বিশেষ সাক্ষাৎকার

সরকার এখন ঋণখেলাপিবান্ধব

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ
>

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর। এ ছাড়া তিনি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং সোনালী, অগ্রণী ও পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যাংকিং খাত ও অর্থনীতির চালচিত্র নিয়ে তিনি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান 

প্রথম আলো: সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের জন্য কিছু সুবিধা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। প্রথমে তিনি বলেছিলেন ঋণখেলাপিরা ঋণ শোধ না করলে ৭ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। পরে অবশ্য সেই অবস্থান থেকে সরে এসে ৯ শতাংশ বলেছেন। কিন্তু যাঁরা সময়মতো ঋণ শোধ দিয়েছেন, তাঁদের তো এর চেয়ে বেশি হারে সুদ দিতে হয়েছে।

 খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: প্রথমত, মন্ত্রী মহোদয়ের এই বক্তব্য সরকারকে ঋণখেলাপিবান্ধব হিসেবে পরিচিতি দেবে। খেলাপিবান্ধব হিসেবে পরিচয়ের বিপদ হলো, এত দিন ব্যাংক চলত ‘ব্যাংকার-গ্রাহক’ সম্পর্কের নিরিখে। সম্পর্কের নিরিখে ব্যাংকই সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণ করে ঠিক করে, কারা মন্দ গ্রাহক আর কারা ভালো গ্রাহক। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ভালো ও মন্দ গ্রাহক বিচার করা হবে অডিটর দ্বারা নিরীক্ষণের মাধ্যমে। অর্থাৎ চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টরা এটি ঠিক করবেন। আমরা যতটা জানি, নিরীক্ষকের কাজ হলো কাগজপত্র দেখা ও ভুল তুলে ধরা। এর বাইরে তাঁরা ভালো-মন্দ বিচার করতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে নিরীক্ষকের অনুপ্রবেশের ফলে ব্যাংক ও গ্রাহকের সম্পর্কটি আর থাকল না।

প্রথম আলো: আপনি কি মনে করেন কোনো বিশেষ মহলকে সুবিধা দেওয়ার জন্য সরকার এই পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে?

ইব্রাহিম খালেদ: অনেকে এমনটি মনে করেন। বছর চারেক আগে যখন ড. আতিউর রহমান গভর্নর ছিলেন, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে খেলাপি ঋণ রিস্ট্রাকচারিং বা পুনর্গঠন করা হলো। এটি আইনের খেলাপ না হলেও আইনের মধ্যে পড়ে না। আগে যাঁরা ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছেন, তাঁরাই বৃহৎ ঋণগ্রহীতা হিসেবে বিবেচিত হতেন। প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার পুনঃ তফসিল করেও যাঁরা ঋণ শোধ করতে পারেননি, তাঁদের জন্য এই বিশেষ সুবিধা করে দেওয়া হয়েছিল। এটি ছিল ১৫ বছরের জন্য। আসলে ১১ জন শীর্ষ ঋণখেলাপিকে সুবিধা করে দেওয়ার জন্য এটি হয়েছিল। কিন্তু এঁদের মধ্যে মাত্র দুজন কিছু টাকা শোধ করেছিলেন। আর কেউ করেননি। কেননা, তাঁরা হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। ফলে সরকার এই শক্তিশালী গ্রুপের কারও কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁরা কেউ জীবদ্দশায় ঋণ শোধ করবেন বলে মনে হয় না।

প্রথম আলো: যাঁরা নিয়মিত ঋণ শোধ করেছেন, তাঁদের প্রতি অবিচার করা হলো কি না?

ইব্রাহিম খালেদ: তাঁদের প্রতি শুধু অবিচার নয়, অত্যাচার করা হলো। এ ধরনের উদ্যোগে ব্যাংকাররা শঙ্কিত। প্রকাশ্যে না বললেও ব্যক্তিগত আলাপে অনেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, এর মাধ্যমে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কটি শেষ হয়ে যাবে। ঋণখেলাপিরা সরকারের কাছ থেকে একের পর এক সুবিধা আদায় করলে তো তাঁরা ব্যাংকারদের পাত্তা দেবেন না। ভালো-মন্দ ঋণগ্রহীতা বিচারের ক্ষেত্রে ব্যাংকের হাতে অনেক অস্ত্র আছে। তিন-তিনবার পুনঃ তফসিল করেও যাঁরা ঋণ শোধ করতে পারবেন না, তাঁদের ভালো বলার সুযোগ নেই। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর ঘোষণায় মনে হবে, বৃহৎ ও দীর্ঘকালের স্বভাবজাত ঋণখেলাপিদের পুরস্কৃত করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলেই কাউকে ঋণখেলাপি হিসেবে ঘোষণা করতে পারে না। ব্যাসেল (Basel) চুক্তি অনুযায়ী আন্তর্জাতিকভাবে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে, যা সব দেশই মেনে থাকে। সরকার যে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, সেটি ব্যাসেল বিধির ব্যত্যয় বলে মনে করি। প্রস্তাবিত ছাড়ের কারণে ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রতিফলিত হবে না। ফলে প্রভিশন সংরক্ষণ, মূলধন হিসাবায়ন—এসব কিছুই প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং বিদেশে ব্যাংকের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। বাংলাদেশ এত দিন ব্যাসেল-৩ (Basel–III) বিধিমালা অনুযায়ী চলছিল, যা অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা বাস্তবায়নের ফলে লঙ্ঘিত হবে।

প্রথম আলো: বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতকে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে দুর্বল খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আপনার মন্তব্য কী?

ইব্রাহিম খালেদ: শুধু বিশ্বব্যাংক নয়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রতিবেদনেও একই রকম বিপদের কথা বলা হয়েছে। দুটি সংস্থাই জরুরি ভিত্তিতে খেলাপি ঋণ কমানোর কথা বলেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ব্যাংক খাতে বিপর্যয় ঘটবে। অর্থমন্ত্রী যে প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন, তাতে প্রকৃত খেলাপি ঋণ কমবে না। বরং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হবে। এটি ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

প্রথম আলো: অর্থমন্ত্রী বলেছেন, প্রক্রিয়াটি আগের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের আমলেই শুরু হয়েছে। সে সময়ে কমিটি গঠন করা হয়েছিল।

ইব্রাহিম খালেদ: আমি খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছি, সাবেক অর্থমন্ত্রীর আমলে একটি কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যদি কমিটি হয়েও থাকে, প্রস্তাবিত ফর্মুলায় কাজটি হয়েছে নতুন অর্থমন্ত্রীর আমলেই। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংকারদের একটি সভা হয়েছিল। সেই সভায় একজন বড় ব্যবসায়ী, যিনি আদালতের রায় নিয়ে বর্তমানে খেলাপিমুক্ত আছেন, তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা খেলাপি খেলাপি বলে হইচই করছেন। এমন বিধি করে দেব, যাতে কেউ আর খেলাপি থাকবেন না।’

প্রথম আলো: অর্থমন্ত্রী সম্প্রতি সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের শপথ পড়িয়েছেন, তাঁরা কাউকে উৎকোচের বিনিময়ে ঋণ দেবেন না।

ইব্রাহিম খালেদ: আমি ১৯৬৩ সাল থেকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত আছি। কিন্তু কখনো এ ধরনের শপথ নেওয়ার কথা শুনিনি। শপথ নেওয়ার পরিবর্তে ব্যাংকারদের জন্য যে কাজটি জরুরি তা হলো, দায়বদ্ধতা আদায় করা। আইন অনুযায়ী তাঁরা কাজ করবেন। আইনের ব্যত্যয় হলে শাস্তি পাবেন। শপথ পাঠ দায়বদ্ধতার বিকল্প নয়। ব্যাংকগুলো টিকিয়ে রাখতে ব্যাংকারদের আগ্রহ নেই, এ কথা সত্য নয়। খেলাপি ঋণ আদায়ে কোনো কোনো ব্যাংক সাফল্যও দেখিয়েছে। সোনালী ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দেখেছি, বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে অর্থ আদায় করেছেন। সুষ্ঠুভাবে ব্যাংক চালাতে ভালো ব্যবস্থাপকের বিকল্প নেই।

প্রথম আলো: এত দিন আমরা আমলা মন্ত্রী পেয়েছি। চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট অর্থমন্ত্রী পেয়েছি। এবারে একজন ব্যবসায়ী অর্থমন্ত্রী পেলাম। আপনার মন্তব্য কী?

ইব্রাহিম খালেদ: অর্থমন্ত্রী কোন পেশা থেকে এসেছেন, সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। বিবেচ্য বিষয় হলো, তিনি তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব কতটা দক্ষতা ও সততার সঙ্গে পালন করছেন। এখানে সততার সঙ্গে কঠোরতাও প্রয়োজন। সাবেক অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব ব্যক্তিগতভাবে সৎ ও দক্ষ আমলা ছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যাংকিং খাত ঠিকমতো চালাতে পারেননি। আপস করেছেন। আবার শাহ এ এম এস কিবরিয়াও আমলা ছিলেন। তিনি আপস করেননি। বর্তমানে এমন একটি শক্তিশালী ধনিক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, যারা সরকারকে সহজে বশীভূত করতে পারে; তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই।

প্রথম আলো: সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা কী? সরকার প্রতিবছর অর্থের জোগান দিয়ে টিকিয়ে রাখছে।

ইব্রাহিম খালেদ: সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো হলো ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এর মতো। যে কেউ সেখানে পদচারণ করতে পারেন। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ও ৪৭ নম্বর ধারায় আছে, বাংলাদেশ ব্যাংক যদি মনে করে কোনো পরিচালক অন্যায় করেছেন, তাঁকে বাদ দিতে পারে। এমনকি পুরো পর্ষদও বাতিল করে প্রশাসক বসাতে পারে। কিন্তু আইনে সরকারি ব্যাংককে এ ব্যবস্থা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সরকার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন ব্যাংকিং ডিভিশনকে সরকারি ব্যাংক চালানোর দায়িত্ব দিয়েছে। সেখানে যাঁরা আছেন, তাঁদের ব্যাংক চালানোর দক্ষতা এবং জনবল কোনোটাই নেই। আমলারা এই আইন করেছেন, যাতে অবসর নেওয়ার পর সরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালক হলে তাঁদের ওপর খড়্গ না থাকে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্ব খর্ব করা হয়েছে। ব্যাংকিং খাতের এই দ্বৈত শাসনের অবসান হওয়া উচিত।

প্রথম আলো: অনেক অর্থনীতিবিদ বলে থাকেন, পুঁজিবাদ বিকাশের প্রাথমিক স্তরে অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি হয়ে থাকে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।

ইব্রাহিম খালেদ: আমি দ্বিমত করব। সত্য যে যুক্তরাষ্ট্রের মতো পুঁজিবাদী দেশগুলোতে প্রাথমিক পর্যায়ে বিশৃঙ্খলা ছিল। কিন্তু নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক এমনকি জার্মানিতে এটি হয়নি। কেননা, এসব দেশের অর্থনীতির ভিত্তি ছিল কল্যাণমূলক। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শতকরা ৭ থেকে ৮-এ পৌঁছেছে। কিন্তু গিনি সহগের অনুপাত যদি ১ হয়, তাহলে সেই উন্নয়নের সুফল একজন বা দুজন ব্যক্তির হাতে চলে যাবে। যদি সেটি ঊর্ধ্বে দশমিক ৪ হয়, তাহলে বৈষম্য সহনীয় হবে। বাংলাদেশে অনুপাতটা বর্তমানে দশমিক ৫-এর কাছাকাছি আছে। এতৎঞ্চলে আমাদের দেশেই বৈষম্য বেশি। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ একটি গবেষণায় দেখিয়েছে, প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে যে সম্পদ অর্জিত হচ্ছে, সেটি মাত্র ৫ শতাংশ মানুষের কাছে পুঞ্জীভূত হচ্ছে। অর্থাৎ ৯৫ শতাংশ মানুষ তেমন সুফল পাচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছিল ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করে। বঙ্গবন্ধু শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার কথাই বলতেন। এ ব্যাপারে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাও রয়েছে।

প্রথম আলো: প্রবৃদ্ধির হার বাড়লেও সেই তুলনায় বিনিয়োগ তো বাড়ছে না।

ইব্রাহিম খালেদ: প্রাথমিক কারণ ছিল বিদ্যুতের ঘাটতি। গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ সমস্যা অনেকটা কেটে গেছে। আমার মনে হয়, ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার অভাব আছে। বিনিয়োগ করলে তিনি সেটি তুলে নিতে পারবেন, অনেকে সেটি মনে করেন না। অনেক ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের ব্যাংকের টাকার প্রয়োজন নেই; শুধু অনুকূল পরিবেশ দরকার। খেলাপি ঋণের কারণে ঋণের সুদের হারও বেশি।

প্রথম আলো: ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগের ও পরের পরিবেশে কি কোনো পার্থক্য লক্ষ করেন?

ইব্রাহিম খালেদ: নির্বাচনের বছরখানেক আগে থেকে ব্যবসায়ীদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। তাঁরা রাজনৈতিক অস্থিরতার আশঙ্কা করেছিলেন। নির্বাচনের পরও সেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটেনি। বিনিয়োগের বিষয়ে সরকার যে সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, সেটি গুটিকয়েক ব্যক্তি পাচ্ছেন। বড় ব্যবসায়ীরা পাচ্ছেন। বিনিয়োগ বাড়াতে হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদেরও প্রণোদনা দিতে হবে। ÿক্ষুদ্র ও মাঝারিদের উন্নয়ন ছাড়া আয়বৈষম্য হ্রাস করার কোনো পথ নেই।

প্রথম আলো: নির্বাচনের আগে ব্যাংকাররা করপোরেট ট্যাক্স কমিয়ে নিলেন। এর আগে পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ ও সংখ্যা বাড়িয়ে নিলেন।

ইব্রাহিম খালেদ: এটি ব্যাংকে পরিবারতন্ত্রের মতো শোনা যায়। কিছু কিছু ব্যাংকের মালিক সরকারের ঘনিষ্ঠজন হয়ে উঠলেন। তাঁরা নানাভাবে সুবিধা আদায় করলেন। করপোরেট ট্যাক্স কমানো হলো। ব্যাংকের ওপর পারিবারিক কর্তৃত্ব সুদৃঢ় হলো। বঙ্গবন্ধু হলে করতে দিতেন না। তিনি ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন।

প্রথম আলো: খেলাপি ঋণ আদায়ে অনেক কথা বললেন, আপনি তো কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন পারলেন না কেন?

ইব্রাহিম খালেদ: কৃষি ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে পার্থক্য আছে। কৃষকেরা অতিদরিদ্র শ্রেণির ঋণগ্রহীতা। প্রাকৃতিক বা পারিবারিক দুর্যোগে তাঁরা খেলাপি হয়ে পড়েন। তা ছাড়া, স্বল্পসুদে কৃষিঋণ দিতে হয় বলে ব্যাংক লোকসানে চলে। এসব ব্যাংকের জন্য সরকারের নীতিমালার পরিবর্তন করা প্রয়োজন।

প্রথম আলো: ব্যাংকিং খাত তদারকির দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কিন্তু সেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে।

ইব্রাহিম খালেদ: এটি ভয়ংকর। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দুর্বল করা হলে জনগণ যে ব্যাংকে অর্থ সঞ্চয় করবে, সেটি ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে না। পৃথিবীর কোথাও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তৃত্ব খর্ব করা হয় না। ভারতে মোদি সরকার রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া থেকে রিজার্ভের কিছু অর্থ অন্য খাতে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। এর প্রতিবাদে গভর্নর পদত্যাগ করলেন। পরে সরকার তার অবস্থান থেকে সরে আসে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে এ রকম নজির আছে? কেউ পদত্যাগ করেছেন?

ইব্রাহিম খালেদ: বাংলাদেশে কেউ প্রতিবাদী হয়ে পদত্যাগ করেননি। তবে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। লুৎফর রহমান সরকার যখন গভর্নর ছিলেন, তখন ঋণখেলাপিরা তাঁকে ভয় করতেন।

প্রথম আলো: আপনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলেছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই তো বড় অঙ্কের রিজার্ভ চুরি হলো।

ইব্রাহিম খালেদ: কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যে রিজার্ভ চুরি হলো, তার কিছু অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। বাকিটাও আনা যাবে আশা করি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরি হয়েছে—এই ব্যর্থতা স্বীকার করেও বলব, রিজার্ভ চুরির চেয়েও ভয়ংকর হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্তৃত্ব চুরি। এটি উদ্ধার না হলে ব্যাংকিং ব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে।

প্রথম আলো: নতুন অর্থমন্ত্রী নতুন বাজেট দিতে যাচ্ছেন। বাজেটে কী প্রত্যাশা করছেন?

ইব্রাহিম খালেদ: নানাজনের নানা রকম প্রত্যাশা থাকে। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা নিশ্চয়ই কারও কারও প্রত্যাশা পূরণ করবে। কিন্তু বৃহত্তর জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। বৃহত্তর জনগণের প্রত্যাশা হলো অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য আছে, সেটি কমিয়ে আনা। সমাজের নিচের তলায় যাঁরা আছেন, তাঁরাও যাতে উন্নয়নের সুফল পেতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কিছুটা ভরসা রাখতে পারি এ কারণে যে তিনি দরিদ্র মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে কিছু করতে চান। সামাজিক নিরাপত্তাবলয় বাড়াতে আগ্রহী। নিরাপত্তাবলয়ে সহায়তা দুর্বলতম মানুষদের ক্ষুধা নিবৃত্ত করে। কিন্তু বেশিসংখ্যক মানুষের কাছে অর্থনীতির সুফল পৌঁছাতে হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের সহায়তা বাড়াতে হবে। কৃষিকে যেমন ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, তেমনি ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদেরও সহায়তা দিতে হবে। আবার বড় শিল্পের লিংকেজ হিসেবেও ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে উঠতে পারে। যেমন জাপানে আছে। টয়োটা শিল্প ঘিরে নানা ধরনের ছোটখাটো কারখানা গড়ে উঠেছে। আমাদের এখানেও তৈরি পোশাকশিল্পকে কেন্দ্র করে কিছু ছোট শিল্প ব্যবসা আছে। ছোট উদ্যোক্তাদের সুবিধা ও ভর্তুকি দিলে তার সুফল বেশিসংখ্যক মানুষ পাবে। এ প্রক্রিয়াতে আয়বৈষম্য হ্রাস পাবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

ইব্রাহিম খালেদ: ধন্যবাদ।