সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আজকাল অনেককে লিখতে দেখা যায়, ‘সবকিছু মনে রাখা হবে’।
‘সব ইয়াদ রাখখা জায়েগা’ শিরোনামে গত বছর বিহারের আমির আজিজের কবিতা ভারতে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছিল। পরে রজার ওয়াটারের কণ্ঠ হয়ে সেটা বিশ্বজুড়ে বাড়তি উদ্দীপনা সঞ্চার করে। কিন্তু বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘সবকিছু মনে রাখা হবে’ আওয়াজ ভবিষ্যতের জন্য মৃদু ভয়েরও ইঙ্গিত দেয়।
কী বলতে চান এই ভাবুকেরা? এটা কি হুমকি? কাকে? জুলুমকারীদের? এটা কি তবে জুলুমকারীদের ওপর জুলুমের হুমকি? তাহলে দিন শেষে ভবিষ্যতে আমরা কী পাব?
প্রথমেই বলে রাখা দরকার, ‘সবকিছু মনে রাখা হবে’—এ রকম ভাবনা মোটেই অক্ষমের ক্ষোভ নয়, যেটা কেউ কেউ বলেছেন। দুনিয়ায় কেউ অক্ষম নন। মানুষকে কেবল ‘অক্ষম’ ভাবানো হয় মাত্র। কাউকে অক্ষম ও ব্যর্থ ভাবা চলমান ‘অমানবিকীকরণ’ প্রক্রিয়ারই একটা ফল।
মানুষ সব সময় জুলুম প্রতিরোধ করতে পারে না। ব্যক্তি ও সমষ্টিগত দুই স্তরেই সেটা হয়। এটা কোনো অক্ষমতা নয়। সাময়িক ব্যর্থতা। ‘সবকিছু মনে রাখা হবে’—এটা ভাবার মানে এটাও যে মানুষ জুলুম মেনে নিচ্ছে না। জুলুম মেনে না নেওয়ার বোধ, জুলুম প্রত্যাখ্যানের চেতনা দেখায়, মানুষের সত্তা অক্ষম নয়—প্রচণ্ডভাবে সক্রিয়। তাঁদের সত্তার ভেতর মানবিকতার বোধ এখনো মরেনি।
কিন্তু জুলুমের শিকার মানুষ কী করবে? কী করা উচিত? সুযোগ পেলে তারাও কি জুলুমের মাধ্যমেই প্রতিশোধ নেবে?
হ্যাঁ, তাদের সেটাই শেখানো হয়। এই শিক্ষাটাও চলতি বিমানবিকীকরণেরই আরেক পার্শ্বফল। মানুষ যে জুলুম করে এবং জুলুমের শিকার মানুষ যে জুলুমের মাধ্যমেই বদলা নিতে চায়, উভয়ই বিমানবিকীকরণের কারণে। এরা উভয়ে একই ‘কাঠামো’র শিকার। আমাদের সামাজিক কাঠামোতে পারস্পরিক সম্পর্কগুলো নির্যাতনমূলক, কর্তৃত্বমূলক, নিপীড়ক। এ রকম যেকোনো সম্পর্কই সহিংস সম্পর্ক। এ রকম সম্পর্কে একজনের ‘ক্ষমতা’ থাকে, অপরের সেটা থাকে না—পার্থক্য এটুকু। কিন্তু তারা উভয়ে সহিংসতার সম্পর্কের বলি এবং মানবতাহীন বিকৃত অবস্থার শিকার।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাঁরা এখন বলছেন, ‘সব মনে রাখা হবে’, তাঁরা নিশ্চয়ই এমন ভবিষ্যৎ চাইছেন না, যেখানে কাউকে নির্যাতনের কাজই তাঁরা করবেন। যদি তা-ই হয়, তাহলে এমন এক সমাজ লাগবে, যেখানে চরিত্র হিসেবে ‘নির্যাতক’ থাকবে না, যেখানে অত্যাচারী হওয়ার সুযোগ কেড়ে নেওয়া হবে।
যারা জুলুম করছে এবং ভাবে, জুলুমের মাধ্যমে কেবল ‘ক্ষমতা’ রক্ষা করা যায়—তারাও বিমানবিকীকরণ বিকৃতির শিকার। সামাজিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কগুলো তাদের এভাবে তৈরি করে। এই তৈরির কাজ প্রতিনিয়ত চলমান। তার পুনরুৎপাদনও হচ্ছে। ক্রোধের ঘোরে সেখানেই মুক্তি খুঁজলে বিপদ। এভাবে ভুলের মধ্যে মুক্তি খোঁজা হয় বলেই হয়তো মুক্তি আর আসে না। কেবল ‘ক্ষমতা’র পালাবদল ঘটে। ‘ব্যক্তি’ পাল্টায়। সঙ্গে জুলুম কেবল বাড়ে।
জুলুমের টেকসই বদলা নেওয়া যায় মানবিকীকরণের সর্বাত্মক অভিযানে নেমে। কিন্তু জুলুমের তীব্রতা ও ভয়াবহতা ওই বিকল্পের কথা ভুলিয়ে দেয়।
জুলুমের তীব্রতা ও ভয়াবহতা মজলুমকে কেবল একই ধাঁচের প্রতিশোধের জন্য ডাকে। দীর্ঘকাল উপনিবেশধর্মী শাসন ও শিক্ষায় মানুষের মধ্যে নির্যাতক মনস্তত্ত্বই কেবল তৈরি হয়। এ রকম শাসন-সংস্কৃতি মানুষকে কখনো ভাবতে দেয় না, নির্যাতন ও সহিংসতামুক্ত সমাজ সম্ভব। তারা বরং পাল্টা নির্যাতনের আকাঙ্ক্ষার ভেতর ‘নতুন সমাজ’ গড়ার কথা ভাবে। এ রকম পরিবর্তন ও চিন্তার ভেতর ভরকেন্দ্র হিসেবে থাকে প্রতিশোধের ইচ্ছা। নির্যাতনমুক্ত মানবিক সমাজ গড়ার অভিলাষ নয়।
অথচ একমাত্র উল্টো পথে নাগরিকেরা নির্যাতনমূলক সামাজিক সম্পর্ক বদলাতে পারে। নির্যাতনের কাঠামো ধ্বংস করার প্রতিজ্ঞা ছাড়া নির্যাতিতেরা কোনোভাবেই চূড়ান্ত জুলুম থেকে নিস্তার পায় না। এটা সেই পথ, যার মাধ্যমে নির্যাতিতেরা নিজেদের এবং একই সঙ্গে জুলুমকারীকেও নির্যাতক মানসিকতা থেকে মুক্ত করে। নির্যাতক মানসিকতা মোটা দাগের অসুস্থতা। এই অসুস্থতা থেকে নির্যাতকেরও মুক্তি প্রয়োজন। পাওলো ফেইরিসহ বহু পণ্ডিত এর সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
এই কাজ একটা রূপান্তর প্রক্রিয়া। চারদিকে যে ‘পরিবর্তন’-এর কথা শোনা যায়, এটা নিশ্চয়ই সেই পরিবর্তন, যেখানে অঙ্গীকার থাকে সমাজ থেকে নিপীড়ন ও সহিংসতা তাড়ানো। তাকে সমূলে নির্মূল করা। একজন প্রকৃত পরিবর্তনবাদী বিশেষ কারও জন্য নির্যাতন ও সহিংসতার পদ্ধতি রেখে দেওয়ার কথা ভাববে না। এটা কোনো জুলুমবিরোধীর কর্মসূচি হতে পারে না। এভাবে কখনো ‘পরিবর্তন’ আসে না, বরং এটা দুষ্টচক্রের মতো, যা সমাজে সহিংসতা ও নিপীড়ন ডেকে আনে—বারবার।
সুতরাং আজকে যারা নিপীড়িত, জুলুমের শিকার, ক্ষমতাহীন, তাদের জন্য ‘ক্ষমতাবান’ হওয়ার চেয়েও জরুরি ভবিষ্যতে ক্ষমতাচর্চার নতুন নিয়মনীতি তৈরি। ‘ক্ষমতা’র নতুন সংজ্ঞা দেওয়া। যখন ক্ষমতার কাছে নির্ভয়ে প্রশ্ন করা যাবে, তর্ক করা যাবে, ভিন্নমত প্রকাশ করা যাবে। যেখানে ক্ষমতা হবে স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার ইঞ্জিন, যেখানে ক্ষমতা ভীতি ছড়াবে না।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাঁরা এখন বলছেন, ‘সব মনে রাখা হবে’, তাঁরা নিশ্চয়ই এমন ভবিষ্যৎ চাইছেন না, যেখানে কাউকে নির্যাতনের কাজই তাঁরা করবেন। যদি তা-ই হয়, তাহলে এমন এক সমাজ লাগবে, যেখানে চরিত্র হিসেবে ‘নির্যাতক’ থাকবে না, যেখানে অত্যাচারী হওয়ার সুযোগ কেড়ে নেওয়া হবে। অত্যাচারী হওয়ার সুযোগ সমাজে অসম্ভব করে তোলা হবে আইনগতভাবে, শিক্ষাগতভাবে ও কাঠামোগতভাবে। সব সম্পর্ক থেকে আধিপত্যের সুযোগ সরিয়ে ফেলা হবে। আধিপত্য চরমভাবে জীবনবিরোধী। ভীতিহীন স্বাধীনতার মধ্যেই কেবল মানুষ জীবনকে খুঁজে পায়।
এ রকম সমাজে পৌঁছাতে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বলপ্রয়োগের ভূমিকা যে থাকে না, তা নয়। কিন্তু সেটা থাকতে হবে নির্যাতন ও সহিংসতামুক্ত সমাজ গড়তে, প্রতিশোধের লক্ষ্যে নয়।
সেই বলপ্রয়োগের লক্ষ্যে থাকে সহিংসতার ভবিষ্যৎ নির্মূল, পুরো সমাজের সবাইকে মানবিক করে তোলার কর্মসূচি; সেই বলপ্রয়োগ ভবিষ্যতে নির্যাতননির্ভর প্রতিশোধের সংস্কৃতি জিইয়ে রাখতে নয়। জুলুমকে জুলুম দিয়ে প্রতিস্থাপনের জন্য সেই পরিবর্তন নয়। এটা ঘটে সমাজের সব স্তরে, সব ধরনের পারস্পরিক সম্পর্ক গণতন্ত্রায়ণের মাধ্যমে। সব সম্পর্ক থেকে জুলুমের সুযোগ কেড়ে নিয়ে। সর্বত্র সংলাপের আবহ তৈরি করে।
ভাইরাল হওয়া ‘সবকিছু মনে রাখা হবে’-এর মধ্যে কি সে রকম কোনো বিস্তারিত বোঝাপড়া আছে? তাহলে সমস্যা নেই। বরং আশাবাদী হওয়া যায়।
আর যদি এটা হয়, পাল্টা জুলুমের নীরব অঙ্গীকার, তাহলে সেটা হবে কেবল সহিংসতার ভবিষ্যতের জন্য সুসংবাদ। সহিংস কাঠামোর জন্যও আনন্দের হবে তা। বিমানবিকীকরণের যে পদ্ধতিগুলো নিয়ে আজ ক্রোধ ও অশ্রু—সেগুলো তখন আজকের প্রতিশোধপরায়ণদেরও দরকার হবে। কিংবা আরও নির্মম কিছুও দরকার হতে পারে। দমনমূলক সব আইনের ‘প্রয়োগ’ ও ‘অপপ্রয়োগ’ও তাদের দরকার হবে।
অথচ নির্যাতক মন থেকে মুক্ত না হয়ে মানুষ কখনো মুক্তি পায় না। নির্যাতনের কাঠামোগুলো বহাল রাখার গোপন অভিলাষেরও একই পরিণতি।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক