বেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োপযোগী কথা বলেছেন চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন: ‘সভা-সমাবেশ বা বক্তব্যে জনমত সৃষ্টি হলেও এখন বেশির ভাগ বক্তব্যে অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা আলোচনা হয়। এসব দৃষ্টিকটু। এতে কোনো “আউটপুট” হয় বলে আমার মনে হয় না।’ এ সময় তিনি সব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ছোঁয়া এলেও সভা-সমাবেশকে ঘিরে কোনো পরিবর্তন আসছে না বলেও মন্তব্য করে বলেন, ‘দিনের আট ঘণ্টা হচ্ছে কর্মঘণ্টা। এর মধ্যে শুধু পাঁচ ঘণ্টা যদি বক্তব্য-সমাবেশের পেছনেই কাটিয়ে দিই, তাহলে কীভাবে হবে। আর বক্তব্য দিয়ে তো কোনো কিছু হয়ই না। সভা-সমাবেশগুলোতে প্রধান অতিথিকে খুশি করার জন্য বক্তারা ‘তেল মারেন’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একটি সমাবেশে যত লোক বক্তব্য দেন, আমি মনে করি, এটা শতভাগ গুরুত্বহীন।’
মেয়র আরও বলেন, ‘সব ক্ষেত্রেই পরিবর্তন হচ্ছে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু একটি জায়গায় আমরা কেন জানি খুব বেশি দৃষ্টি দিচ্ছি না। আবার এখানে কার নাম আগে বা পরে কিংবা বিশেষণ ঠিকমতো হচ্ছে কি না, সেটা নিয়েও চিন্তায় থাকতে হয় বক্তাকে।’ (দৈনিক আজাদী, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭)
খুব জরুরি একটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন মেয়র আ জ ম নাছির। এটা হয়তো দারিদ্র্য, শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের মতো কোনো জাতীয় ইস্যু নয়। কিন্তু আমাদের রাজনীতি, জাতীয় সংসদ, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সমাজ যেভাবে চলছে, তাতে উপরিউক্ত বক্তব্য খুবই প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়। মেয়র পদে নির্বাচিত হওয়ার পর দাপ্তরিক কারণেই তাঁকে হয়তো প্রতিদিন একটি বা একাধিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে হয়। অনুমান করি, বেশির ভাগই হয়তো সরকারি অনুষ্ঠান।
সরকারি অনুষ্ঠানে আগে আমলাদের বক্তৃতা করার রেওয়াজ ছিল না। এখন প্রতিটি সরকারি অনুষ্ঠানে আমলা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রতিষ্ঠানের প্রধান, কয়েক রকম বিশেষ অতিথি রাখতেই হয়। নইলে সভা পূর্ণ হয় না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির নাম কার্ডে ঠিকমতো লেখা হয়নি বলে অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে গেছে, এমন খবর পাঠক সংবাদপত্রে বহুবার পড়েছেন।
বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে যদি শুধু প্রয়োজনীয় কথাটিই বলা হয়, তাহলে অর্ধেক সময়ে অনুষ্ঠান শেষ করা সম্ভব। কিন্তু অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন ও স্তাবকতাধর্মী কথা বলতে বেশির ভাগ বক্তা পছন্দ করেন। সত্যি কথা বলতে কি, অর্থহীন কথা বলতে আমাদের জুড়ি নেই। সংক্ষেপে আমরা কথা বলতেই পারি না। ‘টু দ্য পয়েন্ট’ কথা বলা আমাদের ধাতে নেই। অনেকে সুযোগ পেলে ব্রিটিশ আমল থেকে বক্তৃতা শুরু করেন। অনুষ্ঠানে আরও কজন বক্তা রয়েছেন, আরও কী কী কর্মসূচি রয়েছে, তা আমরা খেয়াল করি না। প্রত্যেকের কাছে নিজের বক্তৃতাটিই গুরুত্বপূর্ণ।
বড় বড় সরকারি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথিরা যদি লিখিত ও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য বলেন, তাহলে অপ্রয়োজনীয় কথা বলার সুযোগ কম থাকে। লিখিত বক্তব্যে অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে অনেকেই সংকোচ বোধ করবেন। লিখিত বক্তব্যে স্তাবকতা করাও একটু কঠিন।
অনেক বক্তা রসিকতার নামে অর্থহীন কথা বলেন। সব অনুষ্ঠানে যে রসিকতা করা যায় না বা রসিকতা সুন্দর হয় না, তা অনেকে বুঝতে পারেন না। অনেক বক্তার মধ্যে একটা হীনম্মন্যতা কাজ করে। তা হলো: ‘যদি আমি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করি, তাহলে সভার উদ্যোক্তা বা অনেক শ্রোতা আমাকে কম জ্ঞানী মনে করতে পারে।’ এই কমপ্লেক্স থেকেও অনেক বক্তা অহেতুক ও অর্থহীন দীর্ঘ বক্তৃতা করে থাকেন। যাঁরা হীনম্মন্যতায় ভোগেন, তাঁদের জন্য একটা দৃষ্টান্ত দিই। খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী ড. আনিসুজ্জামান যেকোনো সভায় অন্য বক্তাদের তুলনায় অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন এবং সভার বিষয় সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটি তিনিই বলেন। কাজেই বক্তৃতা সংক্ষিপ্ত হলেই যে বক্তৃতায় সারবস্তু কম থাকে, তা নয়। বক্তৃতার সারবস্তু নির্ভর করে বক্তার প্রস্তুতির ওপর। অনুষ্ঠানের বা সেমিনারের বিষয়বস্তু সম্পর্কে বক্তা কতটা ভেবেছেন। এ ব্যাপারে বক্তার কোনো নতুন বক্তব্য আছে কি না। অনুষ্ঠান যদি সমস্যাকেন্দ্রিক হয়, তাহলে দেখতে হবে, এ ব্যাপারে বক্তার কোনো সমাধান-প্রস্তাব আছে কি না।
কোনো আন্তর্জাতিক বা জাতীয়ভিত্তিক সভা-সম্মেলনে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথিদের লিখিত বক্তৃতা করাই ভালো। তাতে সুচিন্তিত বক্তৃতা করার সুযোগ থাকে এবং সময়ও কম লাগে।
আমাদের জাতীয় সংসদের অধিবেশনে কী ধরনের বক্তৃতা হয়, কী-বিষয়ক অধিবেশনে কী ধরনের বক্তৃতা হয়, তা নিয়ে একটা ভালো গবেষণা করার সুযোগ রয়েছে। জাতীয় সংসদে প্রদত্ত বক্তৃতা কিছু কঠোর নিয়মের মধ্যে রাখা উচিত। কারণ, জাতীয় সংসদের একটি অধিবেশন খুবই ব্যয়সাপেক্ষ। আর এই ব্যয় বহন করা হয় দেশের সাধারণ মানুষের কর থেকে। সে জন্য আমরা প্রস্তাব করব: জাতীয় সংসদের একটি মৌসুমের সব কটি অধিবেশনের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করে তা পর্যালোচনা করা যেতে পারে। একটি দলনিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ বা গবেষক টিম তা পর্যালোচনা করে দেখতে পারে।
আমরা এই আলোচনায় রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সভা নিয়ে কোনো মন্তব্য করছি না। কারণ, এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। তাদের নিজস্ব খরচে এসব সভার আয়োজন করা হয়। শ্রোতারাও তাদের দলের। কাজেই তাদের সভায় তারা যেমন খুশি বক্তৃতা করুক, তা নিয়ে কারও কিছু বলার থাকতে পারে না। শুধু একটি পর্যবেক্ষণ। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর তেমন টার্গেট কর্মসূচি বা ক্যাম্পেইন আছে বলে মনে হয় না। সরকারি দল প্রধান বিরোধী দলকে, প্রধান বিরোধী দল সরকারের নানা সমালোচনা করে থাকে। এটা তাদের রুটিন কাজ। তাদের দলের যেকোনো সভা-সেমিনারে বক্তৃতার এটাই প্রধান বিষয়বস্তু। সঙ্গে যুক্ত থাকে দলপ্রধানের প্রতি কিছু স্তাবকতা।
আমরা দাবি করে থাকি, আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। আমরা আর কয়েক বছরের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হব। সবই সত্যি। তাহলে আমাদের রাজনীতিতে, জাতীয় সংসদের বিতর্কে, সরকারি সভা-অনুষ্ঠানে গুণগত পরিবর্তন আনতে আমরা অনাগ্রহী কেন? দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের অনেক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে। বক্তৃতার ব্যাপারেও আমাদের সনাতন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা দরকার। অর্থহীন কথা বলে সময় নষ্ট করার সময় আমাদের নেই। কথাকে সংক্ষিপ্ত করতে হবে। কথাকে অর্থপূর্ণ করতে হবে। যদি আমরা তা করতে পারি, তাহলে এর সুফল একদিন আমরাই ভোগ করব।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।