প্রোগ্রামিং শিক্ষা

সমস্যা সমাধানে দক্ষ প্রজন্মের সন্ধানে

নব্বইয়ের দশকে ইন্টারনেটের যখন বিকাশ শুরু হয়, তখনো অনেকে বিশ্বাস করত না ইন্টারনেট এত সর্বব্যাপী হবে। এই প্রযুক্তির হাত ধরে বদলে যেতে পারে সংস্কৃতি, কাজের সুযোগ এবং রাজনীতিও। কিন্তু এখন তেমনটিই ঘটছে। বিশেষ করে, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ক্রমাগত সহজ হয়েছে বলে ইন্টারনেটের ব্যাপ্তি বেড়েছে অনেক। যে কারণে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বা কোডিংয়ের গুরুত্ব বেড়েছে অনেক। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন দেশে ছোটবেলা থেকেই প্রোগ্রামিং শেখানোতে জোর দেওয়া শুরু হয়েছে।

প্রোগ্রামিং শিখে যে সবাই কম্পিউটার প্রোগ্রামার হবে, এমনটা সবাই ভাবছে না। বরং অ্যাপল কম্পিউটারের সহপ্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের মতো সবাই মনে করেন, সব স্কুলে প্রোগ্রামিং শেখানোর ব্যবস্থা থাকা দরকার। কারণ, এতে শিক্ষার্থীরা সমস্যা সমাধানে দক্ষ হয়ে ওঠে। আরও একটি কারণে ছোটবেলা থেকে প্রোগ্রামিংয়ের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেটি হলো বিশ্বজুড়ে কম্পিউটার প্রোগ্রামারের সংকট। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের হিসাবে, কয়েক বছর পরে বিশ্বে ১০ লাখ প্রোগ্রামারের পদ শূন্য থাকবে যোগ্য ও দক্ষ প্রোগ্রামারের অভাবে।

আজ থেকে ৩২ বছর আগে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে আবিষ্কার করেছিলাম, পলাশী, গুলিস্তান, সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে ধানমন্ডি ১৫ নম্বর বা শংকর বাসস্ট্যান্ডে রিকশায় শেয়ার করে যাওয়া যায়। রিকশা গণপরিবহন নয়, কিন্তু সে সময়েই গণপরিবহনে অনাগ্রহী মধ্যবিত্তকে সাশ্রয়ী পরিবহনের একটি সুযোগ দিতেন এই রিকশাচালকেরা। ওই শেয়ারিংয়ের সুযোগ নিতে আমাকে সশরীরে এই মোড়গুলোতে উপস্থিত থাকতে হতো। কিন্তু স্মার্টফোনের সহজপ্রাপ্যতা, লোকেশনের ডিজিটাল মানচিত্র আর আগ্রহী চালকের অবস্থান—এই তিন বিষয়কে প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে সমন্বিত করে তৈরি হয়েছে রাইড শেয়ারিংয়ের জনপ্রিয় অ্যাপ্লিকেশন উবার (www.uber.com)। যার মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে গণপরিবহনের বিকল্প বিশাল পরিবহন নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। পাঠাও, সহজের মতো রাইড শেয়ারিং সেবা আমাদের দেশেও এখন তৈরি হচ্ছে। আর এতে বসে নেই বিনিয়োগকারীরাও। উবারকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে দামি স্টার্টআপ, যার বাজারমূল্য ধরা হয় প্রায় ৭২ বিলিয়ন ডলার! আমাদের পাঠাও বা সহজ শতকোটি টাকার মাইলস্টোন পেরিয়েছে!

এসবই আসলে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্বজয়ের সামান্য নমুনা। আর খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বজয়ী প্রোগ্রামাররা তাঁদের প্রোগ্রামিংয়ের হাতেখড়ি নিয়েছেন ছোটবেলাতেই। সাত বছর বয়সে প্রথম প্রোগ্রামিংয়ে হাতেখড়ি হয় মার্ক জাকারবার্গের। বড় হয়ে মার্কের হাতে পত্তন ফেসবুকের। কাটাকুটির খেলা ‘টিক ট্যাক টো’র প্রোগ্রাম লিখেই সূচনা হয়েছে মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের প্রোগ্রামিং জীবন। প্রোগ্রামিং জটিল, কিন্তু এই আনন্দময় জগতে অবাধ বিচরণ করতে চাইলে শুরুটা করতে হয় ছোটবেলা থেকেই। গণিত, বিজ্ঞান ও ভাষাজ্ঞানের পাশাপাশি স্কুলশিক্ষার্থীদেরও তাই এখন কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে আগ্রহী করে গড়ে তোলা হচ্ছে।

একুশ শতকের জন্য অনেক রকমের দক্ষতা মানুষের জন্য প্রয়োজন। তার মধ্যে একটি হলো প্রোগ্রামিং বা কোডিং। স্টিভ জবস মনে করতেন, পৃথিবীর সব ছেলেমেয়েরই প্রোগ্রামিং শেখা উচিত। এ জন্য নয় যে প্রোগ্রামিং শিক্ষায় সে প্রোগ্রামার হবে, এ জন্য যে সমস্যার সমাধান করতে শেখায়। প্রোগ্রামিং শিক্ষায় আছে দুটি স্কিল। একটি হচ্ছে যুক্তির ব্যবহার এবং আরেকটি একটি বড় সমস্যাকে ভেঙে ভেঙে ছোট ছোট সমস্যায় পরিণত করে আলাদাভাবে সমাধান করে আবার সম্পূর্ণ সমাধান বের করা। এই যে বড় সমস্যাকে ভিন্নভাবে সমাধান করার চেষ্টা, তাকে ভেঙে ছোট ছোট সমস্যায় পরিণত করা এবং সেটিকে আবার একটি পূর্ণাঙ্গ সমাধানে পরিণত করা মানবসভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রধান কাজ। সেটার জন্যই সবারই কিছুটা হলেও প্রোগ্রামিং জানা উচিত।

বিশ্বজুড়ে এখন স্কুল পর্যায়ের প্রোগ্রামিং শেখানো হচ্ছে। গণিত, বিজ্ঞান, গান, ভাষার পাশাপাশি কোডিং শেখার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ জন্য যে এটার ফলে শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণভাবে যৌক্তিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। যুক্তিপূর্ণ মানুষ হওয়ার একটা বড় কারণ হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মোকাবিলা করা। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মোকাবিলায় এমন দক্ষতা প্রয়োজন হবে, যা মূলত রোবটরা পারবে না। রোবট পারে না এমন কাজের একটি হচ্ছে অজানা সমস্যাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে ভিন্নভাবে সমাধান করা। অকস্মাৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারা এবং যে পরিস্থিতিতে আগে সে সম্মুখীন হয়নি, সে ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারা। প্রোগ্রামিং শিক্ষা মানুষকে তেমনই একটি পরিবেশের সামনে দাঁড় করায়।

এখন কাজ মানেই সমস্যার সমাধান। গতানুগতিক ধারার কাজ কিন্তু এখন কমে যাচ্ছে। আর সমস্যা সমাধানের জন্য এখন গণিতের দক্ষতার পাশাপাশি কোডিং দক্ষতাও জরুরি হয়ে পড়েছে। কোডিংয়ের দর্শন হচ্ছে যেকোনো সমস্যাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে তা সমাধান করা, ছোট ছোট সমাধান জোড়া দিয়ে বড় সমাধানে পৌঁছানো। দুটো দক্ষতাই এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেকাংশ বাধ্যতামূলকও বটে।

আর যারা প্রোগ্রামিং শিখছে, তাদের বিকাশ বিশ্বমানের হচ্ছে কি না, তার জন্য বিশ্বব্যাপী আয়োজন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার। হাইস্কুলের (দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত) শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিয়াড ফর ইনফরমেটিকস (আইওআই) আর বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের জন্য রয়েছে এসিএম ইন্টারন্যাশনাল কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা আমাদের দেশেও প্রায় দুই দশক ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কিন্তু ছোটবেলা থেকে, বা শিক্ষার্থীদের জন্য দেশব্যাপী বড় আকারের প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা নেই বললেই চলে। ২০১৫-১৭ সালে সরকারিভাবে হাইস্কুল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা হলেও এ বছর সেটি আর হয়নি।

এসব কারণে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও প্রথম আলো মিলে আমরা আন্তস্কুল ও কলেজ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করছি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের সঙ্গে পরিচয় করানো। পাশাপাশি তারা যেন দলীয় কাজের অভিজ্ঞতা শেখে, সে জন্য আমাদের প্রতিযোগিতা হবে দলীয় ভিত্তিতে। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিসরে আমাদের হাইস্কুলের শিক্ষার্থীরা তাদের প্রোগ্রামিং প্রতিভার পরিচয় রেখেছে।
২০১২ সালে চট্টগ্রামের মেয়ে বৃষ্টি শিকদার (বর্তমানে গুগলে কর্মরত) আইওআইতে বিশ্বের হাইস্কুলের পর্যায়ের সব মেয়ের মধ্যে সেরা হয়েছে। কদিন আগে রাশিয়ার কাজানে হয়ে যাওয়া আইওআইতে বাংলাদেশ দল একটি রুপা ও একটি ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছে।

আর এসব সামনে রেখে সমস্যা সমাধানে পটু প্রজন্মের সন্ধানে আজ থেকে শুরু হচ্ছে ‘স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক-প্রথম আলো আন্তস্কুল ও কলেজ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা’। সমাধানের অগ্রদূত হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলে ‘কোড ভাঙা’ জবাব দিতে প্রতিযোগিতায় সবাইকে স্বাগত জানাই।

শুভ প্রোগ্রামিং।

মুনির হাসান সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি