দুই দু’গুণে পাঁচ

সমাধিস্থল পরিদর্শন

বিলেতের এক ইংরেজ নারী নাকি একবার কতিপয় সদ্য-পরিচিত প্রতিবেশীর কাছে গল্প করেছিলেন, ‘মাই হাজব্যান্ড ওয়ার্কস উইথ ফাইভ হানড্রেড পারসন্স আন্ডার হিম’ আমার স্বামী তাঁর নিচে পাঁচ শ জন লোক নিয়ে কাজ করেন। সবাই ভাবল, তাঁর স্বামী বুঝি পাঁচ শ লোকের বস। কিন্তু পরে অনুসন্ধানে জানা গেল, ওই নারীর স্বামী একটি সমাধিস্থলে ঘাস কাটেন, যেখানে মোট কবরের সংখ্যা পাঁচ শ।

তা ইংরেজ নারীটি তো শো অফতথা নিজেকে জাহির করার জন্য এরূপ বলেছিলেন। আমাদের দেশের এক রাজনৈতিক নেতা একটি প্রাক্‌-নির্বাচনী সভায় যেটা বলেছিলেন, সেটাকে কী বলবেন? বোকামি? ভাইসব, তিনি বলেছিলেন, ‘আপনাদের দাবি হচ্ছে একটি গোরস্থানের। আমি ওয়াদা করছি, আপনারা ভোট দিয়ে আমাকে জয়যুক্ত করলে আমি ঘরে ঘরে গোরস্থান বানিয়ে দেব।’

আর বিলেতের যেকোনো সমাধিস্থলে গেলে সেখানকার কবরোপরি স্থাপিত স্মৃতিপ্রস্তরে উৎকীর্ণ বাণী, যেটাকে ইংরেজিতে এপিটাফ (epitaph) বলে, সে ক্ষেত্রেও অনেক সময় অনেক মজার কথা প্রত্যক্ষ করা যায়। এই যেমন—‘হিয়ার লাইজ দ্য সাইক্লিস্ট এমিলি কাইট/শি পুট আউট হার লেফটহ্যান্ড অ্যান্ড টার্নড রাইট।’ তার মানে, এমিলি কাইট সাইকেলে চড়ে রাজপথ দিয়ে যাচ্ছিলেন; রাস্তার সংযোগস্থলে ডান দিকে মোড় নিতে গিয়ে তিনি বাঁ হাত দেখানোয় গাড়িচাপা পড়ে পটল তুলে ওখানে শুয়ে আছেন, এই আরকি!

আমাদের এতদুদ্দেশে্য যে এপিটাফের প্রচলন নেই, এমন নয়। মাইকেল মধুসূদনের স্বলিখিত এপিটাফ—‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব বঙ্গে/ তিষ্ঠ ক্ষণকাল এ সমাধিস্থলে...’ ইত্যাদি তো সব শিক্ষিত বঙ্গসন্তানের জানার কথা। আর দিল্লির মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের অনুজা জাহানারা ও আত্মজা জেবুন্নিসা, দুজনেই ছিলেন কবি। তো জেবুন্নিসার কবরে তাঁর স্বরচিত এপিটাফ আছে, ফার্সি জবানে: ‘বর্‌ মাযারে গরীবে মা না চেরাগে না গুলে/ না পুড়ে পরিন্দায়ে শুদ না সেতায়ে বুলবুলে।’ যেটার বঙ্গানুবাদ করেছেন ছন্দের জাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর অনুকরণীয় সুললিত ছন্দে—

গরীব গোরে দীপ জ্বেলনা, ফুল দিওনা কেউ ভুলে;

শামা পোকার না পোড়ে পাখ, দাগা না পায় বুলবুলে।

যাকগে, এবার আসল কথায় আসি। পটোম্যাক নদীর তীরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির প্রায় কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত আরলিংটন ন্যাশনাল সেমিট্রি (cemetery) তথা জাতীয় সমাধিক্ষেত্র প্রায় ২০০ একর জমির ওপর অধিষ্ঠিত একটি অনন্য দর্শনীয় স্থান। ওখানে ও দেশের গৃহযুদ্ধ থেকে শুরু করে বিশ্বযুদ্ধ, কোরিয়ান ও ভিয়েতনাম যুদ্ধ, মায় হালের ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে নিহত তিন লক্ষাধিক সৈনিক ব্যতিরেকেও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ও তাঁদের পরিবারের যোগ্য সদস্যদের সমাহিত করা হয়েছে ও হচ্ছে। এই যেমন আমেরিকার ৩৫তম প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি, যিনি ১৯৬৩ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে টেক্সাস
স্টেটের ডালাসে সরকারি সফরকালে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। তাঁকেও তাঁর পরিবারবর্গের সঙ্গে আরলিংটন সমাধিক্ষেত্রে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে সমাহিত করে সেখানে একটি দীপশিখা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তো ২০১৬ সালের সামারে কোনো এক রৌদ্রস্নাত সকালে পাশাপাশি সমাহিত প্রেসিডেন্ট কেনেডি, তাঁর স্ত্রী মিসেস জ্যাকুলিন কেনেডি ওনাসিস (নামটা ওভাবেই খোদাই করা) ও একমাত্র পুত্রের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে যে চিন্তাস্রোত আমার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, সেটা এস্থলে না বললে এই লেখাটি অসম্পূর্ণই থেকে যাবে: আরলিংটনে যখন কেনেডির মরদেহ সমাহিত করা হচ্ছিল তখন তাঁর শিশুপুত্র কর্তৃক সদ্য-বিধবা মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে পিতার কফিনকে স্যালুট করার দৃশ্য সারা পৃথিবীকে শোকাভিভূত করে ফেলেছিল। অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস! সেই ছেলেটিই যুবা বয়সে নিজে বিমান চালিয়ে একটি পারিবারিক উৎসবে যোগদান করতে গিয়ে সাথি, স্ত্রী ও শ্যালিকাসহ অতলান্তিকের তলে তলিয়ে গেল। আর তাঁর স্ত্রীও বৈধব্যের মাত্র চার-পাঁচ বছরের মাথায় বৃদ্ধ গ্রিক ধনকুবের অ্যারিস্টোটল ওনাসিসকে বিয়ে করে তামাম দুনিয়াকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিলেন। ইউরোপের এক যুবতী মেয়ে তো তাৎক্ষণিকভাবে মাথা ন্যাড়া করে ঘোষণা দিয়ে বসেছিল, ওই বুইড়্যা না সরা বা মরা পর্যন্ত আমি মাথা ন্যাড়াই রাখব। বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনও তখন ওনাসিস সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছিল,  He is 60, looks 50, acts 40—তাঁর বয়স ৬০, দেখায় ৫০, কাজ করেন ৪০-এর। এবং জন কেনেডি যেদিন নিহত হন, সেদিন নাকি ৫০ শতাংশ আমেরিকান তাঁদের দৈনন্দিন কাজকর্ম বন্ধ করে দিয়েছিলেন ও পরবর্তী দিনগুলোতে কেউবা কেঁদেছেন, কেউবা অগ্নিমান্দ্যতায় ভুগেছেন, কেউবা চোখের ঘুম হারিয়েছেন।

আর আরলিংটন সমাধিক্ষেত্রে কবরগুলো এতটাই সুবিন্যস্ত ও কবরোপরি স্থাপিত শ্বেতবর্ণের অনুচ্চ স্মৃতিপ্রস্তরসমূহ এতটাই সুন্দর সারিবদ্ধভাবে স্থাপিত, সর্বোপরি এতটাই সুনসান নিস্তব্ধতা ও তকতকে-ঝকঝকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ যে প্রবেশপথে পা রাখলেই চমৎকৃত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। আমাদের দেশটা আকারে ছোট, তা নইলে এ ধরনের বিশালায়তন জাতীয় সমাধিক্ষেত্র আমাদের এখানেও বোধ করি প্রতিষ্ঠা করা যেত; এবং তেমনটা ঘটলে কোনো গাত্রদাহ কিংবা কবর নিয়ে টানাটানির প্রশ্নও আদৌ উঠত না।

নিবন্ধটির যবনিকাপাত ঘটাতে যাচ্ছি দুজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তির প্রাসঙ্গিক দুটো উপাখ্যান পরিবেশন করে—

এক. বিলেতের একসময়ের বিখ্যাত প্রধানমন্ত্রী ডিজরায়লি ছিলেন একজন অসাধারণ বাগ্মী। তো একবার ওখানকার হাউস অব লর্ডস-এর এক সদস্য তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন কী করে বক্তব্য দেওয়ার দক্ষতা বাড়ানো যায়, যাতে করে তিনি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেন। তদুত্তরে ডিজরায়লি তাঁকে বললেন, ‘আপনার বাড়ির কাছে কি কোনো কবরস্থান নেই? আমার পরামর্শ হচ্ছে, ওখানে রোজ সকালে গিয়ে আপনি কবরোপরি স্থাপিত স্মৃতিপ্রস্তরসমূহের ওপর প্র্যাকটিস করতে থাকুন।’

দুই. হাস্য-সম্রাট মার্ক টোয়েনের কাছে একবার কিছু লোক স্থানীয় কবরস্থানের ভাঙা পাঁচিল মেরামতের জন্য চাঁদা চাইতে এসেছিলেন। মার্ক টোয়েন তখন তাঁদের বললেন, ‘দুঃখিত, আমি আপনাদের অনুরোধ রক্ষা করতে পারব না। এই চাঁদা দেবার কোনো মানেই হয় না।’

‘কেন?’ চাঁদা-প্রার্থীরা প্রশ্ন করলেন।

প্রত্যুত্তরে মার্ক টোয়েন বললেন, ‘কারণটা খুবই সহজ। কবরবাসীদের কোনো সাধ্য নেই কবরস্থানের বাইরে আসার; আর আমরা যারা বাইরে আছি তারাও প্রাণ থাকতে চাইব না ভাঙা পাঁচিলের ফাঁক দিকে ওখানে প্রবেশ করে বাস করার। কাজেই ভাঙাটা যেভাবে আছে সেভাবেই থাক।’

আতাউর রহমান: রম্যলেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷