প্রতিক্রিয়া

সমাজতন্ত্র কি পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর?

সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বৈষয়িক সম্পদের প্রাচুর্য সৃষ্টি করতে চায়
সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বৈষয়িক সম্পদের প্রাচুর্য সৃষ্টি করতে চায়

১৯১৭ সালে রাশিয়ার বলশেভিকরা যে বিপ্লব করেছিলেন, অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নামে যা পরিচিত, তার ১০০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। সারা পৃথিবীতে, বিশেষত এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ উদ্যাপন শুরু হয়েছে। এসব দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, সমর্থক ও তাত্ত্বিকেরা মস্কো-পিকিং ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া সমাজতন্ত্রের দিনগুলোর স্মৃতি রোমন্থনে একাত্ম হয়েছেন। বাংলাদেশেও অক্টোবর বিপ্লব শতবর্ষ উদ্যাপনের উদ্দেশ্যে একটা জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির উদ্যোগে এক মাস ধরে নানা আয়োজন চলবে। ঢাকার শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে গতকাল বিকেলে এক সমাবেশের মাধ্যমে মাসব্যাপী আয়োজনের উদ্বোধন হয়েছে। আগামী ৭ নভেম্বর সমাপনী সমাবেশ ও লাল পতাকা মিছিলের মাধ্যমে অক্টোবর বিপ্লবের শতবর্ষ উদ্যাপন সমাপ্ত হবে।
গতকাল উদ্বোধনী দিনে জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখা একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে প্রথম আলোর মতামত পাতায়। ‘থেমে নেই মানব মুক্তির লড়াই’ শিরোনামের ওই নিবন্ধে তিনি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনিবার্যতার প্রতি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ পৃথিবীকে ধ্বংস হতে দেবে না। তারা নিজেদেরকে এবং পৃথিবীকে রক্ষা করবে।’
পুঁজিবাদের সীমাহীন প্রকৃতি-শোষণের ফলে পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘পুঁজিবাদের কঠিন কুঠারাঘাতে প্রকৃতি আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে, ধরিত্রী উত্তপ্ত হচ্ছে। উত্ত্যক্ত প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে। ভয়াবহ পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে জলবায়ুতে; ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের সংখ্যা ও মাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে, বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রের পানির স্তর দিচ্ছে উঁচু করে, ফলে অনেক নিম্নাঞ্চল ঝুঁকিতে পড়ছে তলিয়ে যাওয়ার। প্রকৃতিকে বিরূপ করার জন্য দায়ী পুঁজিবাদী বিশ্বের বিলাস ও ভোগবাদিতা, এর ভুক্তভোগী বিশ্বের গরিব মানুষ।’
লেখকের এই বক্তব্যের সারবত্তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে ভেবে দেখার অবকাশ আছে, পুঁজিতন্ত্রের বিপরীতে যে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা আমাদের হলো, তা পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষার ব্যাপারে কতটা মনোযোগী ছিল। প্রকৃতিকে শোষণ ও দোহন করে বৈষয়িক সম্পদ উৎপাদনের ক্ষেত্রে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র কি পশ্চিমা পুঁজিতন্ত্রের চেয়ে বেশি বিবেচক ও কম ক্ষতিকর ছিল?
এ বিষয়ে প্রথমে লক্ষ করা দরকার, বৈষয়িক সম্পদ উৎপাদনের ক্ষেত্রে পুঁজিতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য অভিন্ন: আরও বেশি পরিমাণে সম্পদ উৎপাদন করা। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর নিবন্ধের উপসংহারে যথার্থই লিখেছেন: অক্টোবর বিপ্লব ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটিয়ে ‘সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে দরিদ্র পৃথিবীতে নয়, সর্বাধুনিক উন্নত পৃথিবীতে’। সর্বাধুনিক উন্নত পৃথিবী গড়ে উঠতে পারে মানুষের ভোগ্য বৈষয়িক সম্পদের প্রাচুর্য ঘটানোর মধ্য দিয়ে। মার্ক্স-কথিত সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে তখন, যখন পৃথিবীতে মানুষের ভোগ্য বৈষয়িক সম্পদের উচ্ছ্রয় বা উপচে পড়া প্রাচুর্য সৃষ্টি হবে।
অর্থাৎ সমাজতন্ত্র ও পুঁজিতন্ত্র উভয় ব্যবস্থাকেই নিজ নিজ লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য প্রথমে বিপুল পরিমাণ বৈষয়িক সম্পদ উৎপাদন করতে হবে। এ দুই ব্যবস্থার পার্থক্য শুধু সেই সম্পদ বিতরণ ও ভোগের ব্যবস্থায়। সমাজতন্ত্রের প্রতি আমাদের পক্ষপাতের প্রধান কারণ সম্পদ বিতরণ ও ভোগের ক্ষেত্রে মানুষে মানুষে বৈষম্যের অবসান ঘটানোর প্রতিশ্রুতি বা প্রত্যাশা রয়েছে এই ব্যবস্থার মধ্যে।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক অভিজ্ঞতাকে বিচার করতে হবে ইউরোপের শিল্পবিপ্লব-উত্তর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে রেখে। সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলানির্ভর রাষ্ট্রতন্ত্র ও সমরতান্ত্রিক আধুনিকায়নের একটা সাধারণ প্রবণতা ছিল অতি উচ্চাভিলাষী উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং যেকোনো মূল্যে তা অর্জনের চেষ্টা করা। এ জন্য বিপুলসংখ্যক মানুষের স্থানান্তর, বিভিন্ন ছোট ছোট নৃগোষ্ঠীর প্রাকৃতিক জীবনধারার পরিবর্তন, জবরদস্তিমূলক শ্রম, বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ্য উৎপাদন, বন উজাড়, নির্বিচার পশু শিকার ইত্যাদি ক্ষতিকর কর্মকাণ্ড চলেছে। সোভিয়েত অর্থনীতির প্রধান উৎসই ছিল প্রাকৃতিক সম্পদ, সেই সব সম্পদ বিপুল পরিমাণে আহরণ করে পুঁজিবাদী দুনিয়ার কাছে বিক্রি করাই ছিল তাদের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের প্রধান উপায়। এই প্রক্রিয়ায় প্রকৃতিকে ‘জয় করা’—শোষণ ও দোহন করা ছিল সোভিয়েত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জীবনধারার আধুনিকায়নের প্রধান পন্থা।
সোভিয়েত ইউনিয়নে অনেক আরবান ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেন্টার গড়ে তুলতে গিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের ভীষণ ক্ষতি হয়েছে। ‘হেলদি হিউম্যান সেটলমেন্টস ইন হারমোনি উইথ নেচার’, অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ স্বাস্থ্যকর মানব বসতি গড়ে তোলার লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়েছে বটে, কিন্তু তা করতে গিয়ে অনাহার, রোগব্যাধি, বন-জঙ্গল উজাড় ও পরিবেশের মারাত্মক দূষণ ঘটার দৃষ্টান্তও অনেক আছে।
শিল্পবিপ্লব শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে। প্রবল, বিপুল, রুদ্র প্রকৃতিকে মোকাবিলা করে মানুষকে টিকে থাকতে হয়েছে। একটা সময় ছিল, যখন প্রকৃতিকে জয় করাই ছিল মানুষের প্রধান উদ্যম। প্রকৃতিকে শোষণ ও দোহন না করলে মানুষের অস্তিত্বই যেন-বা টেকে না। কিন্তু আজ আর সে অবস্থা নেই, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ভাষায়, আজ প্রকৃতিই মানুষের দ্বারা এমনভাবে ‘উত্ত্যক্ত’ হচ্ছে যে সে পাল্টা প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে।
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এই বৈরিতা পুঁজিতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র উভয় ব্যবস্থার মধ্যেই আছে। মাত্রাগত পার্থক্যটা নির্ভর করছে দেশ বা অঞ্চলভেদে মানুষের সাংস্কৃতিক অবস্থার ওপর। রাশিয়া ও ১৪টি সোভিয়েত রিপাবলিক মিলিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের যে বিশাল দেশ গড়ে উঠেছিল, তা ছিল পুরো পৃথিবীর ছয় ভাগের এক ভাগ ভূখণ্ডজুড়ে। ওই দেশের মোট মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৮ কোটি। তাদের কাছে প্রকৃতি ছিল সীমাহীন, অফুরান এক ব্যাপার, যাকে শোষণ ও দোহন করে নিঃশেষ করা যাবে না বলে তারা মনে করত। তারা পুঁজিতান্ত্রিক দুনিয়ার ধনী লোকদের মতো ধনী ছিল না, কিন্তু ওই সব দেশের গরিব লোকদের তুলনায় অনেক সচ্ছল ছিল। কিন্তু সেই সচ্ছলতায় তাদের তৃপ্তি ছিল না। সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সমাজে শুধু ব্যক্তিই অতৃপ্ত ছিল না, রাষ্ট্রও অতৃপ্ত ছিল। তারা আরও সচ্ছলতা চেয়েছিল। তাদের বৈষয়িক সম্পদ ভোগের তৃষ্ণা পুঁজিবাদী দুনিয়ার মানুষদের চেয়ে কম ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়ন বা পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো তাদের নাগরিকদের সেই ভোগলিপ্সা মেটাতে পারেনি। এবারের মতো এই সমাজতান্ত্রিক মহাপরীক্ষা যে সফল হলো না, তার একটা প্রধান কারণ এটাই বলে আমার ধারণা।
কিন্তু বিষয়টা এমন নয় যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বৈষয়িক সম্পদ ভোগের তৃষ্ণা মেটাতে চায় না। এমন নয় যে সে তার সব নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের চাহিদা মিটিয়েই তৃপ্ত হয়। না, তা নয়, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বৈষয়িক সম্পদের প্রাচুর্য সৃষ্টি করতে চায়; এত ধনী, আধুনিক ও উন্নত হতে চায় যে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারবে।
সমস্যা এখানেই। কি পুঁজিতন্ত্রে, কি সমাজতন্ত্রে মানুষের লক্ষ্য যদি হয় বৈষয়িক সম্পদের সীমাহীন প্রাচুর্য সৃষ্টি করা, তাহলে প্রকৃতিকে যথেচ্ছ শোষণ ও দোহন করা ছাড়া উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে ‘হারমোনি উইথ নেচার’ বা প্রকৃতির সঙ্গে মিতালি রক্ষা করা নিছক শুভকামনা ছাড়া কিছু নয়।
এই সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে হলে মানুষের বৈষয়িক উন্নতির ধারণা বদলাতে হবে; সীমাহীন ভোগলিপ্সার রাশ
টানতে হবে।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
mashiul.alam@gmail.com