কারাবন্দী অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেমন ক্ষোভের ঝড় তুলছে তেমনি বাইরেও চলছে জোরেশোরে প্রতিবাদ। হয়তো আরও জোরে সমবেত চিৎকারটিই এই মুহূর্তে জরুরি।
তবে তার চেয়ে বড় শক্তি আমাদের চিৎকার করার স্বরটিও আজ সরব নেই। কণ্ঠ রুদ্ধ। এই রুদ্ধতাকে ভাঙতে চেয়েছিলেন মুশতাক আহমেদ। পরশু রাত থেকে যে অল্পস্বল্প ঝড় উঠেছে, সেটিকে সামাল দিতেই, এই প্রতিবাদকে ঠেকাতে রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীকে হামলা করতে হয়েছে। সেই হামলায় আহত হয়েছেন বাম সংগঠনের বেশ কয়েকজন কর্মী। সংবাদমাধ্যমগুলোও অনেকখানিই সরব এই বিষয়ে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় কারাগারে এই লেখকের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবেই দেখছেন অনেকেই। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে এর আগেও ২০১৩ সালে চারজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করে মানুষের চিন্তা ও বাক্স্বাধীনতা বিষয়ে সরকারের অসহিষ্ণু অবস্থানকে স্পষ্ট করে। এরপর চলতে থাকে এর ধারাবাহিকতা। কখনো ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে খুশি করতে আবার কখনো নিজেদের দোষ ঢাকতে সরকার বেছে নেয় ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মতো হাতিয়ার।
গত বছরের মে মাসে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদকে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের অপরাধ ছিল ‘আমি কিশোর’ ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে সে সময় দেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সরকারের ভূমিকার সমালোচনা নিয়ে বিভিন্ন কার্টুন এঁকেছিলেন কার্টুনিস্ট কিশোর এবং সেগুলো তাঁর ওয়ালে পোস্ট করেছেন। আর লেখক মুশতাক আহমেদ তাঁর ফেসবুক ওয়ালে কিশোরের সেসব কার্টুনের কয়েকটি শেয়ার করেছিলেন। এগুলোকে বলা হচ্ছে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ।
এরপর গ্রেপ্তার হয়েছেন দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রয়াত মো. নাসিমকে নিয়ে সমালোচনামূলক পোস্ট দেওয়ায় একই আইনে এখনো গ্রেপ্তার আছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক। এর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষকও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে সমাবর্তন দিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার কারণে এই কালো আইনের শিকার হন।
আমি যখন মুশতাক আহমেদকে নিয়ে পড়ছিলাম, তখন একভাবে নিজেকেই দেখছিলাম। নিজের ফেসবুক ঘেঁটে দেখলাম, গত এক বছরে আমি নিজের প্রকাশিত লেখা ছাড়া খুব বেশি কিছু শেয়ার দিইনি। কারণ ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলার ভয়। আমরা জানি না কে কখন আমার বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা করবে। অনেকেই অনেক কিছু ইনবক্সে পাঠান, অনেক লেখাতে ট্যাগ করেন, আমি সেগুলোও খুব একটা অ্যাপ্রুভ করি না।
আমাদের ভয় ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলার, হয়রানির এবং হেনস্তার। আমাদের কথা বলার স্বাধীনতা নেই, মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা নেই। কথা বললেও মুক্তভাবে কতটুকু বলতে পারছি আমরা?
এমনকি শিক্ষার্থীরা বারবার লেকচার রেকর্ড করার কথা বললেও আমরা অনেকেই সে বিষয়ে নিশ্চুপ ছিলাম এবং যত দূর মনে পড়ে শুধু আমি নই, আমাদের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষকদের অনলাইন সভায় অনেক শিক্ষকই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়ের কথা জানিয়ে ক্লাস লেকচার রেকর্ড করার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। আমরা আসলেই সবাই যাঁর যাঁর মতো করেই জেলখানাতেই আছি।
আমাদের অনেকেই এখন আর কথা বলতে চান না। কেন চান না? এ ক্ষেত্রেও দুটো গ্রুপ আছে। একটি গ্রুপ আছে যারা মনে করে এতে তাদের কাঙ্ক্ষিত পদ ছাড়তে হবে কিংবা তারা রাজনৈতিকভাবে সুনজরে থাকবে না।
আর আমাদের ভয় ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে মামলার, হয়রানির এবং হেনস্তার। আমাদের কথা বলার স্বাধীনতা নেই, মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা নেই। কথা বললেও মুক্তভাবে কতটুকু বলতে পারছি আমরা?
এত দিন আমাদের অনেকেই উগ্রপন্থীদের হুমকি-ধমকিতে ছিলেন, এখন যুক্ত হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের থাবা। লেখকেরা সন্ত্রাসী নন, তাঁরা শুধু লেখেন। মতপ্রকাশ করেন। সেই মতো কারও সঙ্গে মিলতে পারে, না-ও পারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুশতাক আহমেদকে নিয়ে বলেছেন, তিনি অন্যের বিশ্বাসের প্রতি আঘাত করে লিখতেন। এ জন্য তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটা মামলা ছিল। বিশ্বাস তো সবার একই রকম হবে না। কারও লেখায়, কারও বিশ্বাসে আঘাত লাগলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করতে হবে? তাহলে তো দেশশুদ্ধ শুধু জেলখানাই বানাতে হবে।
জোবাইদা নাসরীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।
zobaidanasreen@gmail.com