জীবের বেঁচে থাকার জন্য বালিশ, পানি ও খাদ্যের প্রয়োজন হয়। ক্লাস-পরীক্ষার খাতায় এ কথা লিখেছে ঢাকার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র সাম্মির।
আমার তরুণ বন্ধু সেঁজুতি শোণিমা, ডাকনাম নদী, সাম্মিরের শিক্ষক। ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ফেসবুকে ছাত্রের বাণীটি তুলে দিয়েছিলেন। সেটা পড়ে নানা কথা মাথায় এল।
রায়েরবাজারের অবৈতনিক স্কুলটিতে কোন শিশুরা পড়ে? তাদের একজনের কেন বেঁচে থাকার প্রশ্নে বালিশের কথা মনে হয়? সাম্মিরকে দেখতে খুব মন চাইল।
নদীকেও অনেক দিন দেখিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে ছবি আঁকায় এমএ পাস করে তিনি সাংবাদিকতা করছিলেন। তাঁর বাবা লতিফ সিদ্দিকী ছিলেন সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। মস্তিষ্কের ক্যানসারে ভুগে ১৯৯৯ সালে বড় অকালে মারা যান।
নদী কেন হঠাৎ সাংবাদিকতা ছেড়ে সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়াতে গেলেন, সেটাও জানার কৌতূহল ছিল। ওঁর সঙ্গে ফোনে সময় ঠিক করি। পরদিন দুপুরে সাতমসজিদ রোড ছেড়ে গলির রেস্তোরাঁর ভাজা ইলিশের গন্ধ নাকে নিয়ে গেট পেরিয়ে স্কুলটির ধুলায় ধূসর মাঠে পা রাখি।
তারপর প্রধান শিক্ষকের ঘরে। আলাপ-পরিচয়ের পর তিনি ক্লাসে চলে গেলেন। বলে গেলেন, নদীর ক্লাসে যেতে পারব। ভিডিও করতে পারব। তবে স্কুলের নাম জানানো যাবে না। সরকারের শিক্ষা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া হয়নি, সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বললে ঝামেলা হবে।
তিনতলা ভবনটি মোটের ওপর ছিমছাম। নদীর ক্লাস তিনতলায়। সিঁড়ির দিকে যেতে দেয়ালে চোখে পড়ে ‘সিটিজেন চার্টার’—স্কুল কী সেবা দেবে, তার পরিপাটি বিবরণ।
সিঁড়ির নিচের বিশুদ্ধ পানির নীল পাত্রের নিচে বোধ হয় পাইপ ফেটেছে। সেখানে ঘোলা পানি ছপ ছপ করছে, সারাইয়ের লোক এসেছে। শেষবেলার ক্লাস। বারান্দায় আর সিঁড়িতে কিছু ছেলেমেয়ে হল্লা করছে।
তৃতীয় শ্রেণির ‘কামিনী’ শাখার দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম। প্রায় আমার সঙ্গেই ঢুকল এক কার্টন পুষ্টিকর বিস্কুটের প্যাকেট। প্রতি বিকেলে সরকারের উপহার।
দু-তিনটি ছেলে গুছিয়ে জনে জনে প্যাকেট পৌঁছে দিল। ছেলেমেয়েদের কেউ তা রাখল সামনে, কেউ মাথার ওপর, কেউবা পানির বোতলের ওপর। তবে খুলল না।
তখন তাদের ভাষা আন্দোলনের কথা বলছিলেন নদী। জিজ্ঞাসা করলেন, মায়েরা যদি বাংলায় সোনামণি-সোনাবাবু বলে আদর করতে না পেত, তাহলে কি ভালো লাগত? ৬৮ বছর আগে বাঙালিরা তাই নিজের ভাষায় কথা বলার অধিকার চেয়েছিল।
নদী বই খুলে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার কথা পড়ালেন। সাদা বোর্ডে কালো কালিতে শহীদ মিনারের ছবি আঁকলেন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ গাওয়ালেন।
শাখায় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৬২। সেদিন ছোট টেবিলগুলো ঘিরে নীল-সাদা পোশাক পরা জনা পঞ্চাশেক বাচ্চা বসেছিল। দেয়াল মলিন, মেঝে চল্টা-ওঠা। জানালার দিয়ে দেখি, নিচে আধা পাকা বস্তিঘরের ঘিঞ্জি বিস্তার। একটু দূরে বহুতল ভবনের ভিড়।
সাম্মিরকে দেখলাম, ভালো নাম যার নাইমুল হাসান। হালকা-পাতলা ছোট্ট ছেলেটির মুখে সরলতা লেপ্টে আছে। হরিণের মতো টানা দুই চোখে লাজুক উৎসুক চাহনি।
ক্লাস ভাঙলে ছেলেমেয়েরা ঢেউয়ের মতো গেটের দিকে ছুটল। সাম্মির থাকে মা-বাবা আর ছোট ভাই শাওনের সঙ্গে। একা হেঁটে যাওয়া-আসা করে, তবে সেদিন নিতে এসেছিলেন বাসায় থাকা এক বড় ভাই।
আমরা একটা ছোট দোকানে ঢুকি সাম্মিরকে তার পছন্দের বার্গার খাওয়াতে আর বালিশের গল্পটা জানতে। নরম গলায় সে বলে, ঘুমানোটা খুব জরুরি বিষয়। নদী যোগ করে, মাঝেমধ্যেই ওর স্কুলে আসতে দেরি হয়, বলে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি।
গত বছর নদী সাম্মিরের বাসায় গিয়েছিলেন। ওর বাবা তখন সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালাতেন। পাঁচ পরিবারের একটি বাসায় এক ঘর আর একচিলতে বারান্দা নিয়ে ওরা থাকত। রান্নাঘর আর টয়লেট বারোয়ারি।
নদী বলেন, তাঁর ছাত্রছাত্রীর বড় অংশ স্বল্প আয়ের পরিবারের ছেলেমেয়ে। বাবারা দোকানে কাজ করেন, গাড়ি চালান, স্বর্ণকার বা মৃৎশিল্পী। মায়েরা হয়তো বাসাবাড়িতে কাজ করেন। অনেকের ভাঙা পরিবার, মা-বাবা নেই। দাদি-নানি বা চাচার সংসারে থাকে।
শিক্ষকেরা শিশুদের বাড়িতে যান, খোঁজখবর করেন। একটি মেধাবী ছাত্রের বাবা অন্যত্র থাকেন। যখন আসেন, মায়ের রোজগারের টাকা কেড়ে নেন। রাতে মাকে মারপিট করেন। ছেলেটি ঘুমাতে পারে না, মন খারাপ থাকে। এসব দিনে সে স্কুলে আসে না।
নয় বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন নদী। বাবার স্মৃতি তাঁকে শিখিয়েছিল, সাংবাদিকতা পেশায় মানুষের জন্য কাজ করা যায়। তাই তিনিও সাংবাদিক হয়েছিলেন। কিন্তু ছয় বছরের মাথায় কেমন যেন মোহভঙ্গ হলো।
তখনই সুযোগটাও সামনে এল। নদী ‘টিচ ফর বাংলাদেশ’ নামে একটি বেসরকারি সংস্থার ফেলোশিপ পেলেন। ফেলোরা পড়ানো আর শিশুর সবটুকু সম্ভাবনা বিকাশের প্রশিক্ষণ পান। শিক্ষক-সংকট আছে, এমন সরকারি বা এনজিও স্কুলে তাঁরা দুই বছর পড়ান।
সংস্থাটি ‘টিচ ফর অল’ নামের একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা আন্দোলনের সদস্য। ফেলোরা মাসিক বৃত্তি পান। পাশাপাশি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কুল-উন্নয়ন আর শিক্ষার নেতৃত্ব বিষয়ে মাস্টার্স করেন।
গত বছর দ্বিতীয় শ্রেণিতে নদী এমন বাচ্চাও পেয়েছিলেন, যার ঠিকমতো অক্ষর শেখা হয়নি। স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৮০০ ছেলেমেয়ে। শিক্ষক মাত্র ১৩ জন। তদুপরি তাঁদের সরকারি নানা দায়িত্ব পালন করতে হয়।
মাল্টিমিডিয়া ক্লাসঘর আছে। কিন্তু ব্ল্যাকবোর্ডের এত করুণ দশা যে চকের লেখা শিশুরা দেখতে পায় না। নদীর ক্লাসে এক শুভানুধ্যায়ী একটি সাদা বোর্ড দিয়েছেন। মজা করে পড়ানোর উপকরণ নিজেকেই জোগাড় করে আনতে হচ্ছে।
স্কুলে কোনো বাগান নেই। এ বছর বিজ্ঞান শেখার জন্য ছেলেমেয়েরা দেয়ালে কাগজের একটি বড় গাছ সেঁটেছিল। অন্য বাচ্চারা সেটা ছিঁড়ে দিয়েছে। এখন ঠিক হয়েছে, দেয়ালে প্লাস্টিকের বোতল ঝুলিয়ে প্রত্যেকে একটি করে চারা লালন করবেন।
নদীর জন্য এটা মানুষের সঙ্গে গোড়া থেকে কাজ করার সুযোগ। তিনি বলেন, বাচ্চারা যখন সত্যিই কোনো কিছু শিখতে পারে এবং আনন্দ নিয়ে শিখতে পারে, সেটা তাদের জন্য একটা নতুন অভিজ্ঞতা—‘তখন আমি বাচ্চাদের চোখে-মুখে যে আনন্দটা দেখতে পাই, সেটা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া। সেটা আসলে পুরো দিনটাকে সুন্দর করে দেয়।’
গত বছর একটি বাচ্চার বাবা আত্মহত্যা করলে তার স্কুলে আসা বন্ধ হয়ে যায়। এই শিশুরা কিন্তু স্কুলে আসতে চায়। পড়াশোনা করতে চায়।
সাম্মির বলেছিল, সবচেয়ে ভালো লাগে বাংলা পড়তে। আর সে চায় পাইলট হতে। ওর স্বপ্নরা আকাশে ওড়ে।
কুর্রাতুল-আইন-তাহ্মিনা: সাংবাদিক
qurratul.tahmina@prothomalo.com
আরও পড়ুন: