একটি চিঠি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি সে সময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন। এই চিঠির একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে। চিঠিতে আতিউর রহমান লিখেছিলেন, ‘২/১টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক অন্যান্য বেসরকারি ব্যাংকের মন্দ ঋণ ক্রয়ের মতো অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসায় অবতীর্ণ হচ্ছে। এসব ঋণ হিসাব বর্তমানে পুনঃ তফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত দেখানো হলেও অদূর ভবিয্যতে মন্দ ঋণ হিসেবে শ্রেণিকৃত হয়ে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রবৃদ্ধি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ডিউ ডিলিজেন্স ব্যতিরেকে খুব দ্রুতগতিতে ঋণ মঞ্জুর ও অবমুক্তকরণ হচ্ছে। ঋণ-আমানত অনুপাত ও শ্রেণিকৃত ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, খেলাপি ঋণ আদায় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় খুব কম। শীর্ষ ২০ ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে আদায়ের পরিমাণ অতি নগণ্য।’
চিঠিতে আরও লিখেছিলেন, ‘সুশাসনের অভাবও প্রকট। ব্যাংকের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড যথা ঋণ অনুমোদন কার্যক্রম, বদলি, পদোন্নতি, ইত্যাদিতে পর্ষদের সরাসরি হস্তক্ষেপ ও প্রভাব বিস্তারের ঘটনা আমাদের গোচরীভূত হয়েছে।’ তৎকালীন গভর্নর সে সময়ের সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের পরিবর্তন, পরিচালনা পর্ষদে পেশাগত দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিবর্গের নিয়োগ নিশ্চিতকরণসহ ব্যাংকগুলোতে সুশাসন নিশ্চিতকরণ আবশ্যক।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সুপারিশ আমলেই নেননি অর্থমন্ত্রী বা সরকার। সে সময়ে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ছিল মূলত রাজনৈতিক নেতা–কর্মীদের দ্বারা ভরপুর। ২০০৯ সালে ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পরপরই আওয়ামী লীগ সরকার এসব নিয়োগ দিয়েছিল। এর দুই বছরের মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই চিঠি। তখনো কিন্তু সোনালী ব্যাংকের হল–মার্ক কেলেঙ্কারির তথ্য উদ্ঘাটন হয়নি, বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু বহাল তবিয়তে ঋণ দেওয়ার নামে অর্থ লুটপাট করছেন, জনতা ব্যাংকের বিসমিল্লাহ গ্রুপের ব্যবসায়ীরা ঋণের টাকা আত্মসাৎ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি, অ্যাননটেক্সের বাড়তি ঋণ নেওয়া বা ক্রিসেন্ট গ্রুপের কেলেঙ্কারি তো আরও অনেক পরের ঘটনা।
কারা ব্যাংক পরিচালক হবেন
এর পরের প্রায় ১০ বছরে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের পর্ষদের একাধিকবার বদল হয়েছে, করা হয়েছে ছোটখাটো কিছু পরীক্ষা। রাজনীতিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও আমলা—মূলত এই তিন দলের মিশ্রণ এখন পরিচালনা পর্ষদে। যদিও ব্যাংকে পরিচালক কারা হবেন, এ নিয়ে অর্থ মন্ত্রোণালয়ের নিজেরই একটি প্রজ্ঞাপন আছে। ২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে ব্যাংকের পর্ষদে অর্থনীতিবিদ, চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্ট, আর্থিক বাজার, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি, সাবেক ব্যাংকার, আইনজ্ঞ, বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি এবং কমপক্ষে একজন নারী পেশাজীবী নিয়োগের কথা বলা ছিল। নিজের প্রজ্ঞাপন নিজেই মানে না অর্থ মন্ত্রণালয়।
এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের আগের মেয়াদের সময়ে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের নেতৃত্বে গঠন করা ব্যাংক সংস্কার কমিটি ১৯৯৯ সালে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে বলেছিল, ‘পরিচালনা পর্ষদ এমন ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হবে, যারা ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং সামাজিক দায়িত্ববোধসম্পন্ন এবং যাদের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক কর্মকর্তারা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে অনুপ্রেরণা পাবেন।’
আবার ব্যাংক পরিচালকেরা কী করতে পারবেন, আর কী পারবেন না, এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি একটি সার্কুলার জারি করেছিল। সেখানে বলা আছে, ‘পরিচালকেরা ব্যাংকের দৈনন্দিন কাজে হস্তক্ষেপ, ব্যাংকের রুটিন কিংবা প্রশাসনিক কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত, ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কোনো বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান, কোনো ঋণ প্রস্তাবে জামিনদার এবং কাউকে কোনো সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে ব্যবস্থাপনাকে প্রভাবিত করবেন না।’ এই দুই প্রজ্ঞাপন বা সার্কুলার অনেকটা কাজির সেই গরুর মতো। কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। বরং যা যা করা যাবে, সেগুলোই বেশি করেন তাঁরা।
সরকারি ব্যাংক কে দেখভাল করে
এখানে একটি বড় প্রশ্ন হচ্ছে, আসলে সরকারি ব্যাংক কে দেখভাল করে। কোথায় তাদের জবাবদিহির জায়গা, ভুল বা অন্যায় কিছু করলে কে ব্যবস্থা নেবে? ব্যাংক কোম্পানি আইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কিছু ক্ষমতা দেওয়া আছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, এক দেশের এক আইন, অথচ নিয়মনীতি পরিপালনের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক আলাদা করা হয়েছে।
ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কার্যকলাপ আমানতকারীর স্বার্থের পরিপন্থী বা ক্ষতিকর মনে হলে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্ষদ বাতিল করতে পারবে। এই ধারায় শেষ অংশেই আবার আছে, ‘সরকার কর্তৃক মনোনীত বা নিযুক্ত কোনো চেয়ারম্যান বা পরিচালক, যে নামেই অভিহিত হউক না কেন, এর ক্ষেত্রে এই ধারার কোন কিছুই প্রযোজ্য হইবে না। তবে শর্ত থাকে যে, চেয়ারম্যান বা পরিচালকের আচরণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের নিকট কোন প্রতিবেদন পেশ করিলে সরকার উহা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করিবে।’
মূলত ৪৬ ধারার শেষের ওই দুই লাইনের কারণে সরকারি ব্যাংকের কাছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্ব পুরোটাই খর্ব করা হয়েছে। সরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) থেকে শুরু পর্ষদের প্রত্যেকেই জানেন বাংলাদেশ ব্যাংক আসলে তাঁদের নিয়োগকর্তা নয়, আর অপসারণের ক্ষমতাও নেই। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাঁদের কাছে গুরুত্বহীন।
পর্যবেক্ষকেরা কী করেন
তাহলে সরকারি ব্যাংক ঠিকঠাক না চললে কী করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারি ব্যাংকের পর্ষদে কী হয়, তা জানার জন্য হল–মার্ক কেলেঙ্কারির পরে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেওয়া শুরু করে। এখন সরকারি সব ব্যাংকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক আছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৯ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যাংকের কার্যধারা পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তাকে নিয়োগ করতে পারবে এবং ওই কর্মকর্তাকে পর্ষদ সভায় বক্তব্য পেশ করার সুযোগ দিতে হবে এবং সভার কার্যধারা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে দাখিল করবেন।
সরকারি ব্যাংক কে দেখভাল করে। কোথায় তাদের জবাবদিহির জায়গা, ভুল বা অন্যায় কিছু করলে কে ব্যবস্থা নেবে? ব্যাংক কোম্পানি আইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশ কিছু ক্ষমতা দেওয়া আছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, এক দেশের এক আইন, অথচ নিয়মনীতি পরিপালনের ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক আলাদা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রথম পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছেল ১৯৯৪ সালে, তৎকালীন ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে। কোনো লাভ হয়নি। ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে প্রশাসক বসিয়ে বিক্রি করে দিতে হয়েছে। নানা অভিযোগের কারণে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পেরে সেখানে পর্যবেক্ষক দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। জনতা ব্যাংকের একাধিক ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষক থাকাকালে। এমনকি যখন ধ্বংস হচ্ছিল, তখন ফারমার্স ব্যাংকেও পর্যবেক্ষক ছিলেন। সুতরাং বলা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পর্যবেক্ষকেরা ব্যাংকগুলোর অনিয়ম বন্ধ করতে পেরেছেন বা ব্যাংকগুলোর অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পেরেছেন এমনটা দেখা যায়নি। তবে কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের ভবিষ্যৎ চাকরির একটি জায়গা হয়েছে। যেমন পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তা অবসরের পর ওই ব্যাংকেই উচ্চ পদে চাকরি নেন। এর মধ্যে আছেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পর্যবেক্ষক ইউসুফ হারুন আবেদী, প্রিমিয়ার ব্যাংকের মীর আবদুর রহিম এবং পূবালী ব্যাংকে দায়িত্ব পালন করা খুরশিদ উল আলম।
অগ্রণী ব্যাংক–কাণ্ড
পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলে প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা সম্মানী পাওয়া যায়। মিলেমিশে থাকলে ভবিষ্যতে চাকরির সুযোগ তো আছেই। সুতরাং অনেকেই বাড়তি ঝামেলায় যেতে চান না। সবাই–ই যে অনিয়ম ধরতে পারেন, তা–ও না। সুতরাং মোটামুটি একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। এর মধ্যেই কেউ কেউ একটু আওয়াজ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু খুব লাভ হয়নি। বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারের অন্যতম কীর্তি হচ্ছে দেউলিয়া হওয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং দখল। ২০১৫ সালে পিপলস লিজিংয়ে পর্যবেক্ষক ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক এ কে এম আমজাদ হোসেন। পর্যবেক্ষক হিসেবে ২০১৬ সালে লিখিত প্রতিবেদন দিয়ে পরিচালকদের নানা অনিয়ম, পর্যাপ্ত নথিপত্র ছাড়া ১২০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার তথ্য জানিয়েছিলেন। এরপরই আমজাদ হোসেনকে পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতা হলো অগ্রণী ব্যাংকের পর্যবেক্ষক বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক লীলা রশিদের। তিনি অভিযোগ করেন যে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয় না, কথা বলার সময় তাঁকে আটকে দেওয়া হয় এবং আক্রমণাত্মক আচরণও করা হয়। লিখিত এই অভিযোগ ছিল ব্যাংকটির চেয়ারম্যান জায়েদ বখতের বিরুদ্ধে। তিনি অভিযোগে আরও লিখেছিলেন, বিগত দুই মাসের বিভিন্ন সভায় তিনি লক্ষ করেছেন, প্রায়ই অন্য সদস্যদের মতামত উপেক্ষা করে চেয়ারম্যান নিজের মতামত চাপিয়ে দিচ্ছেন।
এ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত চালায় এবং অভিযোগের সত্যতাও পায়। অবশ্য সেই তদন্ত প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপ ফ্রিজে চলে গেছে। আর এর মধ্যেই চলতি ডিসেম্বর মাসে জায়েদ বখতকে তৃতীয়বারের মতো নিয়োগ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় নিজেই পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব থেকে সরে যান লীলা রশিদ। ৩ দফায় ৯ বছরের জন্য চেয়ারম্যান হওয়া বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে বিরল ঘটনা। এই রেকর্ড এর আগে ছিল বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেনের। তিনি প্রায় ১০ বছর চেয়ারম্যান ছিলেন এবং তাঁর বিদায়ের পরেই বাজার পরিস্থিতির বরং উন্নতি হয়েছে।
কোনো সুপারিশ নেই
ব্যাংক সংস্কার কমিশনের ১৯৯৯ সালের একটি প্রতিবেদন আছে ১৩৬ পৃষ্ঠার। ব্যাংক খাত কীভাবে ভালোভাবে চলবে, তা নিয়ে সেখানে ১৮৮টি সুপারিশ আছে। সেই কমিটির চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ১০ ডিসেম্বর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘এই রিপোর্টের বেশ কিছু সুপারিশ একসময় বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা প্রবিধি হিসেবে বাস্তবায়ন করা হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে ব্যাংকিং আইনে রূপান্তরিত করা হয়নি বলে সেগুলো আর কার্যকর থাকেনি। বরং ব্যাংকিং আইনে বিধিনিষেধগুলো আরও শিথিল করার ফলে অনিয়মের সুযোগ আরও বেড়ে গেছে। তার চেয়ে বড় কথা হলো, এত আয়োজন ও পরিশ্রম করে তৈরি সংস্কারের রিপোর্ট তো লাইব্রেরিতে শেলফবন্দী হয়ে থেকে লাভ নেই, যদি বাস্তবায়ন না হয়।’
এরপরও ব্যাংক খাত নিয়ে নানা গবেষণা হয়েছে, বই লিখেছেন অনেক, সভা–সেমিনার হয়েছে। সুতরাং ব্যাংক খাতের কী করা উচিত, সবাই তা জানেন। নতুন করে কিছু বলার নেই। রাজনীতিবিদদের পরিচালক করা যাবে না এই সুপারিশ করেছিলেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ কমিটি। কিন্তু যাঁরা সরাসরি রাজনীতি করেন না, তাঁরা যেকোনো অংশেই কম যান না, তা–ও তো দেখা হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে সরকারি ব্যাংক নজরদারির ভার পুরোপুরি দিতে হবে—এ সুপারিশের কথা তো বলা হচ্ছে সেই ১৯৯১ সাল থেকে, যে বছর ব্যাংক কোম্পানি আইন প্রণয়ন হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে কয়েক শ বার। সুতরাং কী করতে হবে সবাই জানেন। নতুন করে বলার কিছু নেই।
২০ বছর আগে ব্যাংকমালিকদের কথা না শুনলে ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বিদায় নিতে হতো। এ নিয়ে কথা হচ্ছিল ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের সঙ্গে। তিনি বলেন, সে সময় ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) মালিকদের হাত থেকে রক্ষা করাটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন তো দেখা যায় দুই পক্ষের মধ্যে যোগসাজশ।
পরিস্থিতি আসলে এমনই। এমডিরা এখন মালিকদের সব ধরনের কর্মকাণ্ডের সহযোগী। সিকাদর পুত্ররা যখন আরেক ব্যাংকের এমডিকে গুলি করেন, তখন তাঁদের সহযোগী ছিলেন তাঁদের ব্যাংকেরই এমডি। সরকারি ব্যাংকের একজন পরিচালক নিজ ব্যাংকের অভিজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, বোর্ড সভায় এখন এমডির প্রথম কাজ হচ্ছে তাঁদের চেয়ারম্যান যে ইতিহাসের সেরা, তা নিয়ে বক্তৃতা দেওয়া, আর চেয়ারম্যানের কাজ হয় এমডির গুণকীর্তন গাওয়া। এ রকম একসময়ে ব্যাংক খাত নিয়ে কোনো সুপারিশ না করাই ভালো। করে তো কোনো লাভও নেই।
● শওকত হোসেন প্রথম আলোর বিশেষ বার্তা সম্পাদক shawkat.massum@prothomalo.com