>দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তৃতীয় বার্ষিকী আজ। এই প্রেক্ষাপটে দেশের রাজনীতি, নির্বাচন ও গণতন্ত্রের অবস্থা বিশ্লেষণ করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. হারুন অর রশিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের দিন থেকে এ পর্যন্ত তিন বছর বর্তমান সরকারকে নানা ধরনের প্রতিকূলতা ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তবে এক কথায় যদি বলি, সরকার এসব চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূল অবস্থা সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে যে নির্বাচন হয়, সে নির্বাচন দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বেশ কিছু দল বর্জন করেছিল। কিন্তু বিএনপি ও তার সঙ্গী জামায়াতে ইসলামী কেবল নির্বাচন বর্জনই করেনি, নির্বাচনকে ঠেকাতে তারা সহিংস কার্যক্রম চালায়। এ রকম পরিস্থিতিতেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন হয় এবং প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী না থাকায় ১৫৪ জন সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহত করার পথ বেছে নেওয়ায় এত বিপুলসংখ্যক সাংসদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, যা অস্বাভাবিক ছিল না।
নির্বাচনের পর তখন অনেকে সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে আশঙ্কা করেছিলেন। বিদেশিদের কাছে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও অনেকের প্রশ্ন ছিল। কিন্তু দেখা গেল, সরকার পাঁচ বছর মেয়াদের তিন বছর ভালোভাবেই পূর্ণ করেছে এবং সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থার ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রয়েছে। বিদেশিদের কাছেও বর্তমান সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন বা দ্বিধা দেখা যায়নি। এটা সরকারের বড় সাফল্য এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কৃতিত্ব বলে মনে করি।
শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালের পর জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে দেশ গঠনে তাঁর অবদান ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। বিশ্বপরিসরে তাঁর নেতৃত্ব স্বীকৃত হয়েছে। এই তিন বছরে সরকারের অর্জনের মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ সেতু নির্মাণ, চীনের সহযোগিতায় গভীর সমুদ্রবন্দরে টানেল নির্মাণসহ বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া দ্রব্যমূল্য সহনশীল, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে এবং বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশ ঊর্ধ্বগামী। অর্থাৎ দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
তবে গত তিন বছরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জন হলো চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী ও একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের বিচার ও শাস্তির রায় কার্যকর করা হয়েছে ও হচ্ছে। এটা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। ন্যায়বিচার ও ইতিহাসের দায়মুক্তির জন্যও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার হওয়া দরকার ছিল। সেটা হয়েছে।
এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন পর্বের উত্তরণ ঘটবে আশা করা যায়। আমি মনে করি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত জামায়াতে ইসলামীও নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীর নামে এ দেশে রাজনীতি চলতে পারে না। নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে দলটির নিবন্ধন বাতিল করেছে। আমার জানামতে, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় রয়েছে।
তিন বছরে সন্ত্রাসী ও উগ্রগোষ্ঠীর উত্থান হলেও সরকার কঠোর হস্তে তা নিয়ন্ত্রণ করেছে। গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গিরা বিদেশিসহ ২২ জনকে হত্যা করে। এ ছাড়া কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়াসহ আরও বেশ কিছু জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। ইতালির ও জাপানের নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছে। মনে হচ্ছে সুপরিকল্পিতভাবে দেশকে অস্থিতিশীল করতে ও বিদেশিদের কাছে সরকারকে অগ্রহণযোগ্য করতেই এসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
কিন্তু অস্বীকার করা যাবে না যে জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার জিরো টলারেন্স দেখাচ্ছে এবং শক্ত হাতেই তাদের মোকাবিলা করেছে। সরকারের এই পদক্ষেপ দেশে ও বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। জঙ্গিরা যতই গুপ্তহত্যা চালাক না কেন সুবিধা করতে পারবে না, বাংলাদেশের মানুষ জঙ্গিবাদকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে। আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য হচ্ছে সমন্বয় ও পারস্পরিক সহাবস্থানের। হলি আর্টিজানের পরও দেশবাসী সেটি প্রমাণ করেছে।
গণতন্ত্রে বিরোধী দল থাকবে এবং বিএনপিকেই আমি প্রধান বিরোধী দল মনে করি। কিন্তু তারা রাজনৈতিকভাবে সাংঘাতিক দুর্বল। ভুল পদক্ষেপ নিয়ে এখন খাদে পড়ে গেছে দলটি। এর কারণ বিএনপির রাজনীতি অপরিচ্ছন্ন ও দিকনির্দেশনাহীন। দলটি যেনতেনভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অতীতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করেছে। বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেরও বিরোধিতা করেছে।
কিন্তু আমি মনে করি এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর অবদানকে উপেক্ষা করে রাজনীতি করার সুযোগ নেই। বিএনপির আজকের নাজুক পরিস্থিতির কারণ হলো জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো এবং সরকারের এক বছর পূর্তি অর্থাৎ ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি যেভাবে দেশকে নৈরাজ্যের ভেতরে ঠেলে দিয়েছে, তা কোনো রাজনৈতিক দলের আচরণ হতে পারে না।
তবে সাম্প্রতিক কালে বিএনপির কিছুটা বোধোদয় হয়েছে। তারা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং ৯৬ হাজার ভোট পেয়েছে। এর আগে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিলেও ভোটের মাঝামাঝি সময়ে এসে বর্জন করেছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত ছিল এবং নির্বাচনের ফলাফলও অনেকটা মেনে নিয়েছে।
আমাদের প্রত্যাশা থাকবে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে এবং নির্বাচন নারায়ণগঞ্জের মতো সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে। বিএনপিকে যেনতেনভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা পরিহার করতে হবে। জনগণকে আস্থায় নিতে হবে এবং আস্থার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দলের অবস্থানও সম্মানজনক। বিরোধী দলে থেকেও মানুষের জন্য অনেক কিছু করা সম্ভব।
আমার মনে হয়, ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে বিএনপি শিক্ষা নিয়েছে এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনে তারা অংশ নেবে। কেননা বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলে তা হবে দ্বিতীয়বারের মতো আত্মহত্যার শামিল। এখন নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছেন। এটি খুবই ভালো উদ্যোগ। সব দলের সহযোগিতা থাকলে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হওয়া সম্ভব। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন তার উদাহরণ। আমাদের বিশ্বাস যঁাদের ওপর মানুষের আস্থা রয়েছে তাঁদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে এবং সেই কমিশন আগামী নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করবে।
হারুন-অর-রশিদ: উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।