অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ৩ জুন জাতীয় সংসদে ৬ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন। প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে কয়েক দিন সরগরম আলোচনার পর অধিবেশন ২৮ জুন পর্যন্ত মুলতবি হয়ে গেছে। ৩০ জুন বাজেট পাস হবে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বাজেট ব্যবসাবান্ধব। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ধনীবান্ধব। অনেকে ঠাট্টা করে বলেন, ব্যবসায়ীদের দ্বারা, ব্যবসায়ীদের জন্য এবং ব্যবসায়ীদের স্বার্থে এই বাজেট করা হয়েছে।
বাজেটে যে বিষয়টি উপেক্ষিত রয়ে গেছে তা হলো বেকার ও নতুন গরিব হওয়া জনগোষ্ঠী। করোনাকালে বিরাটসংখ্যক নিম্নমধ্যবিত্ত তথা স্বল্প আয়ের মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। অন্যদিকে বেকারত্ব সব সময়ই ছিল। দেড় বছর ধরে সরকারি ও বেসরকারি খাতে নিয়োগপ্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ থাকায় সেটি আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। করোনাকালে দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছে তৈরি পোশাক খাত, কৃষক ও প্রবাসী শ্রমিকেরা। এর মধ্যে কৃষিতে করোনার অভিঘাত তেমন পড়েনি। বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় সত্ত্বেও এবার ধানের উৎপাদন বেড়েছে। কৃষক ভালো দামও পেয়েছেন। কিন্তু তৈরি পোশাক খাতের কয়েক লাখ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। প্রবাসী শ্রমিকদেরও একাংশ কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। এ দুটি খাতের বাইরে যে বিশাল অনানুষ্ঠানিক খাত, সেখানে লাখ লাখ কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। তাঁরা যে মজুরি পেতেন, তা দিয়ে কোনোভাবে পরিবার চলত। এখন তারা নিঃস্ব। তাঁরা নতুন গরিব। অর্থনীতিবিদদের মতে, এই সংখ্যা আড়াই কোটির মতো।
দেশের ভেতরে ন্যূনতম কিছু করার থাকলে তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে যেতেন না। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা চাকরি না করে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু কিছু করার উদ্যোগ নেওয়ার পরিবেশ দেশে কতটা আছে। উদ্যোগ নিলেই দলীয় পরিচয়ে মাস্তানরা চাঁদা দাবি করে। যেখানে নিজের জমিতে বাড়ি করতেও মাস্তানদের চাঁদা দিতে হয়, সেখানে উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ কতটা আছে
বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীভুক্ত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) এক সমীক্ষা বলছে, কোভিড-১৯-এর কারণে দেশের অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে (এমএসএমই) কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২০ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। প্রায় দুই কোটি নারী-পুরুষ এ খাতে কাজ করেন।
আইএলওর গবেষণার তথ্য হলো করোনা মহামারির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে তরুণ প্রজন্ম। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশই বেকার হয়েছেন। তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ।
অর্থমন্ত্রীর ব্যবসাবান্ধব বাজেটে এ বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ নেই। অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য যেমন বলেছেন, অর্থমন্ত্রী বাসে যাত্রী তুলতে ভুলে গেছেন। যাত্রী হলেন এই বেকার ও নতুন গরিব হওয়া মানুষ। আরেকটি শ্রেণির মানুষ আছেন, যাঁরা ঠিক হঠাৎ গরিব হওয়া নয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ থেকে পাস করে বসে আছেন চাকরির আশায়। তাঁরা জানেন, বাংলাদেশে চাকরি মানে সোনার হরিণ। পাবলিক সার্ভিস কমিশনে প্রতিবছর ক্যাডার, নন-ক্যাডার মিলে চার হাজারের মতো লোকের চাকরি হয়। পরীক্ষা দেন দুই লাখের বেশি। প্রতি পদের জন্য গড়ে ৫০ জন। অন্যান্য চাকরিতে প্রতিযোগিতাটি আরও বেশি।
সম্প্রতি প্রথম আলোর কূটনৈতিক প্রতিবেদক রাহীদ এজাজ লিবিয়ায় পাচার হওয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছেন, যাতে সমুদ্র থেকে উদ্ধার হওয়া তরুণদের মর্মান্তিক জীবনকাহিনি উঠে এসেছে। গত ১৮ মে ভূমধ্যসাগরে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড একটি কাঠের নৌকা থেকে ৩৫ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করে। তাঁদের সাময়িক ঠাঁই হয়েছে তিউনিসিয়ার জার্জিস শহরে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আশ্রয়কেন্দ্রে। উদ্ধার হওয়া তরুণদের একজন আল আমিন লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার বিপজ্জনক যাত্রায় নিজের চাচাকে সমুদ্রে তলিয়ে যেতে দেখেছেন। নিজেও কোনোরকমে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছেন। তবু তিনি দেশে ফিরতে চান না। কেননা, ইতালি যাওয়ার টাকা জোগাড় করতে অনেক ঋণ করেছেন। দেশে ফিরলে ঋণ শোধ করতে পারবেন না। তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড ২২ দিনে ৪৪৩ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছে। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাংলাদেশ থেকে গেছেন ২ হাজার ৬০৮ জন।
সরকারের সদুপদেশ নানা মহলের সতর্কবাণী সত্ত্বেও হাজার হাজার তরুণ বিদেশে চাকরির জন্য গিয়ে সমুদ্রে ডুবে যান, মরুভূমি ও গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যান, তারও পেছনে আছে অসহনীয় বেকারত্ব।
দেশের ভেতরে ন্যূনতম কিছু করার থাকলে তাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে যেতেন না। সরকারের নীতিনির্ধারকেরা চাকরি না করে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু কিছু করার উদ্যোগ নেওয়ার পরিবেশ দেশে কতটা আছে। উদ্যোগ নিলেই দলীয় পরিচয়ে মাস্তানরা চাঁদা দাবি করে। যেখানে নিজের জমিতে বাড়ি করতেও মাস্তানদের চাঁদা দিতে হয়, সেখানে উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ কতটা আছে?
শুধু কি লিবিয়ার উপকূলে? ইতালি, গ্রিক, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই, সিঙ্গাপুর, লেবানন, মালদ্বীপ, সৌদি আরব, ইরাক, জর্ডান—যেখানে সামান্য কাজের সুযোগ আছে, সেখানে বাংলাদেশি নারী ও পুরুষ জমিজমা বিক্রি করে পাড়ি জমান। কেউ কেউ টিকে যান। আবার দালালদের খপ্পরে পড়ে অনেকে দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরে আসেন।
কয়েক দিন আগে এক নির্যাতিত নারী ফিরে এসেছেন সৌদি আরবে জেল খেটে। এর আগে সেখানে তিনি সৌদি গৃহকর্তার দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হন এবং কারাগারে সন্তানের জন্ম দেন। সাত মাসের সন্তানকে এই নারী বিমানবন্দরেই এক কর্মচারীর কাছে তুলে দিয়ে বলেন, ‘আমি এই সন্তান নিয়ে বাড়ি যেতে পারব না।’ এ রকম কত নারী বিদেশে গিয়ে অসম্মানিত হন, নির্যাতনের শিকার হন, সেই খবর উন্নয়নের রোল মডেল হওয়া রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা রাখেন না। বরং বছর শেষে প্রবাসী আয়ের স্ফীত খতিয়ান নিয়ে বসেন।
অর্থমন্ত্রীর বাজেটে এ বিপন্ন মানুষগুলোর জন্য কোনো বরাদ্দ বা দেশে তাঁদের কর্মসংস্থানের কোনো রূপরেখা থাকলে আমরা খুশি হতাম। প্রতিবছর দেশে ২১-২২ লাখ মানুষ কর্মবাজারে যোগ হচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি খাতে খুব বেশি হলে ৭ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। আরও কয়েক লাখ বিদেশে কাজের সুযোগ পান। অর্থাৎ কর্মক্ষম জনশক্তির অর্ধেকই বেকার বা ছদ্ম বেকার। অনেকে এমন কাজ করেন বা করতে বাধ্য হন, যা দিয়ে সংসার চলে না।
করোনাকালে সরকারি-বেসরকারি দপ্তরে নিয়োগ প্রায় বন্ধ। বিদেশে চাকরির বাজার সংকুচিত। দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ (উচ্চশিক্ষার প্রায় ৭০ শতাংশ জোগান দেয় এই বিশ্ববিদ্যালয়) বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হতে পারেনি করোনার কারণে। ফলে তারা দেড়-দুই বছর পিছিয়ে গেছে। শিগগিরই করোনা পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষণ দেখছি না।
এ অবস্থায় সরকারকে চাকরির বয়সসীমা নিয়ে নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। ২০২০ সালের শুরুতে যাঁদের বয়স ছিল ৩০ বছর, সরকারি নিয়মানুযায়ী সেটাই ছিল চাকরির দরখাস্ত করার শেষ সময়। এখন আর তাঁরা দরখাস্ত করতে পারছেন না। ইতিমধ্যে পাবলিক সার্ভিস কমিশনে তিনটি ব্যাচের পরীক্ষা আটকে গেছে। কারও যোগ্যতা থাকলে চাকরি হবে, না থাকলে হবে না। কিন্তু করোনার কারণে যাঁদের জীবন থেকে দেড়-দুই বছর অপচয় হলো, তাঁদের চাকরির পরীক্ষায় বসার সুযোগটি তো দিতে হবে।
এই প্রেক্ষাপটে চাকরিপ্রত্যাশী তরুণেরা যে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর দাবি করেছেন, তা যৌক্তিক বলে মনে করি। তাঁরা এ দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করছেন। মন্ত্রী-সাংসদ-আমলাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। মন্ত্রী-সাংসদেরা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দেন। বয়সসীমা না বাড়ানোর দাবি নিয়ে কেউ গেলে তাঁকে আশ্বাস দেন। বিপক্ষে গেলে তাঁকেও বিমুখ করেন না। রাজনীতিকদের নাকি সবাইকে খুশি রাখতে হয়।
তবে এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত একজন ভিন্ন এক অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন। বিষয়টি নিয়ে তরুণেরা শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন আমলার কাছে গেলে তাঁরা নীতিগতভাবে একাত্মতা ঘোষণা করেন। সেই সঙ্গে এ–ও বলেছেন, ‘আমরা তোমাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়াতে পারি, যদি তোমরা অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর দাবি সামনে নিয়ে আসো।’
চাকরিপ্রত্যাশী তরুণদের সঙ্গে মশকরাই বটে।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com