সংবাদমাধ্যম

সম্পাদক পরিষদের কাছে প্রত্যাশা

জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু খবরের কাগজে ছাপা হয়নি, অথবা কোনো খবরের ভুলভ্রান্তি ধরিয়ে দেওয়া কিংবা ব্যক্তিগত মতামত জানাতে পাঠকেরা একসময়ে প্রচুর চিঠি লিখতেন। এখন অবশ্য তার আর খুব একটা প্রয়োজন হয় না। কাগজগুলোর অনলাইন সংস্করণে খবরের নিচেই মন্তব্য করা যায়। তা ছাড়া, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও এখন সবাই তাঁদের মনোভাব প্রকাশ করতে পারেন। প্রযুক্তির অগ্রগতি সাইবার জগতে একধরনের গণতন্ত্রায়ণ এনেছে। বাংলাদেশে অবশ্য প্রথমে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা, আর এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সেই সাইবার গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধের সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। আমাদের জাতীয় পত্রিকাগুলোর সম্পাদকদের ধন্যবাদ যে তাঁরা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন।

সদ্য প্রণীত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রশ্নে জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের ফোরাম সম্পাদক পরিষদ ঢাকায় এক মানববন্ধনের কর্মসূচি দিয়েও সরকারের অনুরোধে তা স্থগিত করেছে। নিঃসন্দেহে এটা একটা ভালো পদক্ষেপ। সব ঠিক থাকলে সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে আজই সরকারের তিনজন মন্ত্রীর আলোচনা হওয়ার কথা। আলোচনার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সম্পাদক পরিষদ আশাবাদ প্রকাশ করেছে যে ‘আলোচনার মাধ্যমে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধকারী ধারাগুলো অপসারণ করা হবে’। আইনটির কোন কোন ধারা মতপ্রকাশের পথে বাধা তৈরি করবে, তার দফাওয়ারি ব্যাখ্যাও সম্পাদক পরিষদ সংবাদপত্রে প্রকাশ করেছে।

বিজ্ঞ সম্পাদকদের প্রজ্ঞায় আমাদের আস্থা আছে। তবে মন্ত্রীদের অনেকের তা আছে কি না, সে প্রশ্ন একেবারে উপেক্ষণীয় নয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির উদ্যোক্তা এবং প্রস্তাবক যে মন্ত্রণালয়, সেই তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী বলেছেন, সাংবাদিকদের এত ভয় কেন? তাঁরা কি ডিজিটাল মাধ্যমে অপরাধে জড়িত হতে চান? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়ে যেসব আপত্তি উঠেছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনার জন্য তথ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণের পর তাঁর সহকর্মীর বক্তব্যের ইঙ্গিত কিন্তু আমাদের মোটেও আশাবাদী করে না। সংবাদমাধ্যমের প্রতি তথ্যমন্ত্রীর কথিত সহমর্মিতায় যে সুফল মেলে, সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা তা বলে না। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ে সরকার–সমর্থক হেলমেট বাহিনীর হামলায় প্রায় জনা চব্বিশ সাংবাদিকের আহত হওয়ার ঘটনায় তথ্যমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে গ্রেপ্তারের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। সেই চিঠিতে যে ধুলার আস্তরণ জমেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, এমনকি অতীব ক্ষমতাধর সরকারের চৌকস পুলিশ বাহিনীর গোয়েন্দারা হামলাকারীদের শনাক্তই করতে পারেননি। তবে আদৌ তাঁরা তা চেয়েছেন কি না, সেটাও বড় প্রশ্ন।

সংবাদমাধ্যমের মালিকদের কাছে সাধারণভাবে আর্থিক লাভ–ক্ষতির বিষয়টিই প্রধান বিবেচ্য। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যক্তির রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা। আর রাজনৈতিক বিভাজনের শিকার সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর ওপর অনেকেরই আস্থায় ঘাটতি আছে। সে কারণেই নিবর্তনমূলক আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সম্পাদকদের জোটবদ্ধ ভূমিকার গুরুত্বই আলাদা। সম্পাদকদের কাছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, পাঠকের স্বার্থ এবং পেশাগত বিবেচনাই প্রধান। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সেই স্বাধীনতা খর্বের হাতিয়ার হবে, এই আশঙ্কাই যে এখন তাঁদের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হবে—সেটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু তাঁদের কাছে আমাদের বিনীত নিবেদন যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা যে ইতিমধ্যেই ব্যাপকভাবে সংকুচিত হয়েছে, সে কথাটি যেন তাঁরা ভুলে না যান। অঘোষিত এবং অনানুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ যে প্রকাশ্য এবং আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের চেয়েও গুরুতর রূপ ধারণ করেছে, সে কথা তাঁদের চেয়ে আর কেউ বেশি জানেন না। যেখানে-সেখানে কথিত মানহানি এবং অনুভূতিতে আঘাত করার মামলা যে সাংবাদিকদের হয়রানি করার সবচেয়ে কার্যকর ও পছন্দের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, তার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী দেশের শীর্ষস্থানীয় সম্পাদকেরা। কয়েক বছর ধরেই বেসরকারি খাতের বিজ্ঞাপনে অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য একাধিক পত্রিকাকে খেসারত দিতে হচ্ছে। দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দুটি পত্রিকার সাংবাদিকদের ওপর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও অনুষ্ঠানে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা গত কয়েক বছরেও প্রত্যাহার হয়নি।

সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের সময় সরাসরি সম্প্রচার ঢালাওভাবে নিষিদ্ধ করার নতুন নজির তৈরি হয়েছে। সরকারকে সহায়তা করার অনুরোধের ভীতি সঞ্চারক টেলিফোন এখন সর্বস্তরের সাংবাদিকদের জন্য এক নতুন উৎপাতে রূপ নিয়েছে। সরকারের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহ বিবেচনার প্রমাণ আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের কারাজীবন। শুক্রবার রাতে জাতিসংঘে ‘গরাদে আটকা সাংবাদিকতা’ শিরোনামে এক আলোচনায় কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের প্রধান জোয়েল সায়মন বাংলাদেশের শহিদুলের উদাহরণ টেনেছেন। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতায়, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের, বিচারহীনতাই এখন নতুন বাস্তবতা।

প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতির জন্য বিশ্ব যে পুরোপুরি প্রস্তুত নয়, সেটা আমরা সবাই জানি। যে কারণে এখন উন্নত বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই) সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে চলছে অসংখ্য গবেষণা। দুর্বৃত্ত বা অপরাধী চক্র এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো এই প্রযুক্তি আয়ত্ত করতে পারলে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সরকারগুলোর জন্য বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে। সুতরাং প্রযুক্তির অপব্যবহার বন্ধে আইনের প্রয়োজনীয়তা কেউই অস্বীকার করে না। কিন্তু সে আইন হতে হবে ব্যক্তির জানমাল ও অধিকার সুরক্ষায়। রাষ্ট্রকে অন্যায় সুবিধা দিতে নয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের হাতিয়ার হতে নয়।

একই সময়ে করা দুটি আইনের বৈপরীত্য এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। উভয় আইনের ক্ষেত্রেই সরকার কথিত অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সড়ক পরিবহনে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ আইনে মানুষের মৃত্যুর জন্য সাজা হচ্ছে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর, আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘনের সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। সড়ক পরিবহনের আইনে অধিকাংশ অপরাধই রাখা হয়েছে জামিনযোগ্য; আর ডিজিটাল আইনে অন্তত ১৪টি ক্ষেত্রকে করা হয়েছে জামিন-অযোগ্য। যাত্রীদের দাবি উপেক্ষা করে পরিবহনমালিকদের কোটারির স্বার্থে দুর্ঘটনার সাজার ক্ষেত্রে রক্ষণশীল অবস্থান নেওয়া হয়েছে। বিপরীতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অসীম ক্ষমতা পেয়েছে পুলিশ, যেমনটা সাধারণত পুলিশি রাষ্ট্রেই দেখা যায়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি এবং গ্রেপ্তারের বিধান সংশোধন অত্যন্ত জরুরি। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে, বিশেষত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সন্দেহের বশে কোথাও তল্লাশি চালানো যায় না, আদালতের অনুমোদন বা পরোয়ানা প্রয়োজন হয়। কাউকে সন্দেহ করার যে যথেষ্ট কারণ আছে, তা আদালতে প্রমাণ দিয়ে তবেই পাওয়া যায়। আইনবহির্ভূত কোনো সুবিধা সাংবাদিকদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু আইনগত সুরক্ষা অবশ্যই প্রয়োজন। সে কারণেই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে তা তদন্তে আদালতের অনুমতি বাধ্যতামূলক করা উচিত।

ক্ষমতার অপব্যবহার ক্ষমতাধরদের একটা স্বভাবজাত রোগ। কিন্তু গণতন্ত্রে নানা ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থায় একধরনের রাশ টেনে ধরার বিষয় কার্যকর থাকে, ফলে নাগরিকেরা যেমন সুরক্ষা পায়, তেমনি ক্ষমতাধরেরা জবাবদিহির ভয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে বিরত থাকে। আমাদের দেশে না আছে সেই প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য, না আছে জবাবদিহি। সরকারি কর্মকর্তাদের অবস্থান আইনের অনেকটাই ঊর্ধ্বে। সন্দেহজনক গ্রেপ্তারের আইন ৫৪ ধারা, গ্রেপ্তারের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করার বাধ্যবাধকতা, ৫৭ ধারা প্রয়োগে পুলিশের সদর দপ্তরের অনুমোদন—এগুলোর যথেচ্ছ অপপ্রয়োগ অহরহই ঘটছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যে অভূতপূর্ব ক্ষমতা দিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন করা হচ্ছে, সেই প্রতিষ্ঠান কার কাছে জবাবদিহি করবে, তা স্পষ্ট নয়। ওই কাউন্সিলও ক্ষমতায় যে দল থাকবে, তার হুকুমবরদার প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে না, তার নিশ্চয়তা কী?

সরকারের অনুরোধে কর্মসূচি স্থগিতের বিবৃতিতে সম্পাদক পরিষদ যথার্থই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে ‘এর আগেও মন্ত্রী যখন কোনো বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন, তাতে আমরা অংশ নিয়েছি, যদিও সেসব আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে বলা যাবে না।’ বিভিন্ন পেশাজীবী ও নাগরিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সরকার কথা বলে না, তা বলা যাবে না। তবে আইন প্রণয়ন কিংবা কোনো জাতীয় নীতিমালা তৈরির ক্ষেত্রে সরকার যে অংশীজনদের পরামর্শ শোনে, তা–ও নয়। এসব ক্ষেত্রে সরকারের কৌশলের সবচেয়ে লক্ষণীয় উপাদান হচ্ছে, শোনার দরকার শুনব, কিন্তু মানব না। সুতরাং সম্পাদক পরিষদের কাছে প্রত্যাশা যে তারা সংবাদমাধ্যমের পরিপূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলবে, তার সুরক্ষায় আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা নেবে। ভয় কাটিয়ে স্বনিয়ন্ত্রণের (সেলফ সেন্সরশিপ) বেড়াজালটা ছিন্ন করার সংগ্রামেও নেতৃত্ব দেবে। আমাদের সন্তানেরাই কিছুদিন আগে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, ‘যদি তুমি ভয় পাও তবে তুমি শেষ, যদি তুমি রুখে দাঁড়াও তবে তুমি বাংলাদেশ’।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক