সময় বদলে দেওয়া কোভিডকালে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন

সামাজিক চুক্তি প্রসঙ্গে নতুন করে ভাবার উপলক্ষ এনে দিয়েছে কোভিড-১৯ অতিমারি। আমাদের পারস্পরিক সহযোগ ও অন্বয়ের রূপটির নতুন বিন্যাস কেমন হবে, তা খতিয়ে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। কোভিডের ক্ষয়ক্ষতি বিভিন্ন দেশ ও সমাজের বিভিন্ন অংশের ক্ষেত্রে একই রকম হয়নি। এ প্রভাব অনেকটাই বিষম, যা দেশের ভেতরে ও বাইরে পারস্পরিক সহযোগিতা ও একে অপরের পাশে থাকার মধ্যে বিদ্যমান বিরাট ফাঁকগুলোকে স্পষ্ট করে দিয়েছে। ফলে অনেক বছর ধরে মানব উন্নয়নে সাধিত অগ্রগতিগুলো এখন অনেকটাই থমকে গেছে। ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে।

কোভিড-১৯ বিশ্বায়নের এক নতুন মুখ হাজির করেছে। এক নতুন উপলব্ধি তার মর্ম। সেটা এই যে কেউ নিরাপদ নয় যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রত্যেকে নিরাপদ। এটাই আজকের নয়া সর্বজনীনতাবাদ। করোনার অতিমারি যখন ভীষণ ঝড় হয়ে আঘাত হানল, দেখা গেল, বিশ্ববাসী এক নৌকায় নেই। কিছু অংশের আছে শক্তপোক্ত নৌকা। সেই নৌকার নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা যাত্রীদের গায়ে আঘাত কমই লাগল। এমন কী অতিমারি থেকে তারা লাভবানও হলো। আরও বেশ কিছু নৌকা দেখা গেল, যেগুলো অতটা মজবুত নয়, চলনসই গোছের। ফলে তাদের বেশ সংগ্রাম করতে হলো। বাকিরা, যেমন ধরুন, পৃথিবীর ৭০ কোটি চরম দরিদ্র মানুষ, যাদের কোনো নৌকাই নেই, তারা অথই সাগরে পড়ে থাকল। কিন্তু এ এমন এক পরিস্থিতি, যেখানে একটি মানুষও যতক্ষণ নৌকার বাইরে থাকছে, ততক্ষণ নৌকার আশ্রয়ে থাকা মানুষগুলোও নিরাপদ নয়। ততক্ষণ তারাও ঝুঁকির মধ্যেই থাকবে।

বাংলাদেশের নেতৃত্ব আন্তরিক চেষ্টা করে যাচ্ছে, যাতে দেশের প্রত্যেকের একটি করে নৌকা থাকে। আয়তনে ছোট্ট দেশটির সেই প্রচেষ্টা ইতিমধ্যে বিশ্ববাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছে। বৈষম্য হ্রাসে প্রচেষ্টা, দারিদ্র্য বিমোচন ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং জীবনকাল ৭২ বছরে উন্নীত হওয়া, যা যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলের চেয়েও বেশি, এসবই সেই অর্জনের অংশ। জন্মলগ্ন থেকেই কানাডাকে পাশে পেয়েছে বাংলাদেশ। লিঙ্গবৈষম্য দূর করা, দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাসরত সুবিধাবঞ্চিত মানুষের শিক্ষা ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রগুলোতে বাংলাদেশের অংশীদার হয়েছে কানাডা। বাংলাদেশের দৃষ্টান্তমূলক অগ্রগতির জন্য দারিদ্র্যবান্ধব নীতি, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকেন্দ্রিক কার্যক্রম, সামাজিক উদ্ভাবনগুলোর সফল প্রয়োগ এবং রাষ্ট্র ও ব্র্যাকের মতো উন্নয়ন সংস্থাসহ বেসরকারি খাতের মধ্যে নিবিড় সহযোগিতার সমন্বিত বাতাবরণকেই প্রধান কৃতিত্ব দেওয়া হয়ে থাকে।

কানাডা ১৯৯৬ থেকে শুরু হয়ে ১৮ বছরব্যাপী বাস্তবায়িত উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচিতে ব্র্যাককে সহায়তা প্রদান করেছে। সম্প্রতি কক্সবাজারে ব্র্যাকের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বাস্তবায়িত শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিতেও ব্র্যাকের সহযোগী হয়েছে। দুই অংশীদারের মজবুত এই সহযোগ এখন কোভিড-১৯-এর আঘাত মোকাবিলায় প্রয়োগ করা হবে। মহামারির প্রভাবে বৈষম্যের নাটকীয় বিস্তার হ্রাসের লক্ষ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ঘটাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নতুন এ লক্ষ্য অর্জনে তাই দেশটি আগামী পাঁচ বছরের জন্য ব্র্যাককে সাড়ে চার কোটি কানাডীয় ডলার সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ত্রিপক্ষীয় কৌশলগত অংশীদারত্বে (স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট—এসপিএ) ব্র্যাক ও অস্ট্রেলিয়া সরকারের সঙ্গে কানাডাও যোগ দিচ্ছে।

অতিমারির প্রভাবে ২০২১ সালের শেষের মধ্যে বিশ্বে ১৫ কোটি মানুষ নতুন করে চরম দরিদ্র হয়ে পড়বে। উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তা—এই দুই খাতে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের জন্য একটি কাজের ক্ষেত্র সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ করে এ পরিস্থিতি। সেটি হলো নতুন করে সৃষ্টি হওয়া বৈষম্য এবং ইতিমধ্যে অর্জিত উন্নয়ন ও অগ্রগতি থেকে অতিমারির কারণে বিশ্বজুড়ে ছিটকে পড়া কোটি কোটি মানুষের আর্থসামাজিক পুনরুদ্ধারে কাজ করার ক্ষেত্র। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বিশ্ব যে সাড়া দিয়েছে, তাকে সত্যিকার অর্থে ফলপ্রসূ করতে হলে অবশ্যই সমতাসূচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আগাতে হবে। আন্তর্জাতিক উন্নয়নে সম্পৃক্ত মহলকে মহামারির ধাক্কায় অর্থনৈতিকভাবে নিদারুণ ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াতে হবে। চলমান অতিমারিতে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। ব্র্যাকের সঙ্গে কানাডার এই অংশীদারত্বের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হবে, অতিমারি মোকাবিলায় বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো এবং দুর্গমতম অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর কাছে সহায়তা পৌঁছানো।

সহযোগের কেন্দ্রে থাকবে উন্নয়ন কার্যক্রমে নারীর ভূমিকাকে নিশ্চিত করার দৃষ্টিকোণ, যা বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সব সময় করা হয়েছে। ব্র্যাকের নারীকেন্দ্রিক উন্নয়ন দর্শনের কেন্দ্রে আছে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম–অধিকার, সম্পদের ওপর সমনিয়ন্ত্রণ ও অত্যাবশ্যকীয় সেবায় সম–অধিকার। ব্র্যাকের এই নারীকেন্দ্রিক উন্নয়ন দর্শন কানাডা সরকারের নারীবাদী আন্তর্জাতিক সহায়তানীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। এই অংশীদারত্ব এমন একটা সময়ে ঘটতে যাচ্ছে, যখন নতুন ধরনের, অধিক কার্যকর ও ব্যয়সাশ্রয়ী উন্নয়ন সহযোগ এবং বৈষম্য হ্রাসে আন্তর্জাতিক সমন্বয় অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে জরুরি হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাস বাধার পর্বত অতিক্রম করে ঈর্ষণীয় উন্নয়ন সাফল্য অর্জনের ইতিহাস। সেই সফল লড়াইয়ের মূলে আছে দুটি বিষয়। এক. টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ঘটানোয় দায়বদ্ধতা, যাতে প্রত্যেকেই নৌকার অধিকারী হয়। দুই. প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে উঠে দাঁড়ানো এবং উন্নয়ন উদ্যোগ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেশের মানুষের সহজাত সামর্থ্যের স্বীকৃতি। কানাডা ও ব্র্যাকের এই অংশীদারত্ব দীর্ঘমেয়াদি সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এ ধরনের নতুন সামাজিক চুক্তি সংঘটনে এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এ চুক্তির আওতায় বৈষম্য হ্রাসে ব্র্যাকের প্রমাণিত সামর্থ্যে বিনিয়োগ করছে কানাডা, যা বাংলাদেশকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আরও মজবুত ভিত্তি নিয়ে উন্নয়নের ধারায় ফিরে আসতে ভূমিকা রাখবে।

কারিনা গোল্ড কানাডা সরকারের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী।

আসিফ সালেহ্‌ ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক।