নানা কারণে আমাদের দেশের চলচ্চিত্র মানসম্পন্ন স্তরে এখনো পৌঁছাতে পারেনি। দু-তিন বছর পর একটি বা দুটির ঝলক অনেককে তৃপ্তি এনে দেয় বটে, কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, এখনো আমাদের চলচ্চিত্র সাধারণভাবে একটা মান অর্জন করতে পারেনি। জাতীয়ভিত্তিক বা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক নানা পুরস্কার দিয়ে চলচ্চিত্রকে টেনে তোলার চেষ্টা করা হলেও ঠিকভাবে তুলতে পারা যায়নি। ঢাকার চলচ্চিত্র এখনো শিক্ষিত, রুচিমান দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি; দু-তিন বছরে ব্যতিক্রম দু-একটা চলচ্চিত্র ছাড়া।
শিক্ষিত ও রুচিমান দর্শকের জন্য বিকল্প বিনোদন হতে পারত টেলিভিশনের অনুষ্ঠান, যা বিটিভির প্রথম ২৫ বছরে সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন বিটিভি ও ৩০টির বেশি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের পক্ষেও দর্শকের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। রুচিমান দর্শক বিনোদনমূলক বাংলাদেশি টিভি অনুষ্ঠানবিমুখ। তাদের অনেকেই ভারতীয় নানা টিভি চ্যানেলের প্রতি আসক্ত। নানা অনানুষ্ঠানিক জরিপে জানা যায়, প্রায় প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বিভিন্ন শহুরে বাড়ির টিভি বাক্সটি গিন্নিদের দখলে চলে যায়। তখন তাঁদের অখণ্ড মনোযোগ কলকাতার নানা টিভি সিরিয়াল ও রিয়েলিটি শোর দিকে। ব্যতিক্রম দেশপ্রেমিক দর্শক কিছু আছেন। তবে তাঁরা সংখ্যায় কম। এ ব্যাপারে সঠিক চিত্র জানার জন্য কোনো পেশাদারি প্রতিষ্ঠান দর্শক মতামত জরিপ করতে পারে। তথ্য মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগ নিলে ভালো হয়। পেশাদারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে জরিপ করাতে হবে। তা না হলে সরকারের মনজোগানো জরিপ হতে পারে, যা ভোটের সময় প্রায়ই দেখা যায়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও টিভির এই প্রেক্ষাপটে সরকার জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালার খসড়া প্রকাশ করেছে। এই নীতিমালার খসড়া নিয়ে শুরুতেই বিতর্ক দেখা দিয়েছে। চলচ্চিত্রজগতের ব্যক্তি ও গবেষকেরা বলেছেন, কিছু বিধিবিধান চলচ্চিত্রশিল্পকে আধুনিক হতে সাহায্য করবে। কিন্তু তাঁদের ভয়, কিছু বিধিনিষেধ অবাঞ্ছিত বিধিনিষেধ ডেকে আনতে পারে। এ জন্য তাঁরা প্রস্তাবিত নীতিমালাটি পরিমার্জন করে, আরও নমনীয় ও কিছু বিষয়ে স্পষ্ট করে সংজ্ঞায়িত করতে বলেছেন।
নীতিমালায় নানা বিষয় অস্পষ্ট রাখা সরকারের একটি অভ্যাস। তাতে সরকারের যখন যা প্রয়োজন, সেভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। নীতিমালা যদি স্পষ্টভাবে লেখা হয়, তাহলে সংশ্লিষ্টরা বারবার আমলাদের দ্বারস্থ হবে না। এটা আমলাতন্ত্র চায় না।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের খসড়া নীতিমালার রূপরেখা পড়ে মনে হলো, আমলাতন্ত্র চলচ্চিত্রকে নানা শিকল দিয়ে বাঁধতে চাইছে। এভাবে ভালো চলচ্চিত্র তৈরি সম্ভব হয় না। চলচ্চিত্রের একটাই নীতিমালা হতে পারে। তা হলো, সমাজবাস্তবতার প্রতিফলন। সমাজে যা নেই, যা শুধু ব্যতিক্রম, তা যেন চলচ্চিত্রে স্থান না পায়। খুবই ব্যতিক্রম কোনো ঘটনা সমাজবাস্তবতা হতে পারে না। যা প্রায়ই ঘটছে, যা সাদা চোখে দেখা যায়, সেটাই বাস্তবতা। মাঝেমধ্যে স্রষ্টার ইচ্ছায় দুই মাথাওয়ালা শিশু জন্ম নেয়। কিন্তু তা বাস্তবতা নয়। কিন্তু ঘটনাটি সত্য। তাই বলে চলচ্চিত্রের কাহিনিতে দুই মাথাওয়ালা শিশুর জন্ম দেখানোর প্রয়োজন নেই।
আমাদের আমলাতন্ত্র ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ ও ‘সরকারবিরোধী’ বক্তব্যকে গুলিয়ে ফেলে। রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য দেওয়ার কারও অধিকার নেই। একমাত্র একাডেমিক গবেষণায় তা অনুমোদনযোগ্য। যেমন কোনো গবেষক নানা তথ্য-উপাত্ত, ব্যাখ্যা দিয়ে বলতে পারেন, ‘১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ করা ঠিক হয়নি।’ গবেষকের সেই স্বাধীনতা রয়েছে। সেটা গবেষণার স্বার্থে, জনমত সৃষ্টি করার জন্য নয়।
তথ্য মন্ত্রণালয় চলচ্চিত্র নীতিমালার খসড়ায় যে শর্তগুলো আরোপ করেছে, তা অনুসরণ করলে শেষের কবিতার মতো রোমান্টিক উপন্যাস নিয়ে ছবি করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। সিনেমাজুড়ে নায়ক-নায়িকার রোমান্টিক সংলাপ, মাঝেমধ্যে রবীন্দ্রসংগীত আর কবিতা। ব্যস, হয়ে গেল একটি সিনেমা। সেটাও মন্দ নয়। প্রেমের বা রোমান্টিক সিনেমারও দরকার রয়েছে।
প্রস্তাবিত চলচ্চিত্র নীতিমালার খসড়া পড়ে কলকাতা ও মুম্বাইয়ে নির্মিত সাম্প্রতিক সিনেমার কথা মনে পড়ে গেল। কলকাতার জি–বাংলার ‘আমার দুর্গা’ সিরিয়ালে যেভাবে অপরাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে দুর্গা ‘মুখ্যমন্ত্রী’র পদে নির্বাচিত হয়েছেন, তা কি পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক রাজনীতির বাস্তবতা নয়? পশ্চিমবঙ্গের সরকার, তৃণমূল, বিজেপি বা কংগ্রেসপন্থী দর্শকেরা কি তা নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন? করেননি। কারণ, তাঁরা সবাই জানেন এটা পশ্চিমবঙ্গের অপরাজনীতির বাস্তবতা। অনুমান করি, তাঁরা চলচ্চিত্রে এই অপরাজনীতিকে উন্মোচন করে, ধিক্কার দিয়ে পরিচ্ছন্ন রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করতে চান। আর সেই লক্ষ্যে চলচ্চিত্রকে তাঁরা একটি হাতিয়ারে পরিণত করেছেন। আর আমরা কী করছি? বালুতে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে চাচ্ছি। সমাজবাস্তবতাকে অস্বীকার করতে চাচ্ছি।
কলকাতার সিনেমার একটি জনপ্রিয় চরিত্র ‘ফাটাকেষ্ট’। মিঠুন চক্রবর্তী অভিনীত ‘এমএলএ ফাটাকেষ্ট’কে জনতার চাপে ‘মুখ্যমন্ত্রী’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এক সপ্তাহের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তিনি মন্ত্রিসভার দুর্নীতিবাজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নানা অপকীর্তি উন্মোচন করে সমাজে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ড এই সিনেমাকে কি ছাড়পত্র দিত? দর্শক কিন্তু এই সিনেমাকে গ্রহণ করেছেন। এই সিনেমা ও ফাটাকেষ্ট চরিত্রটি জনপ্রিয় হয়েছে। এই সিনেমার একটি ইতিবাচক বার্তা হলো, দু-একজন দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীর জন্য পুরো সরকারের বদনাম হয়। মুখ্যমন্ত্রী সৎ থাকলেও দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীর জন্য সরকারের ভালো নীতি বাস্তবায়িত হয় না। আমাদের দেশে কি আমরা সে রকম দৃষ্টান্ত দেখিনি? তাহলে চলচ্চিত্রের কাহিনিতে তা স্থান পেলে দোষ কোথায়?
নীতিমালায় বলা হয়েছে, ‘জনস্বার্থবিরোধী বক্তব্য প্রচার করা যাবে না।’ কোনটা জনস্বার্থবিরোধী, এটা ঠিক করবেন কে? সরকারের কাছে যেটা জনস্বার্থবিরোধী, জনগণের কাছে কি তা সব সময়ই জনস্বার্থবিরোধী? জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে, ভেজালে ছেয়ে গেছে বাজার, বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে—এগুলো সবই জনস্বার্থবিরোধী। এখন চলচ্চিত্রে এর বিরুদ্ধে কথা বললে বা কোনো অ্যাকশন দেখালে তাকে নীতিমালার আলোকে কী বলা হবে? সিনেমায় ক্ষুব্ধ জনতা যদি কোনো দুর্নীতিবাজ, কালোবাজারি বা মজুতদারের গুদামের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে, তাহলে সেটাকে কী বলা হবে?
রাজনীতি আমাদের দেশে ও ভারতে একটি জনপ্রিয় বিষয়। রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী ও এমপিদের কুকীর্তি নিয়ে ভারতে প্রচুর সিনেমা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি চোরাচালানি, ডন, গ্যাংস্টার, মাফিয়া গ্রুপ—এদের কুকীর্তি নিয়েও ভারতে প্রচুর ছবি তৈরি হয়েছে। দুটোই বাস্তবতা। আমাদের দেশেও এই দুইয়ের অস্তিত্ব রয়েছে। হয়তো ভারতের তুলনায় কলেবরে ছোট। কিন্তু অস্তিত্ব রয়েছে। সিনেমার কাহিনিতে আমরা কি এসব ঘটনা বা চরিত্র আনব না? আনলে দোষ কোথায়? এগুলো কি সমাজবাস্তবতা নয়? এগুলো আমরা সিনেমায় আনব এদের নেতিবাচকতা উন্মোচন করার জন্য। বাহবা দেওয়ার জন্য নয়। সিনেমার কাহিনিতে এদের পরাস্ত করতে হবে। চলচ্চিত্র এভাবে সমাজে সচেতনতা তৈরি করতে পারে।
কলকাতা ও মুম্বাইয়ের সিনেমায় পুলিশ একটি বিশিষ্ট চরিত্র। ভারতের বহু সিনেমার প্রধান চরিত্র পুলিশ। আমাদের প্রস্তাবিত চলচ্চিত্র নীতিমালায় হয়তো পুলিশকে এভাবে দেখানো যাবে না। কেন যাবে না? আমাদের পুলিশ কি ধোয়া তুলসীপাতা? পুলিশ নিয়ে নানা ভালো-মন্দ খবর কি আমাদের সংবাদপত্রে প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে না? ভালো ও দায়িত্বশীল পুলিশের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজ পুলিশও যে এ বাহিনীতে রয়েছে, তা কি আমরা দেখাতে পারব না? কলকাতা ও মুম্বাইয়ের অনেক সিনেমায় পুলিশের নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতা চমৎকারভাবে দেখানো হয়েছে এবং তা দর্শকনন্দিত হয়েছে। প্রায় ৩০ বছর আগে নির্মিত দিলীপকুমার ও অমিতাভ বচ্চন অভিনীত শক্তি সিনেমাটি ভারত সরকারের উদ্যোগে সে দেশের প্রতিটি পুলিশ কেন্দ্রে দেখানো হয়েছে বলে শুনেছি। পুলিশের নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতার কত বড় দৃষ্টান্ত হলে একটি সিনেমা দেশের সব পুলিশ সদস্যকে দেখাতে ভারত সরকার উৎসাহিত হয়েছে। সিনেমা কিন্তু অনুপ্রেরণার একটি বড় শক্তি। কিন্তু শুধু ‘ভালো ভালো’ দিক নিয়ে সিনেমা করলে সিনেমার এই গ্রহণযোগ্যতা হতো না। ভালো-মন্দ দুটোই পাশাপাশি সিনেমায় তুলে ধরতে হবে। কারণ, সেটাই বাস্তবতা।
আমাদের মতে, চলচ্চিত্র নীতিমালার একটাই শর্ত হতে পারে তা হলো, কাহিনি বাস্তবসম্মত কি না। বাস্তবতাবিবর্জিত বা খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা চলচ্চিত্রের কাহিনি হতে পারে না। বিশেষ ফ্যান্টাসি সিনেমা হতে পারে। বাস্তবসম্পন্ন হলে সিনেমার কাহিনিকে ছাড়পত্র দিতে হবে। কোনো অজুহাতে সেই সিনেমাকে আটকানো যাবে না। তবে সেই কাহিনি নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। অশ্লীলভাবে বা অমার্জিতভাবে উপস্থাপন করা যাবে না।
চলচ্চিত্র নীতিমালা প্রণয়নকারীদের মনে রাখতে হবে, চলচ্চিত্র একটি সৃজনশীল শিল্পমাধ্যম। এটাকে ‘পাট নীতিমালা’ বা অন্য কোনো নীতিমালার মতো চিন্তা করলে চলবে না। আর এটা সরকারি টাকায়ও নির্মিত হচ্ছে না। এটা সম্পূর্ণত প্রাইভেট সেক্টরের কাজ। সরকার বছরে চার-পাঁচটি ছবি তৈরির আংশিক অনুদান দেয়। সেই শক্তির জোরে সরকার একটি প্রাইভেট সেক্টরের কাজে ছড়ি ঘোরাবে, তা মেনে নেওয়া যায় না। প্রয়োজন হলে সরকার অনুদানপ্রাপ্ত সিনেমার জন্য একটা নীতিমালা তৈরি করতে পারে। সে লগ্নিকৃত টাকা সরকারের ফিরিয়ে আনার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রাইভেট সেক্টরকে তো টাকা ফিরিয়ে আনতে হবে।
আমাদের ভয় হয়, তথ্য মন্ত্রণালয় এভাবে রক্ষণশীল চলচ্চিত্র নীতিমালা পাস করাতে পারলে একদিন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ও আবদার করবে, সাহিত্য রচনার জন্যও একটা নীতিমালা করা দরকার! আমরা প্রস্তাবিত চলচ্চিত্র নীতিমালা আবার নতুন করে লেখার জন্য প্রস্তাব করছি। এটা অস্পষ্ট, তাই পরিবর্তনযোগ্য।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।