বৈশ্বিক মহামারি করোনার নানামুখী অর্থনৈতিক ক্ষতি ও পুনরুদ্ধার নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সমাজকাঠামোর কী ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে, তা নিয়ে বিশ্লেষণ অল্প। সমতাভিত্তিক পুনরুদ্ধারে সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তনের প্রবণতাগুলো ধারণ করা জরুরি।
করোনা সংকট সমাজের মাঝের শ্রেণিগুলোতে ভাঙন ধরিয়েছে। নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্য-মধ্যবিত্ত অংশের সঞ্চয়, আয় ও কর্মসংস্থানে বড় ধরনের আঘাত হেনেছে। তাদের অনেকে নতুন দরিদ্রে পরিণত হয়েছেন। বলা হয়ে থাকে, উচ্চবিত্ত ২০ শতাংশ এবং দরিদ্র সাড়ে ২০ শতাংশ বাদ দিলে জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশই মাঝের শ্রেণিভুক্ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, করোনায় আর্থিক সংকটে পড়া ৪৬ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় ভেঙে এবং ৪৩ শতাংশের বেশি পরিবার আত্মীয়স্বজনের সাহায্য-সহায়তার ওপর নির্ভর করে সংসার চালিয়েছে। অন্যদিকে ১১ শতাংশ পরিবার জমি বিক্রি বা বন্ধক রেখেছে। এদের বড় অংশটিই মধ্যবিত্তের নিচের দুই ভাগ।
অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিতরাই করোনার অভিঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এদের বেশ বড় একটা অংশই নিম্নমধ্যবিত্ত। তবে সরকারি চাকরি ছাড়া আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক উভয় খাতের মানুষেরই আয় কমেছে। আনুষ্ঠানিক খাতের মাত্র ১৫ লাখ সরকারি, বাকি ৭৫ লাখ মানুষ বেসরকারি খাতে নিয়োজিত। অভিঘাতের প্রথম কয়েক দিনেই ব্র্যাক এক গবেষণায় দেখিয়েছে, মহামারির মাত্র দেড় মাসে শস্য ও মত্স্য খাতে যথাক্রমে প্রায় ১৫ হাজার এবং ৩৯ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। সেবা খাতের কর্মীদের বেতন ৩১ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে।
বিবিএস বলছে, ৬৭ দশমিক ১২ শতাংশ খানা সঞ্চয়ে অক্ষম। এর ওপর সাইক্লোন আম্পান এবং দীর্ঘস্থায়ী বন্যা দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলেছে। সর্বজনীন জীবনব্যাপী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ব্যবস্থাও নেই। ফলে অধিকাংশ মানুষেরই যেকোনো অভিঘাত সামাল দেওয়ার সক্ষমতা কম। তাই সমাজের মাঝের শ্রেণিগুলো ভেঙে পড়ছে। আর এ কারণেই নতুন দারিদ্র্য হার বাড়ছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থার (বিআইডিএস) গবেষণা অনুযায়ী, নতুন ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের কাতারে যুক্ত হয়েছে।
নীতিকৌশলের বৈষম্যমূলক প্রভাবের কারণে উল্লম্ব দিকে আর করোনার মতো মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি অভিঘাতে অনুভূমিক দিকে মেরুকরণ বাড়ছে। পিছিয়ে পড়া, দুর্বল, ঝুঁকিপ্রবণ মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত ক্রমেই প্রান্তিক হয়ে পড়ছে। সম্পদ ওপরের দিকের কিছু ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। করোনার আগেই ওপরের দিকের ১০ শতাংশ মানুষের আয় নিচের দিকের ৪০ শতাংশ মানুষের আয়ের চেয়ে বেশি ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, মহামারির মধ্যেই কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৩ হাজার ৪১২ জন। এক দশকে ধনকুবেরের সংখ্যা বৃদ্ধির হারে শীর্ষে বাংলাদেশ। বিপরীতে দারিদ্র্য হার ও বৈষম্য বাড়ছে এবং মেরুকরণ ত্বরান্বিত হচ্ছে।
সমাজের মধ্যবর্তী শ্রেণিগুলোর লালিত অনানুষ্ঠানিক মূল্যবোধ, প্রথা, বিশ্বাস ও চেতনা রাষ্ট্র এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। তবে এর একটি অংশ দরিদ্রের কাতারে চলে যাচ্ছে। অপর ক্ষুদ্র অংশটি কোনো রকমে টিকে আছে। আরেকটি অংশ রাষ্ট্রক্ষমতা (অপ) ব্যবহার করে বা এর কাছাকাছি থেকে যেকোনো প্রক্রিয়ায় অর্থ উপার্জনে নিয়োজিত এবং উচ্চবিত্তের কাতারে যাচ্ছে। এ ভাঙনের কারণে সামাজিক কাঠামোয় বড় ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাদের বলিষ্ঠ অবদান ও নেতৃত্ব ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। রাজনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায় তারা নীতিকৌশল প্রণয়নে তেমন প্রভাব রাখতে পারছে না। শক্তিশালী হচ্ছে গোষ্ঠীতন্ত্র। গোষ্ঠীতন্ত্র আদিম কায়দায় সম্পদ সঞ্চয়নে যতটা ব্যতিব্যস্ত, জাতি গঠন এবং উৎপাদনমুখী বিনিয়োগে ততটাই উদাসীন। গোষ্ঠীতন্ত্রে মধ্যবর্তী শ্রেণিসমূহের একটি অংশও আছে। এদের কাছে অর্থই সব সফলতা-ব্যর্থতার মাপকাঠি। রাষ্ট্রকে জবাবদিহিমূলক, সমতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের প্রচেষ্টাও দুর্বল হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্র ক্রমেই নিবর্তনমূলক রূপ পরিগ্রহ করছে।
করোনা অভিঘাতের আগেই যুবকদের আয় ও কর্মসংস্থান অনিশ্চয়তা শুরু হয়েছিল। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ১৪ থেকে ২৪ বছর বয়সী যুব বেকারত্বের হার ছিল ১২ দশমিক ৩ শতাংশ। বিআইডিএস এক গবেষণায় দেখিয়েছে, শিক্ষিত যুবকদের প্রায় ৩৩ শতাংশই ছিল বেকার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, যুবকদের ২৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ কোনো ধরনের কর্মসংস্থান, শিক্ষা অথবা প্রশিক্ষণে নিয়োজিত ছিল না।
করোনার কারণে এ সমস্যা আরও প্রকটতর হয়েছে। আইএলও এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের যৌথ প্রতিবেদন বলছে, করোনার কারণে বাংলাদেশে ১১ দশমিক ১৭ লাখ থেকে ১৬ দশমিক ৭৫ লাখ যুবক বেকার হতে পারে। যুব বেকারত্বের হার ২০১৯ সালের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২০২০ সালে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশ হতে পারে। সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা বন্ধ হয়ে আছে। বন্ধ হয়ে আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। অসংখ্য শিক্ষার্থী টিউশনের আয়ের টাকায় নিজের খরচ এবং সংসারের খরচ চালাত। অনেকেই নানা রকম অনানুষ্ঠানিক পেশা যেমন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, ফটোগ্রাফি, টু্যরিস্ট গাইড ইত্যাদিতে খণ্ডকালীন নিয়োজিত ছিল। করোনার কারণে এ সুযোগগুলো সংকুচিত হয়েছে। চাকরির ওয়েবসাইটগুলোতে এপ্রিল ২০২০ নাগাদ ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় নতুন চাকরির বিজ্ঞাপন প্রায় ৮৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
বিদ্যমান কাঠামোগত দুর্বলতা এবং করোনার অভিঘাত যুবকদের একধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে। অথচ এ পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়ে যুব সম্প্রদায়কে জনশক্তিতে রূপান্তর ও উৎপাদনমুখী কাজে নিয়োজনের মাধ্যমে জনমিতির লভ্যাংশের সুফল আদায় করা দরকার ছিল। করোনা পরিস্থিতিতে যুবকদের সংশয় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেলেও তা কাটানোর কার্যকর তেমন ব্যবস্থা নেই। একদিকে সুযোগের অভাব, অন্যদিকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, গুণমানসম্পন্ন শিক্ষার স্বল্পতার কারণে একটি দুষ্টচক্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু বিশালসংখ্যক যুবকদের কাজে লাগানো না গেলে রাষ্ট্র জনমিতির লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে জাতি গঠনে একটি প্রজন্মকে হারাতে হতে পারে।
সবাই আশা করে, পুনরুদ্ধার কাঠামোর প্রকৃতি হতে হবে সমতাভিত্তিক ও সর্বজনীন। সরকার নীতিকৌশলে সক্রিয় প্রতিরোধ বা অ্যাকটিভ রেসট্রেইন্ট ব্যবস্থা তথা সরকারিভাবে গণদ্রব্য বা পাবলিক গুডস প্রদান, সম্পদ এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক সুফল ও সুযোগ-সুবিধাগুলোর সুষম বণ্টন, সামষ্টিক আর্থিক খাতে প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ এবং অর্থনীতির কাঠামোগত সংস্কারের জন্য নীতিমালা গ্রহণ করলে অপেক্ষাকৃত একটি সমতাভিত্তিক পুনরুদ্ধার সম্ভব। আর নীতিকৌশলে সক্রিয় নিষ্ক্রিয়তার বা অ্যাকটিভ ইনেকশন আশ্রয় নিলে তথা প্রচলিত ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখলে অর্থনীতি চরম বৈষম্যমূলক পুনরুদ্ধারের পথে যেতে পারে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে মডার্ন মনিটারি তত্ত্বের (এমএমটি) আলোকে অর্থ সরবরাহ বাড়ানো-ঋণভিত্তিক প্রণোদনা প্যাকেজ খুব কার্যকরীভাবে কাজ করবে না। ঋণভিত্তিক প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নসংক্রান্ত গণমাধ্যমের প্রতিবেদনসমূহ তাই বলছে। আবার রাজস্ব নীতির মাধ্যমে অর্থ সরবরাহ বাড়ালেও আর্থিক নিষ্কাশন বা ফিসকাল ড্রেনেজের কারণে সহায়তা সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছানো দুরূহ। পুনরুদ্ধারের মূল লক্ষ্য তথা কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং সার্বিক চাহিদা বৃদ্ধি অর্জিত না হয়ে গোষ্ঠীতান্ত্রিক পন্থায় ক্ষমতার (অপ) ব্যবহার করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা বিদ্যমান। ফলে উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না। উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান সৃষ্টির হওয়া কঠিন। বিনিয়োগ বাড়াতে হলে প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ও সক্ষমতা বাড়িয়ে অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা জরুরি। এ ক্ষেত্রে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মতো রাষ্ট্রকেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। তবেই একটি গুণগত মানসম্পন্ন ও টিকে থাকার যোগ্য পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন
rt@du.ac.bd