সরকার কি রংপুরের সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ভুলেই গেছে

উন্নয়নবৈষম্যের তলানিতে পড়ে আছে রংপুর বিভাগ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও আছে সেই বৈষম্য। সারা দেশের সব বিভাগীয় সদর জেলায় ন্যূনতম দুটি করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। রংপুর বিভাগীয় সদরে একটি। আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পাস হয়েছে ২১ বছর আগে। আজ পর্যন্ত সেই বিশ্ববিদ্যালয় আলোর মুখ দেখেনি। দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১০৮টি। এর মধ্যে মাত্র একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে রংপুর বিভাগে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি ছিল। ২০০৮ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। ২০০১ সালের ৩৪ নম্বর আইনে ‘রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে। আইনে জারিকৃত বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিত্তিপ্রস্তরও দেওয়া হয়েছিল। ২১ বছর আগে ভিত্তিপ্রস্তর দেওয়া ‘রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ নামের প্রতিষ্ঠানটি বাস্তবায়িত হতেও কি ৬১ বছর কিংবা তারও বেশি সময় প্রয়োজন হবে?

১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসনামলে রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও অনেক আন্দোলন হয়েছিল রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য। এই আন্দোলনে কেউ কেউ মামলা-হামলার শিকার হয়ে জেলও খেটেছেন। ১৯৯৬ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেছিলেন। সেই মেয়াদে থাকাকালে তিনি ২০০১ সালে রংপুরে ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। শুধু তা–ই নয়, সংসদ থেকে একটি আইনও প্রণয়ন করেছিল সেই সময়েই। জমি অধিগ্রহণ, প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ আর সংসদ থেকে পাসকৃত আইন থাকলেও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে রংপুরবাসী রংপুরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঞ্চিত হন।

২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট জয়ী হয়। এই সরকার শেখ হাসিনার ভিত্তি দেওয়া প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। একটি ভিত্তিপ্রস্তর দীর্ঘদিন সাক্ষী হয়ে ছিল। যে স্থানে এ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হওয়ার কথা ছিল, সে স্থানেই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য এখন নতুন করে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করেও জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব।

রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য এ অঞ্চলের মানুষেরই এগিয়ে আসতে হবে। উন্নয়ন-বৈষম্যের তলানিতে পড়ে থাকা রংপুরের উন্নয়নের কথা তো নীতিনির্ধারকেরা ভাবার প্রয়োজন মনে করেন না। সারা দেশে যত মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, তার একটিও রংপুর বিভাগে নেই। অথচ উন্নয়নের সব সূচকে পিছিয়ে থাকা রংপুরের জন্য মেগা প্রকল্প জরুরি ছিল

রংপুরে বর্তমানে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আছে, সেটির প্রতিষ্ঠাকালের নাম রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। ২০০৮ সালে রংপুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তুমুল আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সেই আন্দোলনের ফল এই বিশ্ববিদ্যালয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৮ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নামকরণ করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর নামে। ২০০৮ সালের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। সেটি সরকারের ওই মেয়াদে আর হয়নি। তার পরের দুটি নির্বাচনে নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়টি আর গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ২০০৮ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত একটানা আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলেও কী এক অজ্ঞাত কারণে তাদেরই ভিত্তি দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। প্রতিশ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় কবে হবে, কেউ বলতেও পারেন না। অথচ আইন পাসকৃত বিশ্ববিদ্যালয়টি না হওয়ার তেমন কোনো কারণ নেই।

একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পাস হওয়া পর্যন্ত কাজ থাকে সবচেয়ে বেশি। কার্যত এর পরের কাজগুলো খুবই সহজ। স্থান নির্বাচন করা নিয়েও কালক্ষেপণের প্রয়োজন নেই। অস্থায়ীভাবে কোনো ভবনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হতে পারে। এর জন্য সদিচ্ছা থাকা জরুরি। অর্থ বরাদ্দ দিয়ে একজন উপাচার্য নিয়োগ করলেই এর কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব। উপাচার্যই আইন ও প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বাকি কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারবেন।

প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা দেশের সব জেলায় একটি করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করলেই শুধু হবে না, এর জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা আর মান উন্নত করা চাই। দেশে এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা অর্ধশত। জনসংখ্যা আর বিভাগভিত্তিক বিষয়টি বিবেচনা করলে রংপুরের দুই কোটি মানুষের জন্য অন্তত ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় থাকা প্রয়োজন। আছে তিনটি। ঠাকুরগাঁওয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই মর্মে ঘোষণার পরপরই দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে লিখিত নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। কুড়িগ্রামে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষণা হয়েছে প্রায় ছয়-সাত বছর হলো। তারও কাজ শম্বুকগতিতে এগোচ্ছে। এখনো প্রকল্প পরিচালক কিংবা উপাচার্য নিয়োগ হয়নি। কুড়িগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়ার পর অন্তত ১০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হওয়ার পর অন্তত ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবু এ বিশ্ববিদ্যালয় এখনো কাগজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

সরকার কি রংপুর বিভাগের সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা ভুলেই গেছে? ভুলে যাওয়ার অভিনয় করে যেতে পারে দেশের নীতি–নির্ধারণীতে থাকা অন্যান্য অঞ্চলের মানুষ। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রংপুরকে বিভাগ হিসেবে উল্লেখ করাই হয়নি। রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য এ অঞ্চলের মানুষেরই এগিয়ে আসতে হবে। উন্নয়নবৈষম্যের তলানিতে পড়ে থাকা রংপুরের উন্নয়নের কথা তো নীতিনির্ধারকেরা ভাবার প্রয়োজন মনে করেন না। সারা দেশে যত মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, তার একটিও রংপুর বিভাগে নেই। অথচ উন্নয়নের সব সূচকে পিছিয়ে থাকা রংপুরের জন্য মেগা প্রকল্প জরুরি ছিল।

সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি রংপুরে একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলেছেন। ফলে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে জনমনে। চারদলীয় জোট সরকার যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ করেছে ২১ বছর আগে, ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকেও আওয়ামী লীগের সে কাজ না করাটা দুঃখজনক। আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিষয়টি উত্থাপন করলে এ বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন খুব দ্রুতই হবে। রংপুরের উন্নয়নের দায়িত্ব শেখ হাসিনা গ্রহণ করেছেন মর্মে একটি জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন। রংপুর বিভাগের সাংসদেরা সোচ্চার হলেও কাজটি ত্বরান্বিত হতে পারে। রংপুরের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে রংপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা বৃহৎ স্বার্থেই প্রয়োজন।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক

wadudtuhin@gmail.com