সবাইকে ঢাকায় ছুটতে হয় কেন

নানা কাজে ঢাকায় শিল্প, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রাজস্ব বোর্ডে ছোটাছুটি করতে হয় বলে রাজধানীমুখী হতে বাধ্য হন শিল্পোদ্যোক্তারা।
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

১৯৯৩ সালে যে তরুণটি বাবা ও ভগ্নিপতির কাছ থেকে চেয়েচিন্তে এক লাখ টাকার পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন, তাঁর ব্যবসায় এখন ১৫০ কোটি টাকার লেনদেন। চট্টগ্রামের মুরাদপুর এলাকায় ছোট্ট একটি কারখানা দিয়ে যে ব্যবসাটির শুরু, সেটি এখন ঢাকা-চট্টগ্রাম মিলিয়ে মোট প্রায় আড়াই লাখ বর্গফুট জায়গায় তিনটি কারখানা নিয়ে পরিপূর্ণ একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

সাফল্যের গল্প যত সহজে মানুষকে চমৎকৃত বা উদ্বুদ্ধ করে, সেই গল্পটা তত সহজে রচিত হয় না। সৈয়দ নাসিরের ক্ষেত্রেও হয়নি। এক্সক্লুসিভ ক্যান লিমিটেডের এই স্বত্বাধিকারীকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে অনেক এবড়োখেবড়ো পথ, অনেক দুঃসহ স্মৃতি।

অবশ্য এসব স্মৃতি মনে করে তিনি ভারাক্রান্ত হতে রাজি নন; বরং রাজধানীর টঙ্গীর মাজুখান (শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে) এলাকায় পাঁচতলা কারখানা ভবনে প্রধান নির্বাহীর চেয়ারে বসে একটি প্রশ্ন তাঁর মনে এখনো ঘুরপাক খায়, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ যেকোনো উদ্যোগে সাফল্যের জন্য সবাইকে ঢাকা শহরে ছুটতে হয় কেন? কেন চট্টগ্রামে থাকাকালে তাঁর উদ্যোগটি মুখ থুবড়ে পড়েছিল?

দেশের জেলা শহরগুলো আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গুরুত্ব হারাচ্ছে। আর সারা শরীরের রক্ত মুখে এসে জমা হলে তো অসুস্থতা অনিবার্য, তাই ঢাকা শহর ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বাসযোগ্যতার নিরিখে এই শহরের বর্তমান অবস্থান তো সেই ইঙ্গিতই দেয়

অন্তরঙ্গ আলাপের মুহূর্তে এই প্রশ্ন বর্তমান নিবন্ধকারের দিকে ছুড়ে দিয়েছিলেন সৈয়দ নাসির। তাঁর এই প্রশ্ন, আরও বেশ কিছু প্রশ্ন, আরও অনেক ক্ষোভ, হতাশা ও ব্যর্থতার দিকেই আঙুল তোলে।

যত অগৌরবেরই হোক, এ কথা অস্বীকার করার উপায় তো নেই যে সারা বিশ্বের বসবাসের অনুপযোগী শহরগুলোর তালিকায় ঢাকার নাম থাকে ওপরের দিকে। অথচ ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থানসহ যেকোনো ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠা লাভের জন্য ঢাকামুখী মানুষের স্রোত থামছে না। ঢাকার ধারণক্ষমতা প্রায় নিঃশেষ; ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল প্রভৃতি নানা উদ্যোগ আয়োজন করেও এর গতি বাড়ানো যাবে, এমন ভাবারও সুযোগ নেই। তবু মানুষ ছুটছে, সবার গন্তব্য ঢাকা। কেন?

শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যের কথাই যদি বলি, চট্টগ্রামকে ‘আদর’ করে বলা হয় বাণিজ্যিক রাজধানী। ২০০৩ সালে এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেয়েছিল। দেশের আমদানি-রপ্তানির ৯৩ শতাংশ পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। দেশের প্রথম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলও (সিইপিজেড) গড়ে উঠেছিল এই চট্টগ্রামেই। কিন্তু সেই চট্টগ্রাম নব্বইয়ের দশক থেকে গুরুত্ব হারাতে শুরু করল সরকারের ভুল নীতির মাশুল দিয়ে।

বন্দর-সুবিধার কারণে চট্টগ্রামকে একটি পরিকল্পিত বাণিজ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ প্রাকৃতিক দিক থেকেই ছিল। তাই তৎকালীন পাকিস্তান আমলেই একদিকে আমদানি করা ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার হয়ে উঠেছিল খাতুনগঞ্জ, অন্যদিকে ইস্পাহানি গ্রুপ, আল করিম পেইন্ট, এলিট পেইন্টের পাশাপাশি ইউনিলিভার, বার্জার, রেকিট বেনকিজার, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, গ্ল্যাক্সো, সিঙ্গার, হোয়েস্টের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের কারখানা এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয় গড়ে তুলেছিল চট্টগ্রামে। কিন্তু গত মাত্র দুই দশকের ব্যবধানে সব কটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম থেকে তাদের কার্যক্রম স্থানান্তর করেছে ঢাকায়। খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারও হারিয়েছে তার জৌলুশ ও প্রাচুর্য। দেশের প্রথম গার্মেন্টস কারখানার (দেশ গার্মেন্টস) যাত্রা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। কিন্তু আজ অধিকাংশ বৃহৎ গার্মেন্টস কারখানার কার্যক্রম ঢাকায়।

চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে কাঁচামাল আসে, সেই কাঁচামাল ঢাকায় নিয়ে পণ্য উত্পাদনের পর আবার চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই যদি রপ্তানি হয়, তাহলে উত্পাদনপ্রক্রিয়াটি ঢাকায় সম্পন্ন হলো কেন—এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই আছে সরকারি ভুল নীতিমালা বা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বিষয়গুলো।

বস্তুত শিল্পোদ্যোক্তাদের নানা কাজে ঢাকায় শিল্প, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রাজস্ব বোর্ডে ছোটাছুটি করতে হয়। চট্টগ্রামে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা আছে, কিন্তু বড় সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। কোনো ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে নেই। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের শাখা কার্যালয় থাকলেও ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা নেই। শিল্প কারখানার উত্পাদিত পণ্য বা আমদানি পণ্যের মান পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) কার্যালয়ও চট্টগ্রামে আছে, কিন্তু এই সংস্থার তালিকাভুক্ত অধিকাংশ পণ্যের পরীক্ষা ও লাইসেন্স নিতে তাকিয়ে থাকতে হয় ঢাকার দিকেই। অনেক ক্ষেত্রে বন্দরে পণ্য পড়ে থাকলেও ঢাকা থেকে পরীক্ষার প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত পণ্য ছাড় করা হয় না। এ রকম কেন্দ্রমুখিতার তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়। তাতে ‘প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ’ শব্দবন্ধ কতটা অকার্যকর, তা বোঝা সহজ। এত প্রতিকূলতার মুখে বড় ও বহুজাতিক কোম্পানিগুলো কেন ঢাকার বাইরে পড়ে থাকবে।

শুরু করেছিলাম সৈয়দ নাসিরের সাফল্যের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে। চট্টগ্রামে ব্যবসা করতে গিয়ে শুরুতেই বড় একটি ধাক্কা খেয়েছিলেন তিনি। রং উত্পাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠান বার্জারের ভেন্ডর হিসেবে কাজ করতেন। এই প্রতিষ্ঠানে কৌটা সরবরাহ করে মোটামুটি লাভের মুখ দেখছিলেন। কিন্তু বার্জার তাদের কার্যালয় ও কারখানা ঢাকায় স্থানান্তর করলে প্রায় পথে বসেন তিনি। মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন আরও কিছুদিন। কিন্তু অনন্যোপায় হয়ে ঢাকায় গিয়ে নব-উদ্যমে ব্যবসা শুরু করার পর ৩৯টি প্রতিষ্ঠানে রং, আইসক্রিম, লুব্রিকেন্ট, ওষুধ এবং খাদ্যদ্রব্যের কৌটা সরবরাহ করে এই ব্যবসায় সম্মুখসারির একজন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। সবার গল্প নিশ্চয় নাসিরের মতো নয়। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে নানা ধরনের মালামাল সরবরাহের ব্যবসায় জড়িত ছিলেন এমন অনেকেরই পরিণতির কথা আমরা জানি না। অনুমান করতে পারি।

ঢাকায় গেলেই সফল হওয়া যাবে, এমন নয়। কিন্তু কপাল ঠুকতে হলে ঢাকায় যেতে হবে—অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে এমনই। যেমন সৈয়দ নাসির একজন গৃহকাতর (হোমসিক) ধরনের মানুষ। চেয়েছিলেন নিজের আজন্ম আবাসস্থলেই থাকবেন সপরিবার। কিন্তু তাঁকে একসময় চট্টগ্রামের পাট চুকিয়ে পুরো পরিবার নিয়ে নতুন বসতি করতে হয়েছে ঢাকায়। আলাপকালে নিজেই বলছিলেন, ‘গ্রিন লাইনের একটি বাসে চেপে চট্টগ্রাম ছেড়ে আসার সময় আমার পরিবারের সবাই কাঁদছিল।’

এভাবে দেশের জেলা শহরগুলো আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে গুরুত্ব হারাচ্ছে। আর সারা শরীরের রক্ত মুখে এসে জমা হলে তো অসুস্থতা অনিবার্য, তাই ঢাকা শহর ক্রমেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বাসযোগ্যতার নিরিখে এই শহরের বর্তমান অবস্থান তো সেই ইঙ্গিতই দেয়।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক

bishwabd@yahoo.com