মতামত

সরকার কেন ‘জি হুজুর’ উপাচার্য চায়

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে ধন্যবাদ। এই প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের একজন মন্ত্রী স্বীকার করলেন যে তাঁরা যোগ্য ব্যক্তিকে যোগ্য পদে বসাতে চেয়েও পারছেন না। আবার যাঁদের বসানো হয়, তাঁরাও ঠিকমতো কাজ করছেন না। তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগও অনেকাংশে সত্য। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ প্রসঙ্গেই তিনি কথাগুলো বলেছিলেন।

গত মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রী জাতীয় সংসদে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুর বিল-২০২২’ উত্থাপন করেন। এ সময় বিরোধী দলের সদস্যদের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের বরেণ্য শিক্ষকেরা আছেন, যাঁদের উপাচার্য হিসেবে পেলে গর্ব অনুভব করতাম। কিন্তু তাঁদের অনেকেই এ প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হন না। আমরা চাইলেও সবচেয়ে ভালো কেউ আগ্রহী হবেন, তেমন নয়। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যকলাপ নিয়ে কিছু কিছু সমালোচনা আছে। যেগুলোর সত্যতা আছে এবং সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু ঢালাওভাবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নিয়ে মন্তব্য করা সমীচীন নয়। (প্রথম আলো, ৩০ মার্চ ২০২২)

আমরাও মনে করি, ঢালাওভাবে কারও সম্পর্কে মন্তব্য করা ঠিক নয়। তবে মন্ত্রীরা যখন গণমাধ্যম সম্পর্কে ঢালাও মন্তব্য করেন, তখন তঁারা এ কথা মনে রাখেন না। সরকারের মন্ত্রী, সরকারি দলের নেতা-সাংসদ কেউ অপ্রিয় সত্য কথা শুনতে চান না। কেবল প্রশংসা শুনতে চান। সরকার ও প্রশাসনের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রশংসার জোয়ারে ভাসছে।

শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে আলোচনার আগে আমরা বিরোধী দলের সাংসদদের কথা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারি। জাতীয় পার্টির সাংসদ মুজিবুল হক, যিনি আবার দলের মহাসচিবও, বলেছেন, আগে উপাচার্যদের কথা শুনলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসত। এখন তাঁদের দুর্নীতির খবর শুনে লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। তাঁরা পরিবারের সদস্যদের নিয়োগ দিচ্ছেন, দুর্নীতি করছেন। তিনি দলীয় বিবেচনার বাইরে গিয়ে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানান।

বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদের ভাষ্য ছিল, একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা কী। উপাচার্যরা বিদায় নিচ্ছেন, পুলিশ প্রহরায় তাঁদের ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে হচ্ছে। সম্প্রতি রুয়েটের উপাচার্যকে নিয়ে কলঙ্কজনক তথ্য এসেছে।

আমরা স্মরণ করতে পারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, আবদুল হালিম চৌধুরী, শামসুল হক প্রমুখ, যাঁরা কখনো সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে কাজ করেননি, করেছেন শিক্ষার্থীদের কল্যাণে। কখনো কখনো জাতির বিবেকের দায়িত্বও পালন করেছেন এই শিক্ষাবিদেরা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যখন পাকিস্তানিরা গণহত্যা চালায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবু সাঈদ চৌধুরী সেমিনারে অংশ নিতে ইউরোপের কোনো দেশে ছিলেন। সেখান থেকে গণহত্যার খবর পেয়ে আর দেশে ফেরেননি। মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ উপাচার্য সরকারের কর্তাব্যক্তিদের তোয়াজ করতেই ব্যস্ত থাকেন। সরকারও সে রকম শিক্ষাবিদই চায়, যাঁরা ‘জি হুজুর’ করতে এবং সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনটির অন্যায় আবদার মেনে নিতে অভ্যস্ত। অনেক উপাচার্যকে দেখেছি বিরোধী ছাত্রসংগঠনের আন্দোলন মোকাবিলা করতে সরকারি ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার করেছেন। সরকারি ছাত্রসংগঠনও তাদের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবহার করবে, এটাই স্বাভাবিক।

কেবল উপাচার্যদের কথা বলি কেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক আবু মাহমুদ মোনেম খান সরকারের চণ্ডনীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে এনএসএফের গুন্ডা বাহিনীর হাতে প্রহৃত হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শামসুজ্জোহা ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন। আবুল ফজল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে।

আর এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ উপাচার্য সরকারের কর্তাব্যক্তিদের তোয়াজ করতেই ব্যস্ত থাকেন। সরকারও সে রকম শিক্ষাবিদই চায়, যাঁরা ‘জি হুজুর’ করতে এবং সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনটির অন্যায় আবদার মেনে নিতে অভ্যস্ত। অনেক উপাচার্যকে দেখেছি বিরোধী ছাত্রসংগঠনের আন্দোলন মোকাবিলা করতে সরকারি ছাত্রসংগঠনকে ব্যবহার করেছেন। সরকারি ছাত্রসংগঠনও তাদের স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবহার করবে, এটাই স্বাভাবিক। ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা ও ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হাতে কতবার নিগৃহীত হয়েছেন, তার হিসাব নেই। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিএনপির আমলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের এবং আওয়ামী লীগের আমলে ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ক্যাম্পাসে আসা নিষিদ্ধ থাকাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অলিখিত নিয়ম হিসেবে মেনে নিয়েছে।

গত ১৩ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে অনেক উপাচার্যকে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের অভিযোগ মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করতে কিংবা ক্যাম্পাস ছাড়তে হয়েছে। কোনো কোনো উপাচার্য রাতের অন্ধকারে পুলিশের পাহারায় ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক উপাচার্য যুবলীগের নেতৃত্ব নেওয়ার বাসনা ব্যক্ত করেছিলেন। তাঁর সময়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের মাস্তানদের হাতে শিক্ষক ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বহুবার লাঞ্ছিত হলেও তিনি ব্যবস্থা নেননি। সম্প্রতি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি হলের প্রাধ্যক্ষের অপসারণের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন ঠেকাতে উপাচার্য ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা সরকারের আশ্বাসে অনশন ভাঙলেও আশ্বাসটি কী ছিল, তা এখনো জানা যায়নি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক সাবেক উপাচার্য বিদায়ের আগমুহূর্তে ৪১ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়ে গেছেন, যাঁদের মধ্যে ছাত্রলীগের ‘ত্যাগী’ নেতা-কর্মীও আছেন। ছাত্রলীগ যে তাঁকে ক্যাম্পাসে বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেছে, এটি ছিল তার প্রতিদান। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক উপাচার্য চার বছরে মাত্র ২৩৭ দিন ক্যাম্পাসে গেছেন। অথচ উপাচার্য পদটি সার্বক্ষণিক।

কয়েক দিন ধরে শিক্ষামন্ত্রীর কথাটি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাহলে কি সত্যিই পরিস্থিতি বদলে গেছে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ফিরে এসেছে, যেখানে একজন বরেণ্য শিক্ষাবিদ উপাচার্য পদ নিতে দ্বিধা করবেন না। কিন্তু গতকালই পত্রিকায় এ প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলাম।

কুমিল্লা থেকে সহকর্মী গাজীউল হকের পাঠানো খবরে বলা হয়: চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম আবদুল মঈন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন। এরপর তাঁর কাছে নেতাদের চাকরি ও বিভিন্ন হলের উন্নয়নমূলক কাজের ঠিকাদারি দেওয়ার দাবি তোলেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতারা। বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. ইলিয়াস মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল ইসলামের নেতৃত্বে সংগঠনের কয়েকজন নেতা উপাচার্যের দপ্তরে যান। তাঁরা সংগঠনের নেতাদের চাকরি দেওয়ার জন্য উপাচার্যকে আবারও চাপ দেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন হলে পানির পাম্প বসানো এবং তোরণ নির্মাণের ঠিকাদারি তাঁদের দেওয়ার দাবি জানান। উপাচার্য ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অন্যায় আবদার মেনে না নেওয়ায় তাঁরা উপাচার্যের কক্ষ থেকে বেরিয়ে গিয়ে প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে জড়ো হন এবং তাঁর গাড়ি আটকে দেন (প্রথম আলো, ১ এপ্রিল ২০২২)।

এ ঘটনার পর নিশ্চয়ই শিক্ষামন্ত্রী জেনে গেছেন কেন বরেণ্য শিক্ষাবিদেরা উপাচার্য হতে চান না। যেসব শিক্ষাবিদের ন্যূনতম মর্যাদাবোধ আছে, তাঁরা উপাচার্য হয়ে ছাত্রলীগের চোখ রাঙানি খাবেন না কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দ পেতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বারান্দায় ধরনা দেবেন না।

প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রই অভিন্ন। যেখানে উপাচার্যরা বিনা বাধায় ছাত্রলীগের নেতাদের দাবি মেনে নেন, সেখানে খবরও হয় না। সরকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে বরেণ্য শিক্ষাবিদ আশা করবে আর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁদের কাছে গিয়ে ঠিকাদারি কাজের বখরা চাইবেন, তা হতে পারে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যের খুঁটির জোর ছিল বলে তিনি বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ মহলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু যাঁদের খুঁটির জোর নেই, তাঁরা মুখ বুজেই সহ্য করে যাচ্ছেন।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com