

খসড়ায় আরও আছে, দরিদ্র নাগরিকদের ক্ষেত্রে পেনশন স্কিমে মাসিক জমার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারে। পেনশন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ব্যয় সরকার নির্বাহ করবে। পেনশন কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের জমা দেওয়া অর্থ নির্ধারিত গাইডলাইন অনুযায়ী বিনিয়োগ করবে। অর্থ বিভাগ থেকে অনুমানভিত্তিক একটি হিসাবে বলা হয়েছে, কেউ ১৮ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা জমা দিলে ১০ শতাংশ মুনাফা এবং আনুতোষিক ৮ শতাংশ হিসাব ধরে ৬০ বছর বয়সের পর ৮০ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি মাসে ৬৪ হাজার ৭৭৬ টাকা পেনশন পাবেন। কেউ ৩০ বছর বয়সে অর্থ জমা দেওয়া শুরু করে ৬০ বছর পর্যন্ত অব্যাহত রাখলে অবসরের পর প্রতি মাসে ১৮ হাজার ৯০৮ টাকা পেনশন পাবেন। তবে চাঁদার পরিমাণ এক হাজার টাকার বেশি হলে আনুপাতিক হারে পেনশনের পরিমাণও বেশি হবে।

২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে অর্থমন্ত্রী প্রতি বাজেটেই সর্বজনীন পেনশন নিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু খুব একটা অগ্রগতি হচ্ছিল না। অবশেষে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হওয়া নিয়ে সুনির্দিষ্ট আভাস মিলেছে। কিছুটা দেরিতে হলেও সামাজিক সুরক্ষা বিবেচনায় এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে বাস্তবায়নে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ।

অতীতে সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের তহবিল তছরুপ বা অর্থ লুটপাটের ঘটনা কম নয়। তাই যারা সুবিধাভোগীর টাকা বিনিয়োগ করবেন, তাদের স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। সঠিকভাবে বিনিয়োগ করতে পারলে এ পেনশন তহবিল থেকে যা আয় হবে তা দিয়েই মাসিক পেনশন দেওয়া সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশ তার প্রমাণও রেখেছে। তাই কোনোভাবে এ তহবিলের অর্থ যেন ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ না হয়, তার জন্য প্রয়োজন সতর্ক প্রয়াস।

ক্রমেই আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়ছে। বিপরীতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাড়ছে না রাজস্ব আয়। অর্থ সংকটে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রকল্প চালিয়ে নিতেও হিমশিম খাচ্ছে সরকার। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের জন্য প্রাথমিক তহবিলটা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকেই জোগাতে হবে। কাজেই সেই অর্থ কোথা থেকে সংস্থান করা হবে, সেটি নিয়ে রয়ে যাচ্ছে অনিশ্চয়তা। আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো কেমন হবে, কীভাবে গঠন হবে পেনশন কর্তৃপক্ষ, তাদের দায়দায়িত্ব কী হবে, কার্যপ্রণালি কেমন হবে, ন্যূনতম প্রিমিয়াম হার কত হবে, তহবিল ব্যবস্থাপনা কেমন হবে, কীভাবে এবং কোথায় পেনশন তহবিল বিনিয়োগ হবে, লভ্যাংশ কীভাবে বণ্টন করা হবে, সেগুলো নিয়েও রয়েছে অস্পষ্টতা। তা ছাড়াও বিপুলসংখ্যক মানুষের নামে পৃথক হিসাব খোলা, সেটি স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালনা করা যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন অনেকেই।

বিশ্বের অনেক দেশেই এরই মধ্যে কার্যকর করা হয়েছে সর্বজনীন পেনশন। তবে পেনশন ব্যবস্থার উৎকর্ষে বিভিন্ন দেশের মধ্যে রয়েছে বিস্তর তারতম্য। বর্তমানে বিশ্বের সর্বোত্তম পেনশন ব্যবস্থা পরিচালনার খ্যাতি অর্জন করেছে আইসল্যান্ড। ভালো করছে নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, ইসরায়েল, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, কানাডা, জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশ। সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা, সুশাসন, বয়স্ক সব জনগোষ্ঠীকে পর্যাপ্ত অবসর সুবিধার আওতায় আনা, রাষ্ট্রীয় উদার আর্থিক সমর্থন নিশ্চিতের কারণেই দেশগুলো বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হচ্ছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। দেশটির কয়েকটি রাজ্যে কার্যকরভাবে পরিচালিত হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা। সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে সেখানে লাভজনক বিভিন্ন উদ্যোগে লগ্নি করা হচ্ছে পেনশন তহবিল। সেখান থেকে প্রাপ্ত রিটার্নের একটা অংশ দিয়ে পরিচালন ব্যয় মেটানো হচ্ছে। আরেকটা অংশ সুবিধাভোগীকে দেওয়া হচ্ছে। ফলে সরকারের ওপর চাপ থাকছে কম, অন্যদিকে বিপুল জনগোষ্ঠী পাচ্ছে অবসর সুবিধা। এ কারণেই ভারতসহ উল্লিখিত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা ও কর্মপ্রক্রিয়া আমাদের জন্য বিবেচ্য হতে পারে।

অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী ও নিম্নমধ্যবিত্তদের পক্ষে প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা দেওয়া কষ্টসাধ্য হবে। কাজেই প্রিমিয়াম নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাদের কথা মাথায় রাখতে হবে। তা ছাড়া প্রথম দিকে কারা কারা পেনশন সুবিধাভোগী হবেন, এর বৈশিষ্ট্য ঠিক করার ক্ষেত্রেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা ভাবতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় কিংবা স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে যেন এ তালিকা তৈরি করা না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তহবিলের অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও অনেক সাবধান হতে হবে। অতীতে সরকারি বা আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের তহবিল তছরুপ বা অর্থ লুটপাটের ঘটনা কম নয়। তাই যারা সুবিধাভোগীর টাকা বিনিয়োগ করবেন, তাদের স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। সঠিকভাবে বিনিয়োগ করতে পারলে এ পেনশন তহবিল থেকে যা আয় হবে তা দিয়েই মাসিক পেনশন দেওয়া সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশ তার প্রমাণও রেখেছে। তাই কোনোভাবে এ তহবিলের অর্থ যেন ঝুঁকিপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ না হয়, তার জন্য প্রয়োজন সতর্ক প্রয়াস। সার্বিকভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় নিশ্চিত করতে হবে সুশাসন। প্রত্যেক সুবিধাভোগীর নামে বছরের প্রথমে পেনশন হিসাব বিবরণী প্রেরণ, প্রতি মাসে পেনশন বিতরণ করা, সেই সঙ্গে মেসেজ পাঠানো ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। কাজেই শুরু থেকেই একটি সমন্বিত প্রযুক্তি সমাধানের মাধ্যমে এ কর্মযজ্ঞ চালু করতে হবে।

সন্দেহ নেই, সরকার পেনশন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী শক্তিশালী এবং বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে চাইছে। এটি এক সঠিক নির্দেশনার পদক্ষেপ। তবে বিদ্যমান বাস্তবতায় তা বাস্তবায়ন খুব একটা সহজ নয়। বর্তমানে দেশে বিভিন্ন ধরনের অবসর সুবিধার বিধান রয়েছে। যেমন সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারা অবসরে যাওয়ার পর নিয়মিত শতভাগ পেনশন পান। অনেক স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পেনশন সুবিধা না থাকলেও রয়েছে প্রভিডেন্ট ফান্ড ও গ্র্যাচুইটির সুবিধা।

আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও আছে এ ধরনের সুবিধা। বাকিদের কোনো অবসর সুবিধাই নেই। এ রকম ভিন্ন ভিন্ন ধরনের পেনশন সুবিধা বহাল রেখে সর্বজনীন পেনশন চালু করা অনেক দুরূহ। অন্যদিকে জোরপূর্বক কিংবা জোড়াতালি দিয়ে কোনো রকম একটা ব্যবস্থা চালু করলে তা দীর্ঘ মেয়াদে ফলপ্রসূ হবে না। অনেক ক্ষেত্রে টিকিয়ে রাখাও কঠিন হবে। তাই শুধু নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নয়, সব দিক পর্যালোচনা করে ধীরে-সুস্থে একটি সমন্বিত, কার্যকর সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা গড়ে তোলাই হবে মঙ্গলজনক।

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক।