মতামত

সবুজ প্রযুক্তির হাওয়ায় ভাসবে ২০২২ সাল

ইয়াসির আজমান
ইয়াসির আজমান

টেকনোলজি ট্রেন্ডস প্রযুক্তিপ্রবণতা আমাদের যেমন ভবিষ্যৎ আর পরিবর্তন সম্পর্কে ধারণা দেয়, তেমনি একই সঙ্গে ভবিষ্যতের সুযোগ, সম্ভাবনা আর চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করে। টেলিনর আর গ্রামীণফোন থেকে আমরা বেশ কিছুদিন ধরে বলে আসছিলাম অনলাইন নিরাপত্তা, ফেক নিউজ কিংবা ডিপ ফেকের মতো প্রবণতার কথা। অনেক ভালো লাগে যখন দেখি, আমাদের সেই পূর্বাভাসগুলো নিয়ে এখন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অনেক কাজ হচ্ছে, মানুষের সচেতনতা বাড়ছে এবং এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এ বছরও আমরা টেলিনরের সহায়তায় ২০২২ সালের ‘টেক ট্রেন্ডস’ বা প্রযুক্তি নিয়ে গ্রামীণফোন থেকে এ পূর্বাভাসগুলো প্রকাশ করেছি। এ বছর টেক ট্রেন্ডস মূলত জলবায়ু পরিবর্তন আর ভবিষ্যতের নেতৃত্ব নিয়ে কথা বলে। এবারের টেক ট্রেন্ডসের প্রতিবেদনে প্রযুক্তি ও ডিজিটালাইজেশন কীভাবে সবুজ রূপান্তরে ভূমিকা রাখতে পারে, সে বিষয় উঠে এসেছে, যা আমাদের সত্যিকার অর্থেই আশাবাদী করে তুলেছে যে কীভাবে প্রযুক্তি সামনের দিনগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহায়তা করতে পারে এবং সব মিলিয়ে আমাদের জীবনধারণকে আরও নিরাপদ করে তুলতে পারে।

কীভাবে নতুন যুগের উন্নত কানেকটিভিটি, জলবায়ুবান্ধব শক্তিসাশ্রয়ী আধুনিক হার্ডওয়্যার, এজ ক্লাউড ও ফাইভ-জি প্রযুক্তি আরও পরিবেশবান্ধব হবে এবং এর ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রিন জব স্কিলসের চাহিদা এবং ডিজিটাল লার্নিং প্ল্যাটফর্মগুলোর ক্লাইমেট মাইক্রো ডিগ্রি দেওয়ার বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, যা ঘিরে এ বছরের টেক ট্রেন্ডস সাজানো হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শক্তিসাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব ডিভাইস তৈরির ক্ষেত্রে সুস্থ প্রতিযোগিতা ও প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে এবং তরুণদের মধ্যে জলবায়ুসচেতন ইনফ্লুয়েন্সারের সংখ্যা ও তাদের জনপ্রিয়তা বাড়বে। চলমান বৈশ্বিক মহামারি ও এর ফলাফলের ওপর ভিত্তি করেই এ পূর্বাভাসগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে।

পূর্বাভাসগুলোর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে গ্রিন ক্লাউড নিয়ে সম্ভাবনার কথা। ডেটা বা উপাত্তের ব্যবহার বহুগুণে বৃদ্ধির কারণে বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, পৃথিবীজুড়েই উপাত্ত সংরক্ষণ একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ বিষয়ে ধারণা পেতে একটি তথ্যই যথেষ্ট, যা হলো পৃথিবীতে যত বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়, তার অন্তত ১ শতাংশ ব্যবহৃত হয় শুধু ডেটা সংরক্ষণে। এখন আমরা ছোট ডিভাইস, যেমন মুঠোফোনেও ক্লাউডের ব্যবহার দেখছি। ক্লাউড সেবাদানে আমাজন সব থেকে বেশি এগিয়ে আছে। এ কারণে বিষয়টি আমাজনের একটি উদাহরণ দিয়ে স্পষ্ট করা যাক। আমাজন ওয়েব সার্ভিসের আয় ২০১৪ সালে ছিল ১০০ কোটি মার্কিন ডলার, যা ২০২১ সালে এসে বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে, ক্লাউডের ব্যবহার কী পরিমাণে বেড়েছে। আবার ডেটার ব্যবহার কী পরিমাণে বেড়েছে, সেটা ধারণা করা যায় এ তথ্য দিয়ে—বিশ্বের প্রায় অর্ধেক ওয়েব ট্রাফিক ব্যবহার করে মোবাইল ডিভাইস (ট্যাবলেট বাদে)। ২০১৭ সালে প্রতি মাসে এ ওয়েব ট্রাফিক ছিল ১১ এক্সাবাইট (এক বিলিয়ন গিগাবাইট), যা ২০২১ সালে প্রতি মাসে এসে দাঁড়িয়েছে ৬০ এক্সাবাইট। ধারণা করা হচ্ছে ২০২২ সালের শেষে এটি ৮০ এক্সাবাইটে পৌঁছাবে। আশার কথা হচ্ছে ক্লাউডের ক্ষেত্রে জ্বালানির যে ব্যবহার এজ কম্পিউটিং, এজ ক্লাউড ও ফাইভ-জি প্রযুক্তির দ্রুত ডেটা ট্রান্সফার একসঙ্গে তা কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে।

পৃথিবীতে এখন সবকিছুই ছোট হয়ে আসছে, সবকিছুর অপটিমাইজেশনের বিষয়টি রয়েছে তৃতীয় পূর্বাভাস হিসেবে। বর্তমানে পৃথিবীতে যত মানুষ আছে, তার থেকে চার গুণ বেশি ইলেকট্রিক ডিভাইস আছে, যা সামনে আরও বাড়বে। যেসব হার্ডওয়্যার অনেক জ্বালানি ব্যবহার করে, তাদের বিপরীতে ইতিমধ্যেই জ্বালানিসাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হার্ডওয়্যার বা চিপসেট ব্যবহারের সম্ভাবনার কথা আমরা শুনেছি। সম্প্রতি অ্যাপল বাজারে নিয়ে এসেছে এম ১ চিপ। এই চিপযুক্ত ডিভাইস আগের তুলনায় কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে, কিন্তু কাজের সক্ষমতায় কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। এই এম ১ চিপের যে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ, তা চিপসেট নির্মাতাদের মধ্যে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি করেছে। সবাই কিন্তু এখন জ্বালানিসাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব চিপসেট তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছে। ভবিষ্যতে ডিভাইসগুলোর মধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে, যা অনেক বেশি বিদ্যুৎ বা শক্তি ব্যবহার করবে। এ ক্ষেত্রে আমরা যদি সাশ্রয়ী চিপসেট ব্যবহার করতে না পারি, তবে এটা পরিবেশের জন্য আরও ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে।

কোভিডের মধ্যে যে তরুণ প্রজন্ম প্রথম করপোরেটে যোগ দিলেন, তাঁরা বাসা থেকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কাজ করে বুঝতে পারছেন না কাজের আসল দুনিয়া কেমন হয়, কীভাবে সহকর্মীদের সঙ্গে মিশতে হয়, নেটওয়ার্কিং করতে হয় এবং তাঁদের কাছ থেকে সহযোগিতা চাইতে হয়। আমাদের মতো যারা লিডারশিপ রোলে আছি, তাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ আমাদের এই প্রজন্মের তরুণ করপোরেটদের জন্য কাজের পরিবেশ তৈরি করা।

বাংলাদেশ জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এনভায়রনমেন্টাল জাস্টিস ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে, শুধু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রতি সাতজনের একজন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হবেন বড় দাগে বলতে গেলে প্রায় ১৮ মিলিয়ন মানুষ। ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন থেকে উত্তরণে আমরা প্রযুক্তিকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। প্রযুক্তিগত বিপ্লব টেকসই ভবিষ্যৎ সম্ভব করে তুলবে, তবে এর পাশাপাশি সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি খাতের সম্মিলিত প্রচেষ্টাও গুরুত্বপূর্ণ। এ বছর টেক ট্রেন্ডস আমাদের সামনে তুলে ধরেছে, আমরা কীভাবে প্রযুক্তি ও ডিজিটাল রূপান্তরকে কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব করে তুলতে পারি। প্রতিষ্ঠানে দক্ষ ও সময়োপযোগী নেতৃত্বের অনুশীলনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারি। গ্রামীণফোন যেমন লক্ষ্য নিয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৫০ শতাংশ হ্রাস করার। তা হয়তো রাতারাতি অর্জন করা সম্ভব নয়। যাত্রাটা হবে দীর্ঘ ও কঠিন, কিন্তু সবাই একসঙ্গে মিলে আনতে পারি পরিবর্তন, এগিয়ে যেতে পারি সবুজ আগামীর দিকে, রেখে যেতে পারি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই পরিবেশবান্ধব পৃথিবী।

ইয়াসির আজমান গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী